অক্টোবর ১৬, ২০১৭ ১৮:১০ Asia/Dhaka
  • মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি-৩২

সাফাভি আমলের বিখ্যাত মনীষী মুসলিম বিশ্বের নামকরা ফকিহ,কালাম শাস্ত্রবিদ এবং দার্শনিক হলেন মির্দামাদ।তাঁর আসল নাম ছিলো মির শাম্সুদ্দিন মুহাম্মাদ বাকের আস্তারাবাদী। হিজরি ১০২৫ সালে তিনি ইরানের ইস্ফাহানে জন্মগ্রহণ করেন।

 মির্দামাদের মতো উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের উপস্থিতিতে ইস্ফাহানের ধর্মতত্ত্ব কেন্দ্রটি ইসলামী বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান ও চিন্তাগবেষণার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়।সাদরুল মুতাআল্লেহিন মোল্লা সাদরা আরো বেশি জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যে তাঁর নিজ মাতৃভূমি শিরায থেকে ইস্ফাহানে মির্দামাদের কাছে যান। মির্দামাদের উপস্থিতিতে এই ধর্মতত্ত্ব চর্চা কেন্দ্রে দর্শন ব্যাপক সমৃদ্ধি অর্জন করেছিলো। দর্শনবিশ্বে মির্দামাদ তাঁর মূল্যবান বহু রচনা রেখে যান। তৌহিদ, খোদা পরিচিতি ও ইমামত বিশেষ করে ইমাম আলি (আ) এর ইমামতের বিষয়টির ওপর তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। 'রেসালিহি ফি হুদুসিল আলাম' নামক গ্রন্থে তিনি প্লেটোর চেয়ে অ্যারিস্টটলকে শ্রেষ্ঠতরো বলে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।

একইভাবে তিনি তাঁর 'আলকাবাসাত' নামক বইতে পৃথিবীর অস্তিত্ব সম্পর্কে নতুন একটি বিতর্কের সূচনা করেছেন। বিতর্কের বিষয়টি হলো এই বিশ্ব কি সবসময়ই ছিলো নাকি সময়ের কোনো একটি পর্যায়ে তা সৃষ্টি হয়েছে। এই বিশ্ব এবং উর্ধ্বলোকের বাইরে তৃতীয় আরেকটি বিশ্বের অস্তিত্ব রয়েছে। তার নাম হচ্ছে দাহ্‌র। মির্দামাদ মনে করেন এই দাহ্‌রই হচ্ছে উর্ধ্বলোকের সাথে এই বস্তুতান্ত্রিক বিশ্বের যোগাযোগসেতু রচনাকারী। মির্দামাদের আরেকটি বইয়ের নাম হলো 'এয়দালাত'। এ বইতে তিনি বিশটি সমস্যার উল্লেখ করেছেন এবং এইসব সমস্যার সমাধানের উপায়গুলোও বাতিয়ে দিয়েছেন। উল্লেখিত সমস্যাগুলো ছিল গণিতশাস্ত্র, জ্যোতির্বিজ্ঞান, দর্শন, এলমে কালাম, যুক্তিবিদ্যা এবং ফিকাহ সংক্রান্ত। তাঁর আরেকটি বই হলো 'শারহে মুকাদ্দামে তাকভিমুল ইমান'। এ বইতে ইমাম আলী (আ) এবং তাঁর সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। আলী (আ) এর ফযিলত এবং তাঁর স্থলাভিষিক্তি সম্পর্কে বহু হাদিসেরও উল্লেখ রয়েছে বইটিতে।

মির্দামাদকে ইসলামের প্রথম সারির দার্শনিক হিসেবে গণ্য করা না হলেও তিনি যে অন্তত দ্বিতীয় সারিতে রয়েছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি তো কেবল দার্শনিকই ছিলেন না, ছিলেন একাধারে গণিতবিদ, ভাষাবিদ, কবি, সাহিত্যিক ইত্যাদি। প্রকৃতি বিজ্ঞানেও ছিল তাঁর অসাধারণ দক্ষতা। তাকেঁ অনেকেই তৃতীয় শিক্ষক বলে অভিহিত করতো। অসংখ্য ছাত্রপূর্ণ তাঁর ক্লাসে অংশ নিয়ে পরবর্তীকালে বহু মনীষী জন্ম নিয়েছেন। তাদেঁরই একজন হলেন মোল্লা সাদরা। হিজরি একাদশ শতাব্দির স্বনামধন্য দার্শনিক ছিলেন তিনি। তাঁর আসল নাম ছিল সাদরুদ্দিন মুহাম্মাদ শিরাযি। তবে সাদরুল মুতাআল্লেহিন এবং মোল্লা সাদরা নামেই তিনি বেশিরভাগ পরিচিত ছিলেন। তিনি তাঁর সমকালীন সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক ছিলেন, বিশেষ করে এশরাক দর্শনের ক্ষেত্রে। এ বিষয়ে আমরা আরো কিছু কথা বলবো ইনশাআল্লাহ।

