মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি-৩৮
আরবরা ইসলামের আবির্ভাবের আগে ভূগোবিদ্যার বিভিন্ন দিক বিশেষ করে 'আবহাওয়াবিদ্যা' সম্পর্কে সচেতন ছিল।তারা এই বিদ্যাকে স্থল এবং সমুদ্র বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কাজে লাগাতেন। একইভাবে জ্যোতির্বিজ্ঞান, গ্রহ নক্ষত্রের পরিভ্রমণ ইত্যাদিকে মরুপ্রান্তরে ভ্রমণ করা এবং সম্ভবত যুদ্ধের ক্ষেত্রেও কাজে লাগাতেন।
তাছাড়া জাহেলি যুগের আরবদের কাছে বিশেষ করে মরুবাসী বেদুঈনদের কাছে ছাগল-মেষ তথা পশুপাল ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। পশুপাল চরানোর জন্যে তাই সবুজ চারণভূমি সম্পর্কে তথ্য জানার প্রয়োজন ছিল তাদের। এ কারণেই ভূগোল এবং নক্ষত্র সম্পর্কে খোজখবর রাখাটা জাহেলি যুগের আরবদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হতো।
ইসলামের আবির্ভাবের পর মুসলমানদের মাঝে ভূগোলবিদ্যার উন্নয়ন ও বিকাশে বেশকিছু বিষয় চালিকাশক্তি হিসেবে সাহায্য করে। রাশিয়ার ইরান বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্ট লেখক ইগনাতি ক্রাস্কোফস্কি এ সম্পর্কে লিখেছেনঃ ইসলামী খেলাফতের বিস্তার এবং হিজরি দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দিতে ইসলামের প্রভাবের কারণে বহু প্রশাসনিক পেশা বিশেষ করে অর্থ ও আয়করের ক্ষেত্রে অনেক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়। এইসব কার্যক্রম পরিচালনার জন্যে বহু বইও লেখা হয়েছিল। এ সংক্রান্ত বইয়ের নাম দেওয়া হয়েছিল 'কিতাবুল খারাজ" বা আয়কর গ্রন্থ।...আয়কর আদায়ের ক্ষেত্রে নিয়োজিতদের জন্যে শুরুতে এ বইগুলো ছিল গাইড স্বরূপ, তবে পরবর্তীকালে তা সামগ্রিক রূপ পেয়ে যায়। তদুপরি প্রশাসনিক কার্যক্রমের কেন্দ্রগুলোর সাথে রাজধানীর যোগাযোগের জন্যে উপযুক্ত রাস্তাঘাট তৈরি করা হতো। সে সময় অবশ্য বাগদাদই ছিল ইসলামী প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রধান কেন্দ্র। তো রাস্তাঘাট তৈরির পর সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য দেওয়ার প্রয়োজন পড়তো। এভাবে তথ্য আদান প্রদানকারীদের প্রয়োজনে রাস্তাঘাট সংক্রান্ত ভূগোল বিদ্যাটির বিকাশ ঘটে।
আব্বাসীয় শাসনামলে তাদের শাসনই ছিল সমকালীন বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী। তারা কেবল নিজেদের ভূখণ্ড আর তার সীমা সম্পর্কে জানার মাঝেই সীমিত থাকতে চাইতো না, অন্যান্য ভূখণ্ড বিশেষ করে ইসলামী ভূখন্ডের প্রতিবেশি দেশগুলো সম্পর্কেও নির্ভুল তথ্য পেতে চাইতো। দূত কিংবা যুদ্ধবন্দীদের মধ্য থেকে যারা স্বদেশে ফিরে আসতো বিশেষত তারাই ছিল এইসব তথ্যের মূল উৎস। ইসলাম আবির্ভাবের প্রাথমিক দশকগুলোতে ভ্রমণ করার একটা রেওয়াজ ব্যাপকভাবে গড়ে ওঠে। এর একটা প্রধান কারণ ছিল কাবা ঘরের যিয়ারত তথা হজ্ব করা। এটা ছিল মুসলমানদের জন্যে অবশ্য পালনীয় ইসলামের মৌলিক কতর্ব্যগুলোর অন্তর্ভুক্ত। এর বাইরেও মুসলমান ব্যবসায়ীগণ জলবাণিজ্য কিংবা স্থল বাণিজ্যের স্বার্থে ইসলামী ভূখণ্ডেরই দূর দূরান্তে যেতে বাধ্য ছিলেন। এভাবে ভূগোল সম্পর্কে তাঁদের জানাশোনা যেমন বৃদ্ধি পায় তেমনি এ বিষয়ে অনুপ্রেরণা বোধ করেন।
একটা সময় মুসলমান ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যের সীমা দেশের ভৌগোলিক সীমান্ত অতিক্রম করে যায়। সেন্ট্রাল আফ্রিকা, ইউরোপের উত্তর-পূর্আঞ্চল এবং এশিয়ার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে তাঁদের বাণিজ্য বিস্তৃতি পায়। আর এই বাণিজ্যের সুবাদে ভারত সাগর উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে ইসলামেরও প্রসার ঘটে।
