মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি-৪০
আহমাদ ইবনে সাহল আবু যেইদ বালখি একজন মুসলমান সাহিত্যিক, দার্শনিক এবং ভূগোলবিদ হিসেবে সুপরিচিত। জ্ঞানের আরো বিভিন্ন শাখাতেও তাঁর দক্ষতা ছিল।
বিখ্যাত এই মনীষী বালখের কাছে জন্মগ্রহণ করেন। তরুণ বয়সে তিনি শিয়া বা ইমামিয়া মাজহাবের ওপর গবেষণার জন্যে ইরাক সফরে যান এবং ইসহাক কেন্দির মতো মহান শিক্ষকের কাছে বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানার্জন করতে থাকেন। আট বছর ইরাকে কাটিয়ে আবু যেইদ দর্শন, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, প্রকৃতি বিজ্ঞান, এলমে কালামসহ ইসলামী আরো বহু বিষয়ে জ্ঞানার্জন করেন। এরপর ফিরে আসেন বালখে।বালখে ফেরার পর জ্ঞানের সমৃদ্ধির কারণে তৎকালীন সমাজপতিদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। সে সময়কার অপরাপর জ্ঞানীগুণীদের সাথে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে সংলাপে জড়াতেন। তাছাড়া দূর-দূরান্ত থেকে অনেকেই জ্ঞান-বিজ্ঞান-ধর্মসহ বিভিন্ন বিষয়ে জানতে চেয়ে চিঠি পাঠাতেন সেগুলোর যথার্থ তথ্য-উপাত্তসহ যুক্তিপূর্ণ জবাবও দিতেন। আবু হাইয়্যান তৌহিদি নামের হিজরি চতুর্থ শতকের ইরানী মনীষী সে সময় কাউকেই জ্ঞানী বলে অনুমোদন করতেন না, তিনি আবু যেইদকে "জ্ঞানের সমুদ্র" এবং "শিক্ষকদের শিক্ষক" বলে উপাধি দিয়েছিলেন।
আবু যেইদ বালখি সর্বপ্রথম কোনো মুসলিম ভূগোলবিদ যিনি মানচিত্র অঙ্কনে ব্যাপক পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টিকর্মগুলোর মধ্যে 'সুয়ারুল আকালিম' বা 'কিতাবুল আশকাল' এর নাম উল্লেখ করা যায়। জিওগ্রাফিক্যাল চার্ট কিংবা মানচিত্রের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে এসব বইতে। বালখি এইসব কাজের ভক্ত ছিলেন এসতাখরি, ইবনে হুকেল এবং মুকাদ্দেসির মতো বিশিষ্ট ভূগোলবিদগণ। এঁরা এককথায় বালখির অনুসারী হয়ে ওঠেন এবং বালখি তাঁদের আদর্শস্থানীয় হয়ে উঠেছিলেন। জার্মানির বিশিষ্ট ভূগোলবিদ ও ইতিহাসবিদ মুলের আবু যেইদ বালখির হাতে লেখা প্রাচীন পাণ্ডুলিপিগুলোর মাঝ থেকে ষাটটি ভৌগোলিক মানচিত্র দেখেছেন। সেগুলো দেখে তিনি যে কেবল বালখির কাজের গুরুত্বের কথাই স্বীকার করেছেন তাই নয় বরং এ কাজে তিনি যে অগ্রজ সে কথাও অকপটে স্বীকার করেছেন মুলের। বর্তমানে তাঁর সুয়ারুল আকালিমের একটি কপি কারবালায় ইমাম হোসাইন (আ) এর মাযারের তালাবদ্ধ গ্রন্থাগারে এবং আরেকটি কপি রঙিন মানচিত্রসহ বাহরাইনে দেখতে পাওয়া পাবে।
বালখির আদর্শের আরেকজন অনুসারী হলেন আবু ইসহাক ইব্রাহিম বিন মুহাম্মাদ ফারসি। তিনি এস্তাখ্রি নামেই বেশিরভাগ পরিচিত ছিলেন। তবে ফারসি এবং এস্তাখ্রিয়ে কারখি নামেও তাঁর পরিচিত রয়েছে। বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন হয়তো এস্তাখ্রে ফার্সে তাঁর উত্থান ঘটেছে এবং সম্ভবত কিছুদিন তিনি বাগদাদের কারখ এলাকায় বসবাস করে থাকবেন। যাই হোক,ইরানী এই মনীষী একাধারে ছিলেন একজন ভূগোলবিদ এবং ভৌগোলিক মানচিত্র অঙ্কনে পারদর্শী। হিজরি ৩৪০ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। এস্তাখ্রি বালখি মতাদর্শ প্রচার প্রসারে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের পর এস্তাখরি ভূগোল নিয়ে লেখাপড়া করে আরব ভূগোলবিদ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। তিনি প্রচুর ভ্রমণ করেছেন এবং ভ্রমণ অভিজ্ঞতাগুলো তাঁর গ্রন্থগুলোতে রেখে গেছেন। এ সংক্রান্ত তাঁর রেখে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ বইগুলোর একটি হলো "আলমাসালিক ওয়াল মামালিক" বা পথ ও প্রদেশগুলো। এ বইটিতে তাঁর ভ্রমণের অভিজ্ঞতালব্ধ বর্ণনা রয়েছে।
