ঐশী দিশারী (পর্ব ২৩): "আমার নিকট সবচেয়ে যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি হচ্ছে আলী'" : মহানবী
গত আসরে আমরা ঐতিহাসিক গাদিরে খোমের ঘটনা বর্ণনা করেছি যেখানে হযরত আলী (আ.)কে আল্লাহর রাসূলের পর মুসলিম উম্মাহর অভিভাবক ও ইমাম ঘোষণা করা হয়। এরপর রাসূলুল্লাহ (সা.) গাদিরে খোমে যে গুরুত্বপূর্ণ খুতবা দিয়েছিলেন তা বর্ণনা করেছি। আজকের আসরে আমরা গাদিরে খোমের আরো কিছু ঘটনা নিয়ে আলোচনা করব।
গাদিরে খোমের ঐতিহাসিক ঘটনার দিকে গভীরভাবে দৃষ্টি দিলে বোঝা যাবে এটি শুধু দৈবক্রমে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা ছিল না বরং এটি ছিল একটি দীর্ঘ চলমান প্রক্রিয়ার শুরু। কারণ, মানব জাতির ইমামত ও নেতৃত্বের ফয়সালা হয়েছিল ওই ঘটনায়। রাসূলের ওফাতের পর যদি হযরত আলী (আ.) সমাজের নেতৃত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারতেন তাহলে শুধু মুসলিম উম্মাহ নয় সেইসঙ্গে গোটা বিশ্ব সমাজ সিরাতুল মুস্তাকিমের পথে পরিচালিত হয়ে সৌভাগ্য ও পূর্ণতার পথে অগ্রসর হতে পারত।
আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূলের কাছে হযরত আলী (আ.)-এর মর্যাদা এতটা উন্নত ছিল যে, নবীজী (সা.) গাদিরে খোমের খুতবায় বলেন: হে লোকসকল জেনে রাখো, মহান আল্লাহ আলী ইবনে আবি তালেবকে তোমাদের সবার চেয়ে বেশি মর্যাদা দান করেছেন। যতদিন সৃষ্টিজগত থাকবে ততদিন আমার পরে সবচেয়ে যোগ্য ও মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি থাকবে আলী। হে জনগণ! তার নির্দেশ অমান্য করো না এবং তার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না। কারণ সে তোমাদেরকে সত্য পথে পরিচালিত করবে এবং মিথ্যা থেকে দূরে রাখবে। আলী ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম ব্যক্তি এবং আমার প্রতি ঈমান আনার ক্ষেত্রে তাকে কেউ অতিক্রম করতে পারেনি।

হযরত আলী (আ.)-এর ব্যাপারে এসব উন্নত গুণাবলী বর্ণনা করার পর রাসূলুল্লাহ (সা.) একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন: এসব উন্নত যোগ্যতা ও গুণাবলী মহান আল্লাহই আলীকে দান করেছেন এবং তিনিই তাকে ইমামত ও নেতৃত্বের পদে অধিষ্ঠিত করেছেন। বিশ্বনবীর এ ভাষণ থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায়, এই মহামানবের পর হযরত আলী (আ.)-এর যোগ্যতা ও গুণাবলীর সমকক্ষ আর কেউ ছিল না। এর চেয়েও বড় কথা ইমামতের মতো একটি মর্যাদাপূর্ণ পদের দায়িত্ব কে গ্রহণ করবেন তা আল্লাহর পক্ষ থেকেই নির্ধারিত হয়। অন্য কারো পক্ষে এখানে কিছুই করার নেই এবং কেউ যদি তেমন কিছু করে তাহলে তা হবে আল্লাহর ইচ্ছার পরিপন্থী কাজ।
নবীজী (সা.) গাদিরে খোমের খুতবার অন্য অংশে ইমামতের দায়িত্ব গ্রহণকারী ব্যক্তির ‘এলেম ও তাকওয়া’ বা জ্ঞান ও খোদাভীতির কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন: হে লোকসকল! জেনে রেখো, এমন কোনো জ্ঞান নেই যা মহান আল্লাহ আমাকে শিক্ষা দেননি। আর আমি যা শিখেছি তার সবই আমি আলী ও তার মুত্তাকি সন্তানদের শিখিয়ে দিয়েছি। সূরা ইয়াসিনে যে ‘ইমামুম মুবিন’র কথা বলা হয়েছে সেই ইমাম হচ্ছে আলী।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর এই খুতবা থেকে একথাই প্রতীয়মান হয় যে, ইমামতের জ্ঞান অর্জন করা যায় না বরং তা আল্লাহ প্রদত্ত। নবী-রাসূল ও ইমামগণ ছাড়া আর কাউকে এই জ্ঞান দান করা হয়নি। এ ছাড়াও এই জ্ঞান অর্জনের জন্য সব ধরনের গোনাহ’র কাজ থেকে বেঁচে থাকা ও নিষ্পাপ হওয়া জরুরি।
