মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি-৩৫
মুসলিম ইতিহাস লেখকগণ ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকমের স্টাইল বা পদ্ধতির অনুসরণ করেছেন। এইসব পদ্ধতির মধ্যে একটি হলো ঘটনার বিবরণ তুলে ধরা।
ইসলামী ইতিহাস রচনা পদ্ধতিতে এই ঘটনার বিবরণধর্মী ধারা ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে। হিজরি তৃতীয় শতাব্দি থেকে পরবর্তীকালে এই ধারার প্রচলন চলে আসছে। এই পদ্ধতিতে ঘটনাপঞ্জী ক্যালেন্ডারের পাতার অনুক্রমিক শৃঙ্খলার ভিত্তিতে রচিত হতো।এর আগে সাংস্কৃতিক, প্রশাসনিক, রাজনৈতিক বিক্ষিপ্ত খবরাখবর ও বর্ণনা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কেবল কবিতার মিশ্রণে সঞ্চয়িত হতো এবং সাহিত্যের আঙ্গিকে উপস্থাপন করা হতো। পাদটীকা বা পরিশিষ্ট লেখাও ছিল ইতিহাস রচনাকারীদের অপর একটি স্টাইল। এই পদ্ধতিতে ইতিহাসবিদগণ তাদেঁর পূর্বেকার রচনাকে পরিপূর্ণতা দিতেন অর্থাৎ ঘটনাবলিকে প্রামাণ্য, তথ্যবহুল এবং গ্রহণযোগ্য করে তুলতেন। সেইসাথে নিজের সমকালীন ঘটনাবলিও সংক্ষেপে বর্ণনা করতেন।
এ রকম সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লেখকদের মধ্যে মুসলমান ইতিহাসবিদ ইবনে আসিরের নাম উল্লেখ করা যায়। ৬৩০ হিজরিতে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ইতিহাস লেখা বিষয়ক বহু গ্রন্থ লিখেছেন ইবনে আসির। তাঁর একটি বিখ্যাত গ্রন্থের নাম প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায়। এই গ্রন্থটি হলো "আল-কামিলু ফিত তারিখ"। বহু ইতিহাস লেখক তাঁদের রচনার ক্ষেত্রে এই গ্রন্থটির অনুসরণ করেছেন। এ জন্যে ইবনে আসির ব্যাপক খ্যাতিও অর্জন করেছিলেন। ইবনে আসির তাঁর নিজস্ব ইতিহাসকর্মে ইসলাম-পূর্ব কালের ইতিহাস যেমন তুলে ধরেছেন তেমনি বিশ্ব সৃষ্টি বিতর্ক, বনী ইসরাইলের ইতিহাস-যা ইরানীদের ইতিহাসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ-খ্রিষ্টানদের ইতিহাস, কাদিসীন এবং জাহেলি যুগের আরবদের ইতিহাসের ওপরও কাজ করেছেন। এসবের বাইরেও ইবনে আসির ইসলামের ইতিহাসের ঘটনাবলি বিশেষ করে হিজরতের সময় থেকে ৬৮২ হিজরি পর্যন্ত সময়কালের ইতিহাসও রচনা করেছেন। ইবনে আসির ইসলামের ইতিহাসকে দিনপঞ্জীর অনুক্রম অনুযায়ী বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের কাহিনী বা ইতিহাসসহ বিভিন্ন ঘটনা দুর্ঘটনার ইতিহাসও তুলে ধরেছেন।
সাধারণ ইতিহাস লেখা ঘটনার বর্ণনা, ইসলামী দেশগুলোর বিভিন্ন ঘটনাপঞ্জী তুলে ধরার অপর একটি পদ্ধতি। ইসলামের আবির্ভাবের পরই এই পদ্ধতিটির ব্যবহার শুরু হয়। অবশ্য এই পদ্ধতিতে ইতিহাসবিদগণ বর্ষগণনা এবং দিনপঞ্জীর রীতিতেই ঘটনাবলিকে তুলে ধরতেন। সাধারণ ইতিহাস লিখন পদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ একজন মুসলিম লেখক হলেন আহমাদ বিন আবি ইয়াহিয়া ইয়াকুবি। ২৮৪ হিজরিতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ইরানী এই ভূগোলবিদ এবং ইতিহাসবিদ "তারিখে ইয়াকুবি" গ্রন্থের জন্যে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন। ভূগোল এবং ইতিহাসের ওপর ব্যাপক প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করার পাশাপাশি ইয়াকুবি জ্যোতির্বিজ্ঞানেও ছিলেন যথেষ্ট প্রজ্ঞার অধিকারী। তিনি তাঁর এই জ্ঞানটিকে ইতিহাস রচনার কাজে ব্যবহার করেছিলেন। তিনি হযরত ইসা (আ) এর জন্ম এবং হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর জন্ম ও রেহলাত নিয়েও লিখেছেন। লিখেছেন আরো অনেক মনীষীদের জীবনেতিহাসও। তিনি নক্ষত্রবিদদের মতপার্থক্য নিরসনকল্পে চেষ্টা চালাতেন এবং নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করতেন।
