ডিসেম্বর ১৮, ২০১৭ ২০:০৯ Asia/Dhaka
  • মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি-৩৯

বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলিম মনীষীগণ ভূগোল সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণা করেছেন।

তাঁদের গবেষণাগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছিল বর্তমান স্পেন, উত্তর আফ্রিকা, দক্ষিণ ইউরোপ, এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল, ভারত মহাসাগর এবং তার আশেপাশের সমুদ্রগুলোকে ঘিরে। আব্বাসীয় খলিফা মামুন এবং মানসুরের আমলে ভূগোলবিদ্যার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। এ সময় ভৌগোলিক পরিমাপ, পর্যবেক্ষণ টাওয়ার নির্মাণ, ভৌগোলিক মানচিত্র তৈরি করার পাশাপাশি বিশেষ করে ভূগোল বিষয়ক ভারতীয়, গ্রিক এবং ইরানী সৃষ্টিকর্মগুলোর অনুবাদ করার ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করা হয়েছিল। মামুনের সময় ভূগোলবিদ্যার ব্যাপক উন্নতি এবং অগ্রগতি হয়েছিল। তাঁর শাসনকালেই একদল জ্যোতির্বিজ্ঞানী অ্যাস্ট্রোনমিকেল চার্ট তৈরি করেন এবং "আসসুরাতুল মামুনিয়া" নামে বিশ্ব মানচিত্র তৈরি করেন। হিজরি তৃতীয় শতক ছিল ইসলামী সভ্যতার ক্ষেত্রে ভূগোলবিদ্যার উন্নয়ন ও নতুন নতুন উদ্ভাবনীর যুগ।

এই যুগে মুসলমানরা যে কেবল টলেমি'র সৃষ্টিকর্মের সাথে পরিচিত হয়েছিল কিংবা ভূগোলবিদ্যা সংক্রান্ত বই পুস্তক অনুবাদে হাত দিয়েছিল তাই নয় বরং বর্ণনামূলক ভূগোলের বিচিত্র নিদর্শনও তুলে ধরেছিল। এই সময়কালে অসংখ্য ভ্রমণ কাহিনীও লেখা হয়েছিল। হিজরি চতুর্থ শতকে কিছু ইসলামী রীতি পদ্ধতির সূচনা ঘটে। এইসব রীতিতে বিভিন্ন ভূখণ্ডের পরিস্থিতি, পাহাড়-পর্বত, সমুদ্র, হ্রদ, মরুপ্রান্তর আর বিভিন্ন শহরের বর্ণনা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হতো। এ সময় ব্যাপক মাত্রায় ভূগোল বিষয়ক লেখালেখি হয়। সহজ সরল ভাষায় সর্বজনবোধ্য করে লেখার একটি ধারাও এ সময় গড়ে ওঠে। জ্ঞানের প্রয়োজনে এ সময় কারিগরি বিষয়ের প্রতিও মনোযোগ দিতে হয়েছে। তাই লক্ষ্য করা যাবে এ সময়কার ভ্রমণ কাহিনীগুলো রং ও বৈচিত্রে বিশেষত্ব লাভ করে।

জার্মানির প্রাচ্যবিদ ও ইসলাম বিশেষজ্ঞ ফ্রান্তেয তেশনার হিজরি তৃতীয় ও চতুর্থ শতকের ভূগোলবিদদের সৃষ্টিকর্মগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। এক ভাগে রয়েছে আব্বাসীয় শাসনামলের ভূগোলবিদদের সৃষ্টিকর্ম যাঁরা ধর্মীয় এবং অধর্মীয় ভৌগোলিক বিষয় আশয় বর্ণনা করেছেন। এঁরা "ইরাকি মতাদর্শে"র অনুসারী হিসেবে পরিচিত। অপর সৃষ্টিকর্মগুলো "বালখি মতাদর্শে'র অনুসারীদের সাথে সম্পৃক্ত। মুসলিম ভূগোলবিদদের প্রতিবেদন অনুযায়ী এঁরা ইসলামী ভূখণ্ডের অধিবাসী ছিলেন। ইরাকী মতাদর্শের অনুসারী মুসলিম ভূগোলবিদ হিসেবে যাঁর নামটি সবার আগে উচ্চারিত হয় তিনি হলেন 'ইবনে খোরদাদবেহ।'তিনি অবশ্য ইরানী ভূগোলবিদ ছিলেন। হিজরি ৩০০ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জরাথ্রুস্ট ধর্মাবলম্বি ছিলেন তবে বারমাকিদের অনুপ্রেরণায় ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। জীবনের প্রথম দিকে তিনি বাগদাদে যান এবং পিতার ছত্রচ্ছায়ায় সেখানে লেখাপড়া চালিয়ে যান।এ পর্যন্ত তাঁর দশটি গ্রন্থ সনাক্ত করা হয়েছে যার মধ্যে আটটি গ্রন্থের নাম ইবনে নাদিমের 'আলফিহরাস্তে'এসেছে।