ভূগোল সম্পর্কে মুসলমানদের জ্ঞান বিস্তারের ক্ষেত্রে ইসলামের বিভিন্ন আদেশ-নিষেধেরও প্রভাব রয়েছে। যেমন রাসূলে খোদা (সা) বলেছেনঃ 'সুদূর চীন দেশে গিয়ে হলেও জ্ঞান অর্জন করো।' এভাবে হিজরি প্রথম শতাব্দি থেকেই উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে তথা জ্ঞান অন্বেষেণের লক্ষ্যে সফর করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, আসহাদুল খায়ের আনসারি আন্দালূসি সুদূর চীনে গিয়ে পড়ালেখা করেছিলেন বলে তিনি 'চীনা' হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। মুসলমানদের মাঝে চান্দ্রমাসের হিসাব নিকাশের জন্যে বিশেষ করে রমযান মাসের দিনগুলোর হিসাবের জন্যে, সেইসাথে দৈনন্দিন নামাযের সময়সূচি নির্ধারণ করার জন্যে গণিত শাস্ত্রেও মুসলমানগণ ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। আর গণিত শাস্ত্রে মুসলমানদের জ্ঞানার্জন গাণিতিক এবং নাক্ষত্রিক ভূগোলের বিকাশে সাহায্য করে। ইসলামী ভূখণ্ডে নামায আদায়কারীদের জন্যে কেবলার দিক নির্ধারণ করা এবং মসজিদ নির্মাণ করার জন্যেও মক্কার দৈর্ঘ প্রস্থ সম্পর্কে জানাটা ছিল অপরিহার্য একটি বিষয়।
ভূগোল সম্পর্কে মুসলমানদের জ্ঞানের ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল তা হলো বিশ্ব সম্পর্কে জানা,পূর্ববর্তীদের কর্ম থেকে শিক্ষা নেওয়ার জন্যে সফর করা এবং সত্যকে উপলব্ধি করার ব্যাপারে পবিত্র কোরআনের নির্দেশ। পবিত্র কোরআনের সূরা মুমিনের ৮২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেনঃ 'তারা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করে নি? যদি ভ্রমণ করতো তাহলে দেখতে পেত তাদের পূর্ববর্তীদের কী পরিণতি হয়েছে।' এ ছাড়াও কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে ভূগোল সম্পর্কে বহু তথ্য দেওয়া হয়েছে যা মুসলমানদেরকে এ বিষয়ের প্রতি অনুরাগী এবং কৌতূহলি করে তোলার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে।
অবশ্য এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, ভূগোল বিষয়ক জ্ঞানের ক্ষেত্রে মুসলমানরা গণিত ও চিকিৎসাবিদ্যার মতো বিষয়গুলোর মতোই পূর্ববর্তী সভ্যতাগুলোর উত্তরাধিকার বিশেষ করে গ্রিস, ইরান এবং ভারতের ওপর নির্ভর করেছিলেন। তাদের সৃষ্টিকর্মগুলোকে অনুবাদ করার মধ্য দিয়ে ভূগোল বিষয়ক জ্ঞানের পরবর্তী দ্বার উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছেন। ইরান, মিশর এবং তৎকালীন ভারতের সিন্ধু জয়ের ফলে সভ্যতার এই তিন লালনভূমির জনগণের জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক অবস্থা সম্পর্কে মুসলমানদের অবহিত হবার সুযোগ সৃষ্টি হয়। আব্বাসীয় খলিফা মানসুরের খিলাফতকালে ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যা ও ভূগোল বিষয়ক সৃষ্টিকর্ম "সংস্কৃত সুর অথবা সিদ্ধান্ত' নামক গ্রন্থ প্রথমবারের মতো আরবি ভাষায় অনূদিত হয়ে মুসলমানদের হাতে পৌঁছে যায়। এই গ্রন্থে প্রাচীন গ্রিসেরও কিছুটা প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। বলাবাহুল্য এই বইটি আরবি ভাষায় অনূদিত হবার পর জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং ভূগোল বিষয়ক মুসলমানদের জ্ঞান চর্চার মূল উৎসে পরিণত হয়।
ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে যে ভূগোলবিদ্যায় ইরানী মনীষীদেরও ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। বিশেষ করে হিজরি তৃতীয় শতাব্দির পর থেকে ভূগোলবিদ্যায় প্রাচ্যের বিশেষ করে ইরানের প্রভাব পশ্চিমের চেয়ে বেশি ছিল। কেননা বেশিরভাগ মুসলমান ভূগোলবিদই ছিলেন ইরানী। ইরানের ভৌগোলিক ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাটি হলো সাতটি সমান জ্যামিতিক বৃত্তে ভূপৃষ্ঠকে ভাগ করা। এই সাতটি বৃত্তের প্রত্যেকটিই এক একটি দেশ বা অঞ্চলের প্রতীক।#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবু সাঈদ/ ১৫