মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি-৪১
ইসলাম জ্ঞান অর্জনের ওপর এতো বেশি গুরুত্ব দিয়েছে যে বলা হয়েছে, দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অন্বেষণ করো। ইসলামের এই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে যাঁরা বাস্তবায়ন করেছিলেন তাঁদেরই একজন হলেন আবু রেইহান বিরুনি।
এই মনীষী মৃত্যুশয্যায় জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো যখন অতিবাহিত করছিলেন একজন ফকিহ তখন তাঁর শিয়রে এসে বসলেন। বিরুনি ঐ ফকিহকে ভূগোল বিষয়ে একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিলেন। ফকিহ বললেন "এখন বুঝি এই প্রশ্ন করার সময়?" বিরুনি বললেন "হে বন্ধু! এ দুয়ের মধ্যে কোনটা ভালো-জেনে মরে যাওয়া নাকি না জেনে মূর্খের মতো এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়া? ফকিহ বললেনঃ আমি বিষয়টা সম্পর্কে বললাম এবং সে তা শিখে নিল। এরপর তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কয়েক কদম যেতে না যেতেই বিরুনির ঘর থেকে বিলাপ শোনা গেল। মৃত্যুর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এভাবেই জ্ঞান অর্জন করেছিলেন আবু রেইহান বিরুনি। ইসলাম যেভাবে চেয়েছে ঠিক সেভাবেই দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অন্বেষণে ব্যাপৃত ছিলেন তিনি।
হিজরি পঞ্চম শতাব্দিতে মুসলমানদের ভূগোলবিদ্যা চর্চার ধারা তুঙ্গে ওঠে। এ সময়ে মুসলমানদের ভৌগোলিক জ্ঞান উন্নতি ও অগ্রগতির শিখরে আরোহন করেছিল। মুসলমানদের মাঝে যে কজন মহান মনীষী ভূগোল বিষয়ক জ্ঞান চর্চার অগ্রগতির ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলেন তাঁদের অন্যতম হলেন আবু রেইহান বিরুনি। বিখ্যাত এই মুসলিম ভূগোলবিদ, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং নৃতত্ত্ববিদ হিজরি ৩৬২ সালে বর্তমান উজবেকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ খাওয়ারেযমে এক ইরানী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ওপর যারাই গবেষণা করেছেন বিশেষ করে পশ্চিমা গবেষকগণ তাঁর মেধা ও সৃজনশীল প্রতিভার ব্যাপারে বিস্মিত হয়েছেন। মার্কিন বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও বিজ্ঞানের ইতিহাস বিষয়ক লেখক জর্জ সার্টন তাঁর "বিজ্ঞানের ইতিহাসের ভূমিকা" শীর্ষক বইতে খ্রিষ্টিয় একাদশ শতাব্দির প্রথমার্ধকে "বিরুনি যুগ" বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর দৃষ্টিতে এই যুগটি বিরুনি এবং সে যুগের অপর বিখ্যাত ইরানী মনীষী ইবনে সিনার কর্মতৎপরতার কারণে ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতি উৎকর্ষের চরম চূড়ায় আরোহণ করেছিল।
আবু রেইহান ভূগোল বিষয়ে ব্যাপক অবদান রেখেছেন। মুসলমানদের ভূগোলে তাঁর এই অবদান দু'দিক থেকে লক্ষণীয়। প্রথমত তিনি তাঁর সমকাল পর্যন্ত ভূগোল বিষয়ক সকল জ্ঞান বা তথ্যেরই সমালোচনামূলক সংক্ষিপ্তসার বা সিনোপসিস লিখেছেন। অপরদিকে জ্যোতির্বিদ্যা এবং গণিতের ওপর অসাধারণ দক্ষতা থাকায় কয়েকটি শহরের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যগুলো এবং তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো তিনি পৃথিবীর ভৌগোলিক প্রস্থের পরিমাপ করেছিলেন। এই কাজটি করে আবু রেইহান তাঁর সমকাল পর্যন্ত ভূগোল বিষয়ক বিজ্ঞানের ইতিহাসে পরিমাপের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। জ্ঞান ও বিজ্ঞানের জগতে মহান এই মনীষী মূল্যবান বহু বই উপহার দিয়ে গেছেন। Ta'rikh al-Hind, The Mas'udi Canon, Understanding Astrology ইত্যাদি তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ। ভৌগোলিক দৈর্ঘ প্রস্থ পরিমাপ করা তাঁর অনন্য সাধারণ একটি কাজ। কেবলা নির্ধারণ করার বিভিন্ন পদ্ধতিও তাঁর অপর একটি অবদান।
আবুল ভাফায়ি বুযজানি'র সহায়তায় আলবিরুনি বাগদাদ এবং প্রাচীন উরগাঞ্জ তথা পুরোণো খাওয়ারেযমের দৈর্ঘ নিয়ে বিতর্ক বা মতানৈক্যের অবসান ঘটান। তুরস্কের ইসলাম বিশেষজ্ঞ ও ইতিহাসবিদ ফুয়াদ সাযগিন ইসলামী ভূগোলের বৈজ্ঞানিক ইতিহাসে সর্বপ্রথম মনীষী হিসেবে অভিহিত করেছেন। জনাব আলবিরুনি আফগানিস্তানের কেন্দ্রিয় শহর গাজনি এবং বাগদাদের ভৌগোলিক দৈর্ঘ নিয়ে মতানৈক্যের অবসান ঘটান। তিনি ত্রিকোণমিতি এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাব-নিকাশ কষে এর দৈর্ঘ্য নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। কেবলার দিক নির্ণয়ের ক্ষেত্রেও তিনি এই ত্রিকোণমিতির সাহায্য নেন যার শেকড় টলেমিসহ তাঁর পূর্ববর্তী অন্যান্য লেখকের লেখায় প্রোথিত ছিল। বিরুনিই সর্বপ্রথম কোনো প্রাচ্য মনীষী যিনি বলেছিলেন পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে। তিনি অবশ্য তাঁর পূর্ববর্তী জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতবিশ্বাসগুলো পর্যালোচনা করার পর এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন।
"তাহদিদে নেহায়াতুল আমাকিন" নামের আরেক গুরুত্বপূর্ণ বই রয়েছে তাঁর। এ বইতে তিনি বিশ্ব সৃষ্টি বিষয়ে আলোচনা করেছেন। কীভাবে ভূমির বিভিন্ন স্তর সৃষ্টি হলো, শুষ্কতা এবং সমুদ্রগুলোর সৃষ্টি বিষয়েও কথা বলেছেন এ বইতে। শহরগুলোর ভৌগোলিক দৈর্ঘ প্রস্থ নির্ধারণ করা এবং দুই শহরের মধ্যকার দৈর্ঘ নিয়ে মতপার্থক্য সম্পর্কেও কথা বলেছেন। এ সম্পর্কে বিরুনি বলেছেনঃ আমার উদ্দেশ্য হলো পথগুলোকে সামগ্রিকভাবে পরিচয় করাবো ভূ-পৃষ্ঠের বিভিন্ন কৌণিক দৈর্ঘ নির্ধারণ করা এবং একটি শহর অপর একটি শহর থেকে ঠিক কোন দিকে অবস্থিত তা সুস্পষ্টভাবে নির্ণয় করা। পর্যবেক্ষণমূলক জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসের দৃষ্টিতে এ বইটির ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে। কারণ হলো এ বইটির বিভিন্ন অধ্যায়ে ইসলামী যুগের পর্যবেক্ষকগণ তাঁদের পর্যবেক্ষণের ইতিহাস এবং স্থানের বর্ণনা দিয়েছেন।
"আলবাকিয়ার সৃষ্টিকর্ম" নামক বইতে দিনপঞ্জী এবং ফার্সি, আরবি, গ্রিক ও হিব্রু সময় গণনা নিয়ে পর্যালোচনা করেছেন এবং জনগণের কৃষ্টি-কালচারের ব্যাখ্যাসহ তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাপঞ্জি নিয়ে লিখেছেন। এ বইতে তিনি আরো একটি কাজ করেছেন তাহলো জনগণের মাঝে প্রচলিত বিভিন্ন কুসংস্কার ও বিশ্বাসের অযৌক্তিকতাগুলো তুলে ধরেছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- সে সময় জনগণ বলাবলি করতো যে প্রতি বছর ৬ই জানুয়ারিতে লবণাক্ত পানিগুলো এক ঘণ্টার জন্যে মিষ্টি পানিতে পরিণত হয়ে যায়। বিরুনি এই বিশ্বাস খণ্ডণ করে লিখেছেনঃ এটা একটা অসম্ভব ব্যাপার। পানির বৈশিষ্ট্য নির্ভর করে কেবল সেই ভূখণ্ডের ওপর যার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত কিংবা সঞ্চিত হয়ে আছে।
ভারতের ইতিহাস নামক বইতে তিনি তৎকালীন ভারতের ঐতিহ্য, দর্শন এবং সামাজিক পরিস্থিতির ওপর বিস্তারিতভাবে লিখেছেন,যাকে বলা যেতে পারে একটি সামগ্রিক বই। এ বইটি লেখা তার জন্যে যথেষ্ট কষ্টসাধ্য ছিল। এ বইতেও তিনি ভারতের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।'অ্যাস্ট্রোলেইব শিল্প' নামে অপর একটি বইতে তিনি গ্রহ-নক্ষত্রের উচ্চতা এবং গতিবিধি নির্ণায়ক যন্ত্র অ্যাস্ট্রোলেইব তৈরির কৌশলের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। এ বইতে অ্যাস্ট্রোলেইব তৈরির সার্বিক দিক পর্যালোচনা করার চেষ্টা করেছেন। আলবিরুনি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত জ্ঞানার্জন এবং মানবতার সেবায় নিজের জ্ঞানকে কাজে লাগাতে ব্যস্ত ছিলেন। আশি বছর বয়সে তিনি চিকিৎসা বিষয়ক বই লিখেছেন। ঔষধবিজ্ঞান বিষয়ক ঐ বইতে তিনি ঔষধের গুণাগুণ, ঘ্রাণ এবং ধরণ নিয়ে কথা বলেছেন।#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবু সাঈদ/ ২৭