অক্টোবর ২২, ২০১৭ ২২:৫১ Asia/Dhaka
  • মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি-৩৩

নিঃসন্দেহে মানুষ সকল সৃষ্টির সেরা এ কারণে যে তার রয়েছে বিবেক-বুদ্ধি এবং চিন্তাশক্তি। প্রতিটি মানুষেরই রয়েছে নিজস্ব চিন্তা বা দৃষ্টিভঙ্গি। সে কারণেই বহুক্ষেত্রে দেখা যায় মানুষের সাথে মানুষের চিন্তা-চেতনা বা দৃষ্টিভঙ্গির তফাৎ রয়েছে।

ইতিহাসের কাল পরিক্রমায় দেখা গেছে মানুষ তার নিজস্ব চিন্তা বা দৃষ্টিভঙ্গিকে সঠিক বলে প্রমাণ করার জন্যে বিচিত্র পন্থা অবলম্বন করেছে। আর যুক্তিবিদ্যা হচ্ছে এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি চেষ্টা। যুক্তিবিদ্যা মানুষকে শেখায় কীভাবে তথ্যপ্রমাণকে কাজে লাগিয়ে সঠিক এবং যথার্থ ফলাফল বের করে আনতে হয়। সেজন্যেই যুক্তিবিদ্যাকে বলা হয় প্রমাণ করা এবং যথাযথ পরিণতিতে পৌঁছার জন্যে সঠিক চিন্তার বিদ্যা। এই বিদ্যার সাহায্যে বিচ্যুতির পথ থেকে সঠিক চিন্তার পথগুলোকে আলাদাভাবে সনাক্ত করা যায়। প্রাচীনকালে যুক্তিবিদ্যাকে শুধুমাত্র দর্শনেরই একটি শাখা হিসেবে মনে করা হতো, কিন্তু বহুকাল ধরে যুক্তিবিদ্যা জ্ঞানের আলাদা একটি শাখা হিসেবে পরিগণিত।

অ্যারিস্টটলই সর্বপ্রথম যুক্তিবিদ্যাকে জ্ঞানের পৃথক এবং স্বতন্ত্র একটি শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দিতেই তিনি যুক্তিবিদ্যা বিষয়ক প্রয়োজনীয় লেখালেখির কাজ সম্পাদন করেন। এক্ষেত্রে তাঁর বিখ্যাত একটি বই হলো 'অর্গানন'। এই বইটিতে ছয়টি অধ্যায় রয়েছে। প্রতিটি অধ্যায়েই যুক্তিবিদ্যার একেকটি বিষয়ের ওপর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এ কারণেই অ্যারিস্টটলকে যুক্তিবিদ্যার রূপকার ও প্রতিষ্ঠাতা বলা হয় এবং একই কারণে তাকেঁ 'প্রথম শিক্ষক' উপাধিতেও ভূষিত করা হয়েছে। অবশ্য ইবনে সিনার মতো কোনো কোনো মনীষী মনে করেন যে অ্যারিস্টটলের আগেও সম্ভবত যুক্তিবিদ্যার অস্তিত্ব ছিল। বিশেষ করে মুসলমানদের নিজস্ব একটা যুক্তিবিদ্যা ছিল ইসলামের সেই প্রাথমিক শতকগুলোতে। ঐ যুক্তিবিদ্যার ওপর অ্যারিস্টটলের যুক্তিবিদ্যা কোনোরকম প্রভাব বিস্তার করেনি।