এস্তাখ্রিও অপরাপর মুসলিম ভূগোলবিদের মতো মুসলিম বিশ্বের বর্ণনা দিয়েছেন। আলমাসালিক ওয়াল মামালিক গ্রন্থে তিনি মুসলিম বিশ্বকে বিশটি ভাগে ভাগ করেছেন। ভৌগোলিক অঞ্চল এবং তাদের আয়তনের বর্ণনা দেওয়ার পাশাপাশি সমুদ্রগুলোরও বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এ বইতে। যেসব এলাকার বর্ণনা রয়েছে এ বইতে তার মধ্যে রয়েছে আরব্য উপদ্বীপ, পশ্চিম পারস্য সাগর, মিশর, সিরিয়া, রোম সমুদ্র, ইরাক, ভারত এবং ইরানের বিভিন্ন অঞ্চল। মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন এলাকার পরিস্থিতি বর্ণনার মধ্য দিয়ে বইটির পরিসমাপ্তি ঘটেছে। বিভিন্ন সীমান্ত, শহর-নগর, দূরত্ব, যোগাযোগের পথ ইত্যাদি সম্পর্কে এ বইতে পাঠকদেরকে খুবই গ্রহণযোগ্য তথ্য দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন গোত্র, শিল্প-কলকারখানা এবং বাণিজ্যিক পণ্য সামগ্রি সম্পর্কেও বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে বইটিতে। এস্তাখ্রির এই বইটি গুরুত্বের কারণে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
বালখি মতাদর্শের সর্বশেষ প্রতিনিধি হিসেবে মাকদেসির নামটি উঠে আসে। মুসলিম বিশ্বের ভূগোলই নয় শুধু বরং সমগ্র ভূগোল বিশ্বেই তাঁর জ্ঞানের সুউচ্চ স্থানের বিষয়টি স্বীকৃত। তাঁর পুরো নাম হচ্ছে শামসুদ্দিন আবু আব্দুল্লা মুহাম্মাদ বিন আহমাদ মাকদেসি। তিনি হিজরি ৩৩৬ সালে বাইতুল মুকাদ্দাসে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবেই তিনি বাগদাদে চলে যান এবং বড়ো বড়ো আলেম ওলামার কাছে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন। বাগদাদের পাঠাগারগুলোর সাথে তাঁর ভালোরকম সখ্যতা গড়ে ওঠে, সেখানে তিনি ভূগোল বিষয়ক বইগুলোর প্রতি আকৃষ্ট হন। ভূগোল বিষয়ক বইগুলো গভীরভাবে পড়ে তিনি বুঝতে পারেন যে সেগুলোর অধিকাংশই সরেজমিনে গিয়ে দেখে শুনে লেখা হয় নি। তাদের লেখার অপূর্ণতা পূরণ করার লক্ষ্যে তিনি তাই বিভিন্ন শহর-নগর ভ্রমণ করতে শুরু করেন। আঞ্চলিক গুরুত্ব ভেদে তিনি মাসের পর মাস ভ্রমণে কাটিয়েছেন,কেোথাও কোথাও বছরেরও বেশি সময় কেটে যেত। তিনি ইয়েমেন, স্পেন, সিন্ধ, সিস্তান এমনকি সিসিলি দ্বীপসহ মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য এলাকাও ভ্রমণ করেছেন।তাঁর লেখালেখিতে এইসব এলাকা ভ্রমণের কথা বলা হয়েছে।
যেহেতু তিনি গ্রন্থাগার ব্যবহার করার পাশাপাশি কোনো অঞ্চল সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্যে সেই এলাকায় চলে যেতেন, সেজন্যে ঐসব এলাকা সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান ছিল একেবারে প্রামাণ্য। এ কারণে তিনি ভূগোল বিষয়ক লেখালেখি করা কিংবা মানচিত্র অঙ্কণবিদ্যা নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি এবং ধারণা দিয়েছেন। তাঁর সেইসব দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণিত হয়েছে "আহসানুত্ তাকাসিম ফি মারিফাতিল আকালিম'নামক বইতে। মুসলিম দেশগুলোর আকিদা-বিশ্বাস, রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক পরিস্থিতি সম্পর্কে চমৎকারভাবে লিখেছেন মাকদেসি। তিনি এমনকি সামানিয়ান, আলে-বুইয়ে এবং বংশানুক্রমিক আব্বাসীয় শাসনের ইতিহাসও তুলে ধরেছেন এ বইতে। জার্মানির বিশিষ্ট প্রাচ্যবিদ ও ইসলাম বিশেষজ্ঞ ফ্রান্তেয তেশনার মাকদেসির ভূয়সি প্রশংসা করে বলেছেনঃ
'মাকদেসি মনে করতেন ভূগোলবিদ্যা এমন একটি বিদ্যা, অনুমান করে যার সম্পর্কে কিছু অর্জন করা সম্ভব নয়, বরং দেখে শুনে সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহ করে এই বিদ্যা অর্জন করা উচিত। এজন্যেই তিনি সেইসব লেখার ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন যেগুলো সরেজমিনে গিয়ে বাস্তবে দেখে শুনে লেখা হয়েছে।' #
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবু সাঈদ/ ২৪