সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৮ ১৭:২১ Asia/Dhaka

কুরআনের আলো অনুষ্ঠানের আজকের পর্বে সূরা আল আহযাবের ৬৯ থেকে ৭৩ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ৬৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ آَذَوْا مُوسَى فَبَرَّأَهُ اللَّهُ مِمَّا قَالُوا وَكَانَ عِنْدَ اللَّهِ وَجِيهًا (69)

“হে মুমিনগণ! মূসাকে যারা কষ্ট দিয়েছে, তোমরা তাদের মত হয়ো না। তারা তার সম্পর্কে যা বলত, আল্লাহ তা থেকে তাঁকে নির্দোষ প্রমাণ করেছিলেন। তিনি আল্লাহর কাছে ছিলেন মর্যাদাবান।” (৩৩:৬৯)

এই সূরার ৫৭ নম্বর আয়াতে মুনাফিকদের পক্ষ থেকে আল্লাহর রাসূলকে কষ্ট দেয়ার কথা বলা হয়েছিল। মদীনায় বসবাসকারী ইহুদিদের কাছ থেকে মুসলমানরা শুনেছিলেন, হযরত মূসা (আ.)-এর জামানার লোকজন তার প্রতি মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে তাঁকে কষ্ট দিয়েছিল। এসব অপবাদ তৈরির পেছনে কারুন ও ফেরাউনের মতো খোদাদ্রোহী জালেমদের প্রধান ভূমিকা ছিল।

আর এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ঈমানদার ব্যক্তিদের উদ্দেশ করে বলছেন: তোমরা হযরত মূসা সম্পর্কে ইহুদিদের কাছ থেকে যা শুনেছ তা অপরের কাছে বলাবলি করে গুজব রটিও না। কারণ, আল্লাহ নিজে তাঁর রাসূলের নির্দোষ ও পবিত্র থাকার সাক্ষ্য দিচ্ছেন। যিনি আল্লাহর কাছে সম্মানিত তার সম্পর্কে অবমাননাকর কথা বলো না।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

১. গুজব রটনা ও অপবাদ আরোপ করে ধর্মীয় নেতাদের চরিত্র হনন করা ইসলামের শত্রুদের একটি কূটকৌশল। এ ব্যাপারে মুসলমানদের সতর্ক থাকতে হবে।

২. মহান আল্লাহর পাশাপাশি তাঁর সব নবী-রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা এবং তাদের নিষ্পাপ থাকার সাক্ষ্য দেয়া ঈমানের গুরুত্বপূর্ণ দাবি।

সূরা আহযাবের ৭০ ও ৭১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَقُولُوا قَوْلًا سَدِيدًا (70) يُصْلِحْ لَكُمْ أَعْمَالَكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ فَازَ فَوْزًا عَظِيمًا (71)

“হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্য বলায় অবিচল থেকো।” (৩৩:৭০)

“(এর ফলে) তিনি তোমাদের আমল-আচরণ সংশোধন করবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করবেন। এবং যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করে, নিঃসন্দেহে সে মহা সাফল্য অর্জন করেছে।” (৩৩:৭১)

আগের আয়াতে মিথ্যা ও কষ্টদায়ক কথাবার্তা বলা থেকে মুমিন ব্যক্তিদের বিরত থাকার নির্দেশ জারি করার পর এ আয়াতে বলা হচ্ছে: কথা বলার সময় সাবধান হতে হবে এবং যে বক্তব্যের সত্যতা তোমার কাছে প্রমাণিত হয়নি তা বলবে না। বাস্তবতার সঙ্গে হুবহু মিল রেখে কথা বলবে। কেউ যেন তোমার বক্তব্যকে ভুল প্রমাণ করতে না পারে। সীসা ঢালা প্রাচীরের মতো অবিচল ও অটল প্রত্যয়ে কথা বলবে যাতে পরিবার বা সমাজের  কোনো ক্ষতি না হয়।

যদি সব মুমিন ব্যক্তি এ নির্দেশ পালন করে কথা বলে এবং অন্যের ব্যাপারে সংশয়, সন্দেহ ও ভুল ধারনাবশত বক্তব্য দেয়া থেকে বিরত থাকে তাহলে সমাজের বেশিরভাগ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এবং নতুন করে কোনো সংকট তৈরি হবে না। যারা উল্টাপাল্টা ও দ্ব্যার্থবোধক কথা বলা বন্ধ করে দেবে আল্লাহ তায়ালা তাদের গুনাহ ক্ষমা করার পাশাপাশি তাদের কর্মকাণ্ড সংশোধন করে দেবেন।

এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১. ঈমানের পূর্বশর্ত তাকওয়া এবং তাকওয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে সত্য বলায় অবিচল থাকা।

২. বক্তব্য সুন্দর হওয়া যথেষ্ট নয় বরং তা হতে হবে বাস্তবসম্মত ও দ্ব্যর্থবোধক দোষ থেকে মুক্ত।