মুসলমানদের যুক্তিবিদ্যার উৎস উসূলে ফিকা এবং এলমে কালাম। শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে এই দুটি বিষয় নিয়ে মুসলমানরা ব্যাপক চেষ্টা প্রচেষ্টা চালিয়েছেন এবং এইসব জ্ঞানের মাধ্যমে বিশেষ করে এলমে কালাম চর্চার মাধ্যমে দ্বীনী জ্ঞান ও শিক্ষার বিস্তার ঘটিয়েছেন। তাঁরা এলমে কালামের আলোকে যুক্তি প্রদর্শন ও প্রয়োগ করতেন এবং অ্যারিস্টটলীয় যুক্তিবিদ্যার কোনোরকম অনুপ্রেরণা ছাড়াই কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জন করতেন। কালাম শাস্ত্রের এই পদ্ধতিটি হিজরি পঞ্চম শতাব্দি পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। উসূলে ফিকাহ বিদ্যাটিও আসলে ফকিহগণের যুক্তি হিসেবেই গণ্য হতো। মুসলিম বিশ্বে অ্যারিস্টটলের যুক্তিশাস্ত্র আরবি ভাষায় সর্বপ্রথম অনুবাদ করেন ইবনে মোকাফ্‌ফা নামের এক ইরানী। অবশ্য কেন্দি, ফারাবি, আবু আলি সিনা, মোল্লা সাদরার মতো মনীষীরাও অ্যারিস্টটলের যুক্তিবিদ্যা অনুবাদ করেছেন এবং এক্ষেত্রে অনেক কাজ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় আবু আলি সিনা তাঁর 'শাফা' নামক বইতে অ্যারিস্টটলের যুক্তির কাঠামোকে পরিবর্তন করেন নি এবং তার পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন,তবে অন্যান্য গ্রন্থে তা সংক্ষেপে বর্ণনা করেছেন।

এলমে মানত্বেক বা যুক্তিবিদ্যা সম্পর্কে মুসলিম মনীষীদের মধ্যে যাঁরা ব্যাপক পড়ালেখা করেছেন,এ বিদ্যা নিয়ে যাঁরা চর্চা করেছেন 'আবু নাসর ফারাবি' তাঁদের অন্যতম। তিনি বিশ্বাস করতেন যে এলমে মানত্বেকের একটি ব্যাকরণ অর্থাৎ নিয়মনীতি রয়েছে যা মানুষের চিন্তা চেতনাকে সত্যের কাছাকাছি পৌঁছে দেয় এবং ভুলভ্রান্তি থেকে দূরে রাখে। তাঁর স্বলিখিত গ্রন্থগুলোর মাঝে দুটি গ্রন্থ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি হলো 'বর্ণমালা' এবং অপরটি 'শব্দমালা।' এই গ্রন্থ দুটিতে ফারাবি মানত্বেক বা যুক্তিবিদ্যা এবং ব্যাকরণ সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি তাঁর লেখায় সুস্পষ্টভাবে বলেছেন ব্যাকরণ এবং দর্শন বিষয়ক পরিভাষার মাঝে নিবীড় সম্পর্ক রয়েছে। কেননা দর্শন এবং যুক্তিবিদ্যাকে এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় রপান্তর করার জন্যে যেমন প্রাচীন গ্রিক ভাষা থেকে আরবি ভাষায় রূপান্তর করতে হলে ঐ ভাষার ওপর ভালোরকম দখল থাকা জরুরি, বিশেষ করে আরবি ভাষায় একটি দর্শন পরিভাষা কোষের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

ফারাবি বিশ্বাস করতেন যুক্তিবিদ্যা একেবারেই স্বতন্ত্র একটি শাস্ত্র। জ্যামিতি কিংবা হিসাব শাস্ত্রকে তার স্থলাভিষিক্ত করা যাবে না। যুক্তিবিদ্যার ক্ষেত্রে ফারাবি অবদানকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমটি হলো-তিনি অ্যারিস্টটলের যুক্তিবিদ্যাকে আরবি ভাষাভাষীদের ভূবনে যথার্থভাবে প্রসার ঘটিয়েছেন। অপরদিকে যুক্তিকে পাঁচ ভাগে ভাগ করেছেন। হিজরি চতুর্থ এবং পঞ্চম শতাব্দিতে আবু আলি সিনা অ্যারিস্টটলের যুক্তিবিদ্যাকে যথাযথভাবে অধ্যয়ন করে তা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছিলেন। তাঁর 'মানত্বেক আল মাশরেকাইন' নামক গ্রন্থের ভূমিকায় অ্যারিস্টটলের যুক্তি সম্পর্কে যে বিশ্লেষণটি দিয়েছেন, আজ পর্যন্তও অ্যারিস্টটলীয় দার্শনিকদের মাঝে তা অপরিহার্য হয়ে আছে। ইবনে সিনা তাঁর 'শেফা' গ্রন্থেও প্রকৃতি বিজ্ঞান এবং ঐশীদর্শনের পাশাপাশি যুক্তিবিদ্যা নামে একটি অধ্যায় সংযোজন করেছেন।