দু'টি মাত্র গ্রন্থ ছাড়া ইবনে খোরদাদবেহর সকল সৃষ্টিকর্মই নষ্ট হয়ে গেছে। যে দুটি গ্রন্থ অবশিষ্ট রয়েছে তার মধ্যে একটি হলো "আলমাসালিক ওয়াল মামালিক"। এ বইটি হিজরি তৃতীয় ও চতুর্থ শতকের ভূগোল বিষয়ক শ্রেষ্ঠ গ্রন্থগুলোর একটি। রাশিয়ার বিখ্যাত ইরান বিশেষজ্ঞ ভাসিলি ভ্লাদিমিরভিচ বাটোর্ল্ড বলেছেন ভূগোল বিষয়ে উল্লেখিত সময়কালের গ্রন্থগুলোর মধ্যে খোরদাদবেহর আলমাসালিক ওয়াল মামালিক গ্রন্থটি মোটামুটি অন্য সকল গ্রন্থের তুলনায় গুরুত্বপূর্ণ।এ বইটি পড়লেই তৃতীয় শতকের মুসলিম এশিয়ার ভূখণ্ডের গুণমান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।এ গ্রন্থে বর্ণিত তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের ভূগোল বিষয়ক তথ্যাবলি প্রাচীন বিশ্ব ভূগোল কিংবা গ্রিক ভূগোলবিদদের সৃষ্টিকর্মের চেয়ে বহুগুণ বেশি সমৃদ্ধ। সে কারণে ইবনে খোরদাদবেহর প্রভাব তাঁর পরবর্তী ভূগোলবিদদের ওপর ব্যাপক লক্ষ্য করা যাবে। ইদ্রিসি কিংবা ইবনে খালদুনের মতো মনীষীগণও ইবনে খোরদাদবেহর বইগুলোর সাথে পরিচিত ছিলেন।

ইবনে খোরদাদবেহর আলমাসালিক গ্রন্থটিতে বেশিরভাগই ইসলামী এবং অনৈসলামী দেশগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থা তথা রাস্তাঘাটের অবস্থার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। বইটির অংশবিশেষে বিভিন্ন দেশ থেকে কেবলার দিক নির্ণয়, প্রশাসনিক বিভাজন এবং আয়কর প্রয়োগ পদ্ধতি বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। মুসলিম এই ভূগোলবিদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণগুলো-বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোর অবস্থান এবং রাস্তাঘাটের মানচিত্র সম্পর্কে এতোটাই নির্ভুল যে রাশিয়ান বিশিষ্ট ইরানবিদ ও লেখক ইগনাৎজি ক্রাসকোভস্কি বলেছেন এর আলোকে সেই হিজরি তৃতীয় শতকের খেলাফতের বাজেট সম্পর্কেও পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে। ইবনে খোরদাদবেহ তাঁর বইটিতে প্রথমে বাগদাদের উত্তরাঞ্চল থেকে দজলা-ফোরাতের মধ্যবর্তী অঞ্চলের রাস্তাগুলো এবং দক্ষিণ থেকে সেই ভারত পর্যন্ত রাস্তার বর্ণনা দিয়েছেন। একইসাথে তিনি এই বইতে ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপ জাভা'র লোকজন এবং ভারতীয় মাযহাবি ফের্কাগুলো সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন।পূর্বাঞ্চলীয় রাস্তাঘাটের বর্ণনা প্রসঙ্গে মদিনা থেকে খোরাসানের রাস্তাগুলোরও বর্ণনা দিয়েছেন।

ইবনে খোরদাদবেহর আল মাসালিক গ্রন্থের অন্যান্য অধ্যায়ে ইরানের উত্তর-পূর্ব এবং মধ্য এশিয়ার রাস্তাগুলোর পরিস্থিতি এবং ভোগৌলিক অবস্থানের বর্ণনা রয়েছে। ইরানের দক্ষিণ উপকণ্ঠের রাস্তাঘাটের বর্ণনা দেওয়া ছাড়াও তিনি তাদের আয়ের পরিমাণ এবং আয়করের পরিমাণের কথাও উল্লেখ করেছেন। এরপর বসরা এবং আবাদানের পূর্বদিকে ওমান,ভারত এবং চীন পর্যন্ত সমুদ্রপথের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। পথের বর্ণনার পাশাপাশি তিনি এসব এলাকার লোকজনের ধর্ম, আকিদা-বিশ্বাস এবং সেখানকার পণ্যসামগ্রির প্রতিও ইঙ্গিত করেছেন। এছাড়াও রয়েছে এশিয়ার পশ্চিমাঞ্চল এবং আফ্রিকার উত্তরাঞ্চল থেকে শুরু করে ইউরোপ ও স্পেন পর্যন্ত সড়ক যোগাযোগের চিত্র। আজারবাইজান, ককেশাস থেকে দক্ষিণ দিকে বাগদাদ, মক্কা, মদিনা এবং সৌদিআরবের দক্ষিণাঞ্চল পর্যন্ত রাস্তারও বর্ণনা রয়েছে বইটিতে। ইবনে খোরদাদবেহ ইউরোপ থেকে ইহুদি বণিকদের ভারত এবং চীন যাত্রার রুট দুটিও উল্লেখ করেছেন।

আরেকজন বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ও ভূগোলবিদ হলেন ইয়াকুবি। তিনি ছিলেন একজন ইরানী মনীষী। ইবনে খোরদাদবেহ'র সমসাময়িক ছিলেন তিনি। শৈশবেই তিনি তাঁর জন্মস্থান ত্যাগ করে আর্মেনিস্তান এবং খোরাসানে কাটিয়েছেন। তারপর যান ভারত এবং ফিলিস্তিন। এই বিজ্ঞানী এবং মুসলিম ভূগোলবিদ তাঁর লেখা বহু মূল্যবান সৃষ্টিকর্ম রেখে গেছেন। ভূগোল বিষয়ক তাঁর একটি বিখ্যাত গ্রন্থ হলো "আলবুলদান"। সাহিত্যিক গুণের দিক থেকে ইয়াকুবির লেখা ইবনে খোরদাদবেহ'র লেখার চেয়ে উন্নততর। যদিও লেখার স্টাইল হিজরি তৃতীয় শতাব্দির ক্ল্যাসিক আদর্শ আলমাসালিক ওয়াল মামালিকের কাছাকাছি।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবু সাঈদ/ ১৮