পিতার মৃত্যুর পর মোল্লাসাদরা লেখাপড়ার পূর্ণতা বা সম্পন্ন করার জন্যে ইস্ফাহানে যান এবং 'শায়খ বাহায়ি'র মতো শিক্ষকের খেদমতে হাজির হয়ে ফিকাহ, হাদিস এভং তাফসিরে কোরআনের মতো গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞানগুলো অর্জন করেন। এর বাইরেও মির্দামাদের মতো বিখ্যাত শিক্ষকের সান্নিধ্যে থেকে দর্শনের ক্ষেত্রেও ব্যাপক সমৃদ্ধি অর্জন করেন। সবোর্পরি মোল্লাসাদরা তাঁর লেখাপড়ার শুরু থেকে চিন্তার পরিপূর্ণতা অর্জন পর্যন্ত তিনটি পর্যায় অতিক্রম করেছেন। ছাত্রত্বের পর্ব। শিরায ও ইস্ফাহানে লেখাপড়া এবং দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে নির্জনবাস এবং কোমের পার্শ্ববর্তী একটি গ্রামে ইবাদাত বন্দেগি করা আর সর্বশেষ পর্বে রয়েছে শিরাযে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে লেখা বহু বই পুস্তক। মোল্লা সাদরা ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার সাথে সোহরাওয়ার্দির এশরাক দর্শন,অ্যারিস্টটলের মাশায়ি দর্শন,আবু আলি সিনার দর্শন এবং মহিউদ্দিন আরাবির আধ্যাত্মিক দর্শন ইত্যাদি চিন্তাধারাকে সমন্বিত করে নাম দিয়েছেন হেকমাতে মুতাআলিয়েহ। এ যেন একটি নদী, যাতে চারদিক থেকে চারটি দর্শন ঝর্ণাধারার মতো এসে মিশেছে। শহিদ মূর্তযা মোতাহহারি লিখেছেনঃ "হেকমাতে মুতাআলিয়েহ একটা চৌরাস্তার মতো যাতে কালাম,অ্যারিস্টটলের দর্শন,সোহরাওয়ার্দির এশরাক দর্শন,আধ্যাত্মিকতা,কোরআন এবং সুন্নাত এক জায়গায় এসে মিশেছে।"আসলে মোল্লা সাদরার মূল কাজ হচ্ছে বিশ্ব প্রকৃতির গতিময়তা আবিষ্কার। তিনি বিশ্বাস করতেন সমগ্র বিশ্বই অনিবার চলমান,সেখানে স্থিতির কোনো স্থান নেই। বিশ্বসৃষ্টি ব্যবস্থায় সংঘাত বা বৈপরীত্যের উপস্থিতিই এই গতিময়তার উৎস। আর এই উৎসমূলে রয়েছেন সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ। মোল্লাসাদরার এই দৃষ্টিভঙ্গির সাথে প্রাচীন গ্রিক দর্শনের কিছু কিছু মিল খুজেঁ পাওয়া গেলেও তিনি মূলত কোরআনের আয়াতকে এক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন। মোল্লা সাদরার দর্শনকে বাহ্যত সহজ বলে মনে হলেও আসলে ততো সহজ নয়। কেননা এই দর্শনের প্রথম পর্যায়ে পৌঁছতেই একজন তীক্ষ্ম মেধাসম্পন্ন ব্যক্তির জন্যে কয়েক বৎসর সময় লেগে যায় একথা বুঝতে যে সে আসলে বোঝে না। তারপরও বহু দর্শন অনুরাগী বছরের পর বছর ধরে মোল্লা সাদরার দর্শন চর্চা করেও এর গভীরে ঢুকতে পারে নি।

মোল্লাসাদরা দর্শন ও আধ্যাত্মিকতা বিষয়ে মূল্যবান বেশ কিছু বই লিখেছেন। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ বইগুলোর মধ্যে রয়েছে 'আসফারুল আরবায়া'।এ বইতে তিনি আধ্যাত্মিকতার সফরকে চারটি সফর বলে উল্লেখ করেছেন। আধ্যাত্মিকতার এই সফর শুরু হয় মানুষ থেকে। আল্লাহর সাথে সংযোগ স্থাপনের পর পুনরায় মানুষের দিকে ফিরে আসতে হয়। এর মাঝে কেবল আল্লাহর ইবাদাতে মশগুল হবার বিষয়টি থাকে। তাঁর আরো কটি গুরুত্বপূর্ণ বই হচ্ছে 'আলমাবদাউ ওয়াল মায়াদ', মাফাতিহুল গায়েব', তাফসিরে কোরআনে কারিম ইত্যাদি। ইরানের এই মুসলিম দার্শনিকের লেখা বইগুলোর বিস্তৃতি এতো বেশি এবং এতো বিখ্যাত যে ছোট্ট একটি আসরে সে সম্পর্কে কথা বলা হলে না বলা কথাই থেকে যাবে বেশি।

বিখ্যাত এই দার্শনিক মোল্লাসাদরা শেষ পর্যন্ত হিজরি এক হাজার পঞ্চাশ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি পায়ে হেঁটে সতেরোতম বারের মতো হজ্ব পালনের জন্যে গেলে পথিমধ্যে বসরায় ইহলোক ত্যাগ করে চলে যান তাঁর মহান স্রষ্টার সান্নিধ্যে।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/আবু সাঈদ/১৬