অক্টোবর ২৬, ২০১৭ ১৮:২৫ Asia/Dhaka
  • মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি-৩৪

ইসলামের আবির্ভাবের আগে অর্থাৎ আরব্য জাহেলিয়াতের যুগে ইতিহাস রচনার ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে-এরকম কোনো গ্রহণযোগ্য তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায় না।

অবশ্য জাহেলি যুগের আরবরা তাদের গোত্রগত বা কওমগত দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মতো ঐতিহাসিক বহু ঘটনা দুর্ঘটনাকে সুস্পষ্টভাবে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতো অর্থাৎ বুঝিয়ে দিতো। জাহেলি যুগের আরবদের জীবন ছিল একেবারেই সাদামাটা, বড় ধরনের বা গুরুত্বপূর্ণ কোনো ঘটনা তাদের জীবনে ছিল না। ভৌগোলিক কিংবা মানবিক দিক থেকে সেগুলোর প্রভাবও ছিল সীমিত। জাহেলি যুগের আরবদের কাল এবং ইতিহাস সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞানের অভাব ছিল। তাদের দৃষ্টিতে কাল বা সময় ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞানের একটা আবিষ্কার এবং ঋতু পরম্পরা। এ কারণে জাহেলি যুগের আরবরা 'সময় গণনা' র মতো কোনো পরিভাষা বা বিষয়ের সাথে পরিচিত ছিল না। এজন্যেই তারা সময়কে ধারণকারী মূল্যবান ইতিহাসের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে পারে নি।

ইসলাম আসার পর "আইয়্যামুল আরাব" এর সাহিত্যের একটি অংশকে বর্ণনাকারীগণ তুলে ধরেছেন। এই সাহিত্য ধীরে ধীরে ভূগোল এবং সাহিত্যের টেক্সটে পরিণত হয়। 'ইয়াওম' এর ব্যাখ্যা ইসলাম পরবর্তীকালেও যুদ্ধ বিজয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা করা হয়েছে। ইতিহাস চর্চার ব্যাপারে মুসলমানদেরকে অনুপ্রাণিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে কোরআন এবং হাদিস। কোরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইতিহাসের বিচিত্র উপাদান রেখে দিয়েছেন। পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণ, বিভিন্ন সমাজের, গোত্রের ঘটনাপঞ্জী, তাদের বিকাশ, বিজয় এবং পরাজয় ও অবক্ষয়ের নানা দিক কোরআনে বর্ণিত হয়েছে। এসব বর্ণনা কেবল গল্প শোনানোর জন্যে নয় বরং সেসব থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যত জীবনের সঠিক পথ প্রাপ্তির ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করার স্বার্থেই কোরআনে বর্ণিত হয়েছে। কোরআন হচ্ছে মানুষের জীবনযাপনের জন্যে কালোত্তীর্ণ একটি বিধান বা গাইড-লাইন। সর্বকালেই কোরআন তার অনুসারীদেরকে জীবনাচার বা রীতিনীতি শেখায়। আর শেখানোর কাজটি নবী (সা.) থেকে শুরু করে তাঁর পবিত্র আহলে বাইতও সুস্পষ্টভাবে পালন করে গেছেন।

মুসলমানরা তাদের নবী, তাঁর সাহাবাবৃন্দের জীবনী এবং ইসলামের উন্নতি কীভাবে ঘটেছিল-সেইসব সম্পর্কে জানতে গেলেই ইতিহাস সম্পর্কে পড়তে হতো। এভাবে ইতিহাসের প্রতি মুসলমানদের আগ্রহ বিপুল পরিমাণে বেড়ে গিয়েছিল। ইতিহাস বিষয়ক বহু বই তাঁরা রচনা করেছেন। সর্বপ্রথম মুসলিম ইতিহাসবিদ হিসেবে আবু মেখনাফ আযদি'র নাম উল্লেখ করা যায়। তিনি সুনির্দিষ্ট একক বিষয়ের ইতিহাসের ওপর বহু বই লিখেছেন। তাঁর লেখা সেই একক বিষয়ের ইতিহাসের বহুলাংশ তাবারির ইতিহাসে সংরক্ষিত আছে। ইসলামী যুগের ঐতিহাসিক ঘটনাবলি সংশ্লিষ্ট খবরাখবর সংকলনের ক্ষেত্রে আবু মিখনাফ ব্যাপক শ্রম দিয়েছেন। পরবর্তীকালের মুসলিম ইতিহাসবিদগণ সেগুলোকে তাঁদের লেখার মূল উৎস হিসেবে কাজে লাগিয়েছেন। খেলাফতের ইতিহাস রচনা, জনগণের বিভিন্ন পর্যায় বা স্তরবিন্যাস, বংশানুক্রমিক ধারার ভিত্তিতে ইতিহাস রচনা ও সম্পাদনা, বর্ষ গণনা ইত্যাদি আবু মিখনাফের রচনা থেকেই সংগৃহীত হয়েছে। তাঁর লেখা বিভিন্ন যুদ্ধের ইতিহাস এবং জীবনেতিহাস থেকে তাবারি এবং ইবনে আসিরের মতো ইতিহাসবিদগণও তথ্য সংগ্রহ করেছেন।