বিশ্বনবী (সা.) গাদিরে খোমের খুতবায় আরো বলেন: হে লোকসকল! জেনে রেখো, তোমাদের মধ্যে আলীই আমাকে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছে এবং তোমাদের মধ্যে আমার ঘনিষ্ঠতম, নিকটতম এবং সবচেয়ে যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি হচ্ছে আলী। আমি এবং আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট। হযরত আলী (আ.)-এর মর্যাদা নিয়ে এত সুস্পষ্ট ভাষায় বক্তব্য রাখার পরও যাতে ক্ষমতালিপ্সু কোনো ব্যক্তি এর ভুল ব্যাখ্যা করতে না পারে সেজন্য তিনি আরো পরিষ্কার করে বলেন, নবী-রাসূলদের উত্তরাধীকারীরা যেমন তাদের বংশধরদের মধ্য থেকে হতেন তেমনি আমার পরে ইমামতের দায়িত্ব গ্রহণ করবে আলীর হাত ধরে আমার বংশধরগণ। ঠিক এ সময় ওহীর ফেরেশতা নবীজীর কাছে আসেন এবং সূরা মায়েদার ৩ নম্বর আয়াতের অংশবিশেষ নাজিল হয়; যেখানে বলা হয়েছে: “আজ কাফেররা তোমাদের দ্বীন থেকে নিরাশ হয়ে গেছে। অতএব তাদেরকে ভয় করো না বরং আমাকে ভয় কর। আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্নাঙ্গ করে দিলাম,তোমাদের প্রতি আমার নেয়ামত সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে মনোনিত করলাম।”

অনেক মুফাসসির গাদিরে খোমের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পবিত্র কুরআনের এই বক্তব্যের ব্যাখ্যায় বলেছেন, নবী-রাসূলদের আন্দোলনকে অব্যাহত রাখা এবং ইসলাম ও কুরআন হেফাজতের লক্ষ্যে হযরত আলী (আ.) যদি নবীজী (সা.)-এর স্থলাভিষিক্ত মনোনীত না হতেন তাহলে ইসলাম অপূর্ণাঙ্গ থেকে যেত। কিন্তু আল্লাহর নির্দেশে রাসূলুল্লাহ (সা.) এই মনোনয়ন দেয়ার পর আল্লাহ তাঁর নেয়ামতকে শুধু মুসলিম উম্মাহ নয় সেইসঙ্গে গোটা মানবজাতির জন্য পূর্ণাঙ্গ করে দিয়েছেন। এই ঘটনায় আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং যেসব কাফের ভেবেছিল রাসূলের মৃত্যুর পর ইসলামের আলো চিরতরে নিভে যাবে তারা হতাশ হয়েছে। সূরা তওবায় যেমনটি নবীজীকে সুসংবাদ দেয়া হয়েছে এই বলে যে, “তিনিই প্রেরণ করেছেন আপন রাসূলকে হেদায়েত ও সত্য দ্বীন সহকারে,যেন এ দ্বীনকে অপরাপর দ্বীনের উপর জয়যুক্ত করেন,যদিও মুশরিকরা তা অপ্রীতিকর মনে করে।”
বিশ্বনবী (সা.)-এর খুতবার পর তাঁর নির্দেশে সমবেত জনতা এক এক করে হযরত আলী (আ.)-এর সঙ্গে বায়াত করেন বা আনুগত্যের শপথ নেন। ওমর বিন খাত্তাব এ সময় আল্লাহর রাসূলের কাছে এসে আলী (আ.)কে ইমামতের দায়িত্ব প্রদান করায় নবীজীকে অভিনন্দন জানান। এই ঐতিহাসিক ঘটনার পর মুসলমানরা সন্তুষ্টচিত্তে যার যার গন্তব্যে যাত্রা করেন। তারা গাদিরে খোমের ঘটনার কথা মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র পৌঁছে দেন।
এদিকে এই আনন্দদায়ক ঘটনার কিছুদিন যেতে না যেতেই রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অসুস্থ হয়ে পড়ার খবর মদীনার ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়। নবীজীর অসুস্থতা ক্রমেই বাড়তে থাকে। বিশ্বনবী (সা.) মৃত্যুশয্যায় একথা উপলব্ধি করেন যে, গাদিরে খোমে ঘোষণা করা সত্ত্বেও হযরত আলীর বিরোধীরা তাঁর এ ঘোষণা পালন করতে অস্বীকৃতি জানাতে পারে। তাই তিনি হযরত আলী (আ.)-এর ইমামত, বেলায়েত ও স্থলাভিষিক্ত হওয়ার ঘোষণা লিখিত আকারে রেখে যাওয়ার জন্য কাগজ-কলম আনতে বলেন। কিন্তু এ সময় একদল লোক হৈ-হট্টগোল শুরু করার কারণে কেউ কাগজ-কলম আনতে পারেনি। এর মাধ্যমে আল্লাহর রাসূলের নির্দেশ অমান্য করার বীজ বপিত হয় যার ফল হয় মুসলিম উম্মাহর জন্য এক অন্ধকার ভবিষ্যত। এমন একদল মানুষ মুসলিম উম্মাহর দায়িত্ব গ্রহণ করেন যারা জ্ঞান ও মর্যাদার দিক দিয়ে আলী (আ.)-এর সমকক্ষ ছিলেন না।#
পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ/ ৮
খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন