মে ২৪, ২০১৮ ১৮:৫৯ Asia/Dhaka

কুরআনের আলো অনুষ্ঠানের আজকের পর্বে আমরা সূরা আল আহযাবের ৯ থেকে ১২ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা তুলে ধরব। এই সূরার ৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,

كُمْ إِذْ جَاءَتْكُمْ جُنُودٌ فَأَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ رِيحًا وَجُنُودًا لَمْ تَرَوْهَا وَكَانَ اللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرًا (9)

“হে মুমিনগণ! তোমরা তোমাদের প্রতি আল্লাহর নেয়ামতের কথা স্মরণ কর, যখন শত্রুবাহিনী তোমাদের নিকটবর্তী হয়েছিল, অতঃপর আমি তাদের বিরুদ্ধে (প্রচণ্ড) ঝঞ্ঝাবায়ু এবং এমন সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেছিলাম, যাদেরকে তোমরা দেখতে পাচ্ছিলে না। তোমরা যা কর, আল্লাহ তা দেখেন।” (৩৩:৯)

এই আয়াত এবং এর পরবর্তী ১৬টি আয়াতে হিজরি পঞ্চম সালে সংঘটিত আহযাব যুদ্ধের বর্ণনা এসেছে। এই যুদ্ধে ইসলাম ও মুসলমানদেরকে চিরতরে বিনাশ করে দেয়ার লক্ষ্যে ইসলাম বিরোধী সব দল ও গোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। মদিনার ইহুদি ও মক্কার মুশরিকরা ইসলাম বিরোধী অন্যান্য গোত্র-উপগোত্রের সঙ্গে একত্রিত হয়ে বিশাল সৈন্যবাহিনী তৈরি করেছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, রাসূলুল্লাহ (সা.)কে হত্যা করার পর নও মুসলিমদের ওপর গণহত্যা চালানো। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছায় ওই যুদ্ধে মুসলমানরা বিজয়ী হয় এবং কাফের ও মুশরিকরা দুর্বল ও হতাশ হয়ে পড়ে।

এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, ইসলাম বিরোধী চক্র মদীনায় আক্রমণ করতে আসবে এমন খবর আল্লাহর রাসূল আগেই জেনে গিয়েছিলেন। এ অবস্থায় শত্রুকে প্রতিহত করার উপায় নিয়ে আলোচনার জন্য তিনি সব মুসলমানকে মসজিদে ডেকে পাঠান। বিশিষ্ট সাহাবী সালমান ফারসির প্রস্তাবে শত্রুকে মদীনা শহরে প্রবেশ করতে না দেয়ার লক্ষ্যে শহরের চারপাশে খন্দক বা পরিখা খনন করা হয়। এ কারণে এই যুদ্ধকে খন্দকের যুদ্ধ নামেও অভিহিত করা হয়। আহযাব যুদ্ধ সম্পর্কিত প্রথম এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদেরকে বলছেন, তারা যেন শত্রুদের বিরুদ্ধে তাঁর সাহায্যের কথা স্মরণ করে এবং কখনোই দুর্বলতা, ভয় বা হতাশা যেন তাদেরকে গ্রাস না করে। তারা যেন স্মরণ রাখে যে, আহযাবের যুদ্ধে শত্রুবাহিনীর সেনাসংখ্যা মুসলমানদের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ প্রচণ্ড ঘুর্ণিঝড় পাঠিয়ে তাদের শিবির তছনছ করে দেন এবং আসমান থেকে ফেরেশতা পাঠিয়ে মুসলমানদের মনোবল শক্তিশালী করেন যাতে তারা শত্রুদের বিশাল সংখ্যা দেখে ভয় না পায়। 

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১. জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঐশী সাহায্য পাওয়ার শর্ত হচ্ছে আল্লাহর প্রতি ঈমান, চেষ্টা ও সংগ্রাম।

২. আল্লাহর কাছ থেকে অতীতে পাওয়া নেয়ামত ও সাহায্য স্মরণ করলে বর্তমানের সমস্যাসঙ্কুল পরিস্থিতিতে ধৈর্য ধরার অনুপ্রেরণা পাওয়া যায়।

৩. ঈমানদারদের জন্য আল্লাহ তায়ালার সাহায্যের হাত সব সময় প্রশস্ত থাকে। তিনি যেমন ঝড়-ঝঞ্ঝার মতো প্রাকৃতিক ঘটনা ঘটিয়ে তাদেরকে সাহায্য করেন তেমনি ফেরেশতাদের মতো প্রকৃতির ঊর্ধ্বের সাহায্য পাঠিয়েও তাদেরকে মদদ দেন।

৪. আল্লাহ আমাদের সব কাজ দেখছেন বলে বিশ্বাস করলে একদিকে যেমন আমরা নিজেদের প্রতিটি আচরণে সতর্ক থাকতে পারব তেমনি আল্লাহর রাস্তায় বেশি বেশি চেষ্টা ও পরিশ্রম করার জন্য অনুপ্রেরণা পাব।

সূরা আহযাবের ১০ ও ১১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

إِذْ جَاءُوكُمْ مِنْ فَوْقِكُمْ وَمِنْ أَسْفَلَ مِنْكُمْ وَإِذْ زَاغَتِ الْأَبْصَارُ وَبَلَغَتِ الْقُلُوبُ الْحَنَاجِرَ وَتَظُنُّونَ بِاللَّهِ الظُّنُونَا (10) هُنَالِكَ ابْتُلِيَ الْمُؤْمِنُونَ وَزُلْزِلُوا زِلْزَالًا شَدِيدًا (11)