বেলাজারিও আবু মিখনাফের রচনা থেকে ইতিহাসের বহু তথ্য নিয়ে বর্তমান যুগের পাঠকদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। ইবনে মিখনাফ আযদি'র রচনাবলির মধ্যে "মাকতাল আলহুসাইন", "ফুতুহুশ শাম", "আসসাকিফা", ফুতুহুল ইসলাম", "মাকতালে আলি (আ)" প্রভৃতির নাম উল্লেখ করা যায়। এগুলোর মাঝে "মাকতাল আলহুসাইন" তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।

মুসলিম বিশ্বের আরেকজন বিখ্যাত ইতিহাসবিদ হলেন ইবনে ইসহাক। ইবনে ইসহাক ছিলেন একদিকে একজন মুহাদ্দিস এবং অপরদিকে একজন আরব লেখক। তিনিই সর্বপ্রথম নবীজীর জীবনী এবং নবীজীবনে সংঘটিত যুদ্ধগুলো সম্পর্কে লেখালেখি করেন। তিনি জীবনীধর্মী ইতিহাস লিখতে গিয়ে হযরত আদম (আ) থেকে শুরু করে হযরত মুহাম্মাদ (সা.) পর্যন্ত সকল নবীর ইতিহাসই লিখেছেন। ইবনে ইসহাকের লেখা বইগুলোর কিছু কিছু অংশ তাবারি এবং সিরাতে ইবনে হিশামে রয়েছে। আরো একজন মুসলিম ইতিহাসবিদ হলেন আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ভাকেদি। ২০৭ হিজরিতে তিনি মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন। মদিনা থেকে তিনি ইরাকে যান এবং সেখানকার বাগদাদ শহরের বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন। ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর বহু বই লিখেছেন তিনি। তাঁর একটি বিখ্যাত বই হলো "আলমাহাযি"। নবী (কারিম (সা.) এর জীবনে যতোগুলো যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে সেইসব যুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে লিখেছেন এ বইটি। তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য বই হলো মুসলমানদের বিজয়ের ওপর।

ভাকেদির একজন নামকরা ছাত্র ছিলেন "ইবনে সাদ"। ২৩০ হিজরিতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ইবনে সাদ ছিলেন ভাকেদি'র রচনাবলির একজন লেখক বা কাতেব। এ কারণে তিনি "কাতেবে ভাকেদি" নামেও বহুল পরিচিত। এর বাইরে তিনি নিজেও লেখালেখি করতেন। তাঁর লেখা "আত্‌তাবাকাতুল কাবির" বেশ মূল্যবান একটি বই হিসেবে পরিগণিত। রাসূলে কারিম (সা.), সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়িন, বিভিন্ন মুসলিম শহরের আলেম-উলামা, সে সময়কার বিভিন্ন জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা কেন্দ্র এবং নারীদের এর অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন এ বইতে। "আত্‌তাবাকাতুস সুগরা" নামেও তাঁর অপর একটি বই রয়েছে। বইটির একটি অনুলিপি ইস্তাম্বুলের পুরাতত্ত্ব যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।

তৃতীয় শতাব্দির মাঝামাঝি এবং চতুর্থ শতাব্দির শুরুর দিকে নামকরা আরেকজন মুসলমান ইতিহাসবিদের আবির্ভাব ঘটে। তাঁর নাম মুহাম্মাদ বিন জারির তাবারি। ইরানের বিখ্যাত এই হাদিসবিদ ২২৪ হিজরিতে জন্মগ্রহণ করেন। মুসলিম বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ইতিহাসবিদ তিনি। তাঁর লেখা ইতিহাস বেশ তথ্য সমৃদ্ধ এবং নির্ভরযোগ্য। তিনি যা-ই লিখেছেন তথ্যসূত্রসহ লিখেছেন। সেই হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে ইসলামী যুগের প্রথম তিন শতাব্দি পর্যন্ত সময়কার ইতিহাস তিনি তুলে ধরেছেন তথ্যপঞ্জী সহকারে। তিনি তাঁর পূর্ববর্তী ইতিহাসবিদদের লেখার বর্ণনা তুলে ধরেছেন এবং পরে পর্যালোচনা করে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করেছেন। তাবারির লেখা ইতিহাস পরবর্তীকালের ঐতিহাসিকদের জন্যে প্রামাণ্য দলিল হিসেবে বিবেচিত। মার্কিন ইতিহাসিবিদ বিল ডুরান্ট তাবারিকে পাশ্চাত্যের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ লিভি'র সাথে তুলনা করেছেন। বিশ্বমানবতার জন্যে তাবারি অসংখ্য গ্রন্থ রেখে গেছেন। অবশেষে ৩১০ হিজরিতে বিখ্যাত এই মুসলমান ইতিহাসবিদ বাগদাদে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যান।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবু সাঈদ/ ২৬