খাজা নাসিরুদ্দিীন তূসিও আরেক মুসলমান মনীষী যিনি উসূলে ফিকাহ, কালাম, দর্শন, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা ইত্যাদির পাশাপাশি যুক্তিবিদ্যার ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রেখেছেন। তিনি অবশ্য যুক্তিবিদ্যাকে অন্যান্য বিদ্যার অর্থ উপলব্ধি বা বোঝার একটি হাতিয়ার অথবা মাধ্যম বলে মনে করতেন। তিনিও যুক্তিবিদ্যার ক্ষেত্রে বেশ কিছু বই পুস্তক লিখে গেছেন। 'আসাস আল ইকতেবাস' এবং 'শারহে মানত্বেকে ইশারাত' যুক্তিবিদ্যার ক্ষেত্রে তাঁর দুটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। মুসলিম বিশ্বের অপর এক মনীষী হলেন আব্দুর রাহমান বিন মুহাম্মাদ খালদুন মাগরেবি। তিনি অবশ্য 'ইবনে খালদুন' নামেই বেশি পরিচিত। যুক্তিবিদ্যা শাস্ত্রবিদ হিসেবে তিনিও ছিলেন ব্যাপক খ্যাতিমান। অ্যারিস্টটলীয় যুক্তিবিদ্যার একজন সমালোচক এবং একইসাথে সমাজ বিজ্ঞান সমালোচনার ক্ষেত্রেও তিনি ব্যাপক খ্যাতিমান। তাঁর লেখা ইতিহাস বিষয়ক বিখ্যাত বই "আল ইবার...." এর বহুল আলোচিত ভূমিকায় ইতিহাস রচনার পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনেছেন এভং যুক্তিবিদ্যা নিয়ে ভূমিকার বিভিন্ন অধ্যায়ে কথা বলেছেন। অবশ্য তিনি যুক্তিবিদ্যাকে দেখেছেন ইতিহাসের দৃষ্টিতে। যুক্তিবিদ্যার সূত্রপাত এবং মুসলিম বিশ্বে তার প্রবেশ ও বিস্তারের ইতিকথাও স্থান পেয়েছে তাঁর লেখা ভূমিকায়।

 

ইবনে খালদুনের আনুভূতিক যুক্তিবিদ্যা সামাজিক, রাজনৈতিক এবং এ ধরনের অন্যান্য বিদ্যা নিয়ে পড়ালেখার ক্ষেত্রে বেশ কার্যকরী বলে মনে করা হয়। এ সম্পর্কে চমৎকার একটি গল্পের প্রসঙ্গ টেনেছেন তিনি। "এক বাদশার আদেশে মন্ত্রী এবং তার ছোট্ট পুত্রসন্তানকে কারাগারে পাঠানো হয়। সেখানে বেশ ক'বছর কেটে যাবার পর ছেলেটি বড়ো হয় এবং জ্ঞান-বুদ্ধির বয়সে উপনীত হয়। এমন পর্যায়ে ছেলেটি একদিন তার বাবাকে জিজ্ঞেস করেঃ আচ্ছা বাবা,কারাগারে আমাকে যে গোশত দিয়ে খাবার দেওয়া হয়,ওটা কীসের গোশত? বাবা জবাবে বলেঃ দুম্বার গোশত। কিন্তু তার ছেলেটি সেই সময় পর্যন্ত তার জীবনে প্রাণী বলতে কেবল কারাগারের ইঁদুরই দেখেছে,তাই সে ভেবেছে দুম্বা নিশ্চয়ই ইঁদুরের মতোই প্রাণী, তাই বাবার ব্যাখ্যা দেয়া নিষ্ফল।"তার মানে হলো ইবনে খালদুন মনে করতেন- মানুষের জন্যে অপরিচিত বিষয়ে চিন্তা করা খুবই কঠিন, যতোই ভাবুক না কেন মানুষের দেখা বা জানা বিষয়ের মতোই একটা কিছু তার কল্পনায় ভেসে বেড়ায়।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবু সাঈদ/ ২২