“যখন তারা তোমাদের নিকটবর্তী হয়েছিল উচ্চ ভূমি ও নিম্নভূমি থেকে এবং যখন (আতঙ্কে) তোমাদের দৃষ্টিভ্রম হচ্ছিল, প্রাণ কন্ঠাগত হয়েছিল এবং তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে নানা (বিরূপ) ধারণা পোষণ করতে শুরু করছিলে।” (৩৩:১০)

“সে সময়ে মুমিনগণ পরীক্ষিত হয়েছিল এবং ভীষণভাবে প্রকম্পিত হচ্ছিল।” (৩৩:১১)

এই দুই আয়াতে আহযাব যুদ্ধের ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা তুলে ধরে বলা হচ্ছে: ওই যুদ্ধে কাফের বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা এত বেশি ছিল যে, তারা চারদিক দিয়ে মদীনাকে ঘেরাও করে ফেলেছিল। যেকোনো মুহূর্তে তারা শহর আক্রমণ করে গণহত্যা ও লুণ্ঠন শুরু করে দিতে পারত। এ অবস্থায় খুব স্বাভাবিকভাবেই মদীনার অধিবাসীদের মনে আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল এবং তাদের চোখেমুখে সে আতঙ্ক ফুটে উঠেছিল। তাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়েছিল এবং প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর প্রহর গুণছিল।

প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে যাদের ঈমান ছিল না তারা মনে করেছিল, কাফেরদের ওপর মুসলমানদের বিজয় বা মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের বিজয়ের যে প্রতিশ্রুতি আল্লাহর রাসূল দিয়েছেন তা সত্য নয়। তারা আরো মনে করিছিল, কাফেরদের আক্রমণে এখনই মুসলিম বাহিনী পরাজিত হবে এবং ইসলামের আলো চিরতরে নিভে যাবে।

আসলে এই পরিস্থিতি আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকেই তৈরি করা হয়েছিল যাতে তিনি এ বিষয়টি পরীক্ষা করতে পারেন যে, কারা তাঁর প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করে নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করার জন্য প্রস্তুত রয়েছে আর কারা শত্রুদের অধিক সংখ্যা দেখে ভয় পেয়ে গেছে এবং তাদের বিশ্বাসে ফাটল ধরেছে।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১. মুসলমানদেরকে শত্রুদের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে সব সময় সতর্ক থাকতে হবে। মুসলিম ভূখণ্ডের সীমান্ত রক্ষায় তাদের প্রস্তুতিতে যেন কখনো ভাটা না পড়ে।

২. মহান আল্লাহর পরীক্ষার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে যুদ্ধ বা জিহাদ। ঈমান দুর্বল থাকলে এ সময় অনেকের আচরণে তা প্রকাশ পায় এবং আল্লাহর কাছে ধরা পড়ে যায়।

৩. কঠিন পরিস্থিতিতে প্রকৃত ঈমানদারকে ঈমানের মিথ্যা দাবিদারদের থেকে আলাদা করে ফেলা যায়। কারণ, এরকম পরিস্থিতিতে নিজের অবস্থানে অটল থাকার জন্য শক্তিশালী ও খাঁটি ঈমানের প্রয়োজন।

সূরা আহযাবের ১২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

وَإِذْ يَقُولُ الْمُنَافِقُونَ وَالَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ مَا وَعَدَنَا اللَّهُ وَرَسُولُهُ إِلَّا غُرُورًا (12)

“এবং যখন মুনাফিক ও যাদের অন্তরে ব্যাধি ছিল তারা বলছিল, আমাদেরকে প্রদত্ত আল্লাহ ও রসূলের প্রতিশ্রুতি প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়।” (৩৩:১২)

আগের দুই আয়াতে আহযাবের যুদ্ধে মুমিনদের কারো কারো বিশ্বাসের দুর্বলতা ও দোদুল্যমনতার কথা জানিয়ে দিয়েছেন। এই আয়াতে তাদের এই দোদুল্যমনতার কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে বলা হচ্ছে: এদের মধ্যে একদল ছিল মুনাফিক। তারা বাহ্যিকভাবে ঈমান আনার দাবি করলেও অন্তর থেকে ঈমান আনেনি। আরেকটি দলের ঈমান ছিল দুর্বল। দুনিয়াপ্রীতি এবং দুনিয়ার ভোগবিলাসের প্রতি আকর্ষণ তাদের জিহাদে যাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তারা শুধু নিজেরাই যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে যায়নি সেইসঙ্গে অন্যদেরকেও পালিয়ে যেতে উস্কানি দিচ্ছিল। তারা অন্যদের বলছিল, রাসূল আমাদেরকে বিজয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন।  আসলে আমরা জয়ী হতে পারব না।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় কয়েকটি বিষয় হচ্ছে:

১. নিফাক বা কপট চরিত্র সব সময় মুসলিম সমাজের জন্য হুমকি ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। এই হুমকি শনাক্ত করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।

২. মুনাফিকরা মুসলিম সমাজকে ভেতর থেকেই দুর্বল ও হতাশ করে ফেলে। এর ফলে মুসলিম সমাজ শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদ করার মানসিকতা হারিয়ে ফেলে।

৩. বিশ্বনবী (সা.)’র সাহাবীদের সবার ধর্মীয় বিশ্বাস একরকম ছিল না।  তাদের কারো ঈমান ছিল শক্তিশালী এবং কারো কারো অন্তরে নিফাক ও কপটতা ছিল যা এই আয়াতে স্পষ্ট হয়েছে।#