৩. কেউ যদি তার সামর্থ্য অনুযায়ী তাকওয়া অবলম্বন করে তাহলে আল্লাহ তার পাপ ক্ষমা করে তার চলার পথ সুন্দর করে দেন।

সূরা আহযাবের শেষ দুই আয়াত অর্থাৎ ৭২ ও ৭৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

  إِنَّا عَرَضْنَا الْأَمَانَةَ عَلَى السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَالْجِبَالِ فَأَبَيْنَ أَنْ يَحْمِلْنَهَا وَأَشْفَقْنَ مِنْهَا وَحَمَلَهَا الْإِنْسَانُ إِنَّهُ كَانَ ظَلُومًا جَهُولًا (72) لِيُعَذِّبَ اللَّهُ الْمُنَافِقِينَ وَالْمُنَافِقَاتِ وَالْمُشْرِكِينَ وَالْمُشْرِكَاتِ وَيَتُوبَ اللَّهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَحِيمًا (73)

“আমি আকাশ, পৃথিবী ও পর্বতমালার সামনে এই (ঐশী) আমানত পেশ করেছিলাম, অতঃপর তারা একে বহন করতে অস্বীকার করল এবং এতে ভীত হল; কিন্তু মানুষ তা কাঁধে তুলে নিল। নিশ্চয় সে (আমানত রক্ষা করার ক্ষেত্রে) বড় ধরনের জালেম ও অজ্ঞ।” (৩৩:৭২)     

“যাতে আল্লাহ মুনাফিক পুরুষ ও নারী এবং মুশরিক পুরুষ ও নারীদেরকে (আমানতের খেয়ানত করার জন্য) শাস্তি দেন এবং (আমানত রক্ষা করতে গিয়ে ভুল করার কারণে) মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের তওবা কবুল করেন।  আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (৩৩:৭৩)

সূরা আহযাবের শেষ দুই আয়াতে আমানত গ্রহণের দিক দিয়ে অন্যান্য সৃষ্টির তুলনায় মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। অন্য কোনো সৃষ্টি যে আমানত গ্রহণ করতে পারেনি মানুষ নামক সৃষ্টি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহে সে আমানত গ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করেছে। এখানে আমানত বলতে সেই রুহ বা আত্মাকে বোঝানো হয়েছে যা আল্লাহ শুধু মানুষকে দিয়েছেন অন্য কাউকে নয়। এই রুহ হচ্ছে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির উৎস যা দিয়ে সে যা ইচ্ছা তা করার ক্ষমতা রাখে এবং দৃঢ় ইচ্ছা থাকলে পরিপূর্ণতায় পৌঁছাতে পারে। কিন্তু প্রাণীজগত ও উদ্ভিদের প্রাণ থাকা সত্ত্বেও তাদের এই ক্ষমতা নেই। কাজেই আল্লাহর দেয়া এই নেয়ামতকে আল্লাহর নির্দেশিত পথে পরিচালিত করাই হচ্ছে আমানত রক্ষা করা। এর অন্যথায় আমানতের খেয়ানত হয়ে যাবে। মানুষকে আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী এমন কাজ করতে হবে যাতে নিজের ও সমাজের কল্যাণ হয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বেশিরভাগ মানুষ কুফ্‌র ও নিফাকের পথ অবলম্বন করে খোদাদ্রোহিতার পথ বেছে নেয় এবং এই আমানতের খেয়ানত করে।

অন্যদিকে মুমিন ব্যক্তিরা এই আমানত সম্পর্কে জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় নফসের কুমন্ত্রণায় আল্লাহর ইচ্ছার পরিপন্থি কাজ করে বসে। কাজেই দেখা যাচ্ছে, একদল অজ্ঞতার কারণে এবং আরেকদল জুলুম ও অন্যায়ের কারণে আল্লাহর দেয়া আমানতকে সঠিক পথে ব্যবহার করেনি। অন্যদিকে আরেকদল উদাসিনতার কারণে আমানত রক্ষা করার ক্ষেত্রে গাফিলতি করেছে। স্বাভাবিকভাবেই জালিমরা আমানতের খেয়ানত করার শাস্তি পাবে এবং গাফিলতাকারীরা তওবা করলে আল্লাহ তায়ালার রহমত ও ক্ষমা লাভ করবে।

এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১. আল্লাহর দেয়া আমানত সঠিক পথে ব্যবহার করা মানুষের কর্তব্য।

২. ইসলামের পরিভাষায় জুলুম শুধু অন্যের বিরুদ্ধে অত্যাচার করাকে বোঝায় না। আল্লাহর দেয়া অনুগ্রহগুলোকে সঠিকপথে ব্যবহার না করলে সেটি হচ্ছে সবচেয়ে বড় জুলুম। #

(সূরা আল আহযাব সমাপ্ত)