ফেব্রুয়ারি ০৭, ২০১৯ ১৭:১১ Asia/Dhaka

এখন থেকে ৪০ বছর আগে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ'র একান্ত অনুগত সেবাদাস হিসেবে কুখ্যাত ইরানের শাহ সরকারের পতন ঘটে এবং দেশটিতে বিজয়ী হয় কিংবদন্তীতুল্য ইসলামী সংস্কারক ও পুনর্জাগরণের নকিব হযরত ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বাধীন দুনিয়া-কাঁপানো ইসলামী বিপ্লব।

এ বিপ্লবের ফলে ইরানে অবসান ঘটে সূদীর্ঘ প্রায় আড়াই হাজার বছরের রাজতান্ত্রিক শাসন-ব্যবস্থার! ইরানে স্বাধীনচেতা ও একটি গণমুখী ইসলামী শাসন-ব্যবস্থা চালু হওয়ায় আশপাশের আরব সেবাদাস সরকারগুলো এবং তাদের প্রভু ও এ অঞ্চলের তেল-সম্পদ লুটকারী পশ্চিমা শক্তিগুলো ও দখলদার ইহুদিবাদী ইসরাইলের নানা অবৈধ স্বার্থ হয় হুমকিগ্রস্ত। ফলে হারাম হয়ে যায় তাদের ঘুম। ইরানে ইসলামী বিপ্লব সফল হবার পর পরই তেহরানের বিপ্লবী সরকার তৎকালীন বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকায় ইরানি দূতাবাস এবং তেল রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের তিন সপ্তা'র মধ্যেই ইরান ইহুদিবাদী ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং তেহরানস্থ ইসরাইলি দূতাবাসকে ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থা বা পিএলও'র কাছে হস্তান্তর করা হয়। পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফাত ছিলেন ইসলামী ইরান সফর করতে-আসা প্রথম বিদেশী নেতা।  

বর্ণবাদী জালিম ইসরাইল ও দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের বিরুদ্ধে ইরানের ইসলামী বিপ্লবী সরকারের কঠোর পদক্ষেপ বিশ্বের দাম্ভিক পরাশক্তিগুলো ও তাদের স্থানীয় সেবাদাস সরকারগুলোকে মর্মাহত করে। ফলে এটা স্পষ্ট হয় ইরানে ক্ষমতাসীন হয়েছে ইসলামী নীতি ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী একটি সরকার। এটা প্রচলিত রাজনৈতিক অভিজাত নেতাদের মধ্যে ক্ষমতার পালাবদল বা প্রাসাদ-অভ্যুত্থানের মত কোনো নাম-সর্বস্ব বিপ্লব ছিল না। ইরানের ইসলামী বিপ্লব ছিল জালিম শক্তিগুলোর জন্য পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত, অভাবনীয়, অবিশ্বাস্য ও অদম্য গণ-জোয়ারকেন্দ্রীক বিপ্লব। এ বিপ্লবের নেতারা মার্কিন ও ব্রিটিশ আধিপত্যবাদ এবং মুসলমানদের প্রথম কেবলাসহ গোটা ফিলিস্তিন দখলকারী ইসরাইলের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন নির্ভয়ে। তারা ইসরাইলকে মুসলিম বিশ্বের ক্যান্সার বলে উল্লেখ করে থাকেন। ইসলামী বিপ্লবী ইরান গোটা ফিলিস্তিনকে মুক্ত করতে ফিলিস্তিনি সংগ্রামী দলগুলোকে সর্বোচ্চ সহায়তা দিয়ে আসছে। আর এ লক্ষ্যে গঠন করেছে