মুসলমান এই ইতিহাসবিদ ভ্রমণ পিপাসু ছিলেন। আর্মেনিয়া, খোরাসান, ভারত, মিশর এবং মরক্কোর মতো দেশগুলো তিনি ভ্রমণ করেছেন। "গাদিরে খুমেঃ" এর গল্প, "হাদিসে সাকালাইন" এবং তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ তিনি তাঁর "খোদা ও ইতরাত" নামক গ্রন্থে উপস্থাপন করেছেন। ইয়াকুবি আরো বলেছেন, কুরআনের সর্বশেষ অবতীর্ণ আয়াত "আল ইয়াওমা আকমালতু লাকুম দ্বীনাকুম ওআতমামতু আলাইকুম নিমাতি অরাদিতু লাকুমুল ইসলামা দ্বীনা" নাযিল হয়েছিল গাদিরে খুমে হযরত আলি (আ) কে নবীজীর স্থলাভিষিক্ত এবং ইমামতিতে নিযুক্ত করার দিন। সূরায়ে মায়েদার এই তিন নম্বর আয়াতটির অর্থ হচ্ছেঃ "আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে র্পূণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অবদান সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।"
মার্কিন চিন্তাবিদ জর্জ সার্টন ইয়াকুবিকে একজন শিয়া ভূগোলবিদ এবং ইতিহাসবিদ হিসেবে আখ্যায়িত করার পর তাঁর "খোদা ও ইতরাত" নামক গ্রন্থ সম্পর্কে বলেছেনঃ তিনি শিয়া হবার কারণে বইটি বেশ চমৎকার লিখেছেন, চাই তা পক্ষপাতহীনভাবেই লেখা হোক কিংবা বিশেষ আগ্রহের সাথে।" প্রসঙ্গক্রমে বলা উচিত এই বইটি লেখা হয়েছে গাদিরে খুমের ঘটনা নিয়ে। ইয়াকুবির লেখা "তারিখে ইয়াকুবি" সবচেয়ে পুরোণো সাধারণ ইতিহাস গ্রন্থ। আরবি ভাষায় লেখা হয়েছে বইটি। এই বইটিকে বলা যায় বিশ্বের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। বিশ্ব ইতিহাসের শুরু থেকে হিজরি তৃতীয় শতাব্দির মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এতে বিধৃত হয়েছে। গ্রন্থটির প্রথম অধ্যায়টি ছিল একটি ভূমিকা। এতে ইসলাম-পূর্বকালের ইতিহাস ছিল। কিন্তু এখন ভূমিকাটির অস্তিত্ব আর অবশিষ্ট নেই। এখন যেটুকু পাওয়া যাচ্ছে তাতে সৃষ্টিজগতের কাহিনীর মাঝখান থেকে শুরু হয়েছে।
এরপর হযরত আদম (আ) থেকে শুরু হয়ে হযরত ইসা (আ) পর্যন্ত নবীদের ইতিহাস রয়েছে। আরো রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও জাতি এবং রাজা-বাদশাদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। নবীদের ইতিহাস বর্ণনার ক্ষেত্রে তিনি কোরআন মাজিদসহ ইসলামী উৎসগুলোই ব্যবহার করেছেন বেশি। যেখানেই তিনি দেখছেন কোনো গোত্রের রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্যপঞ্জী নেই, সেখানে তিনি তাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাস তুলে ধরেছেন। ইয়াকুবি ইতিহাসের দ্বিতীয় খণ্ডে ইসলামের ইতিহাসের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বইটির শুরুতেই নবী করিম (সা) এর জীবনী-তাঁর জন্ম থেকে নবুয়্যত লাভ,হিজরত,যুদ্ধ-তাঁর লেখকগণ, স্ত্রীগণ, তাঁর দেওয়া খুৎবা এবং বক্তৃতা, হুজ্জাতুল বিদা, তাঁর ওফাত এবং সবশেষে তাঁর বংশ পরিচয় এবং তাঁর গুণাবলির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এরপর রাসূলের সর্বপ্রথম স্থলাভিষিক্ত হযরত আলী (আ) এবং রাসূলের আহলে বাইত সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে। তারপর এসেছে উমাইয়া এবং আব্বাসীয় খলিফাদের বর্ণনা। বর্ণনার ক্ষেত্রে ইয়াকুবি ছিলেন যথেষ্ট সচেতন। কোনো ঘটনার ব্যাপারে পর্যালোচনা না করে কোনো তথ্য তিনি দেন নি।
ইতিহাসের বাইরে ভূগোল নিয়েও তিনি ব্যাপক চর্চা করেছেন। তাঁর লেখা ভূগোল বিষয়ক বই "কিতাবে আলবালদান" বিশ্বব্যাপী সমাদৃত একটি বই। বিশিষ্ট খ্রিষ্টান লেখক জর্জ যিদান এ বইটির ব্যাপারে লিখেছেনঃ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ইয়াকুবির 'আলবালদান' আরবি ভাষায় লেখা ভূগোল বিষয়ক সর্বপ্রাচীন বই। মুসলিম বিশ্বের আরো একজন বিখ্যাত ইতিহাসবিদ হলেন "আবুল হাসান আলি বিন হোসাইন মাসউদি"। ৩৪৫ হিজরিতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ভূগোল বিষয়েও তাঁর অবদান প্রচুর। লেখালেখির প্রয়োজনে তিনি বহু দেশ সফর করেছেন। তাঁর ইতিহাস লেখার স্টাইল আধুনিক যুগের খুব কাছাকাছি।#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবু সাঈদ/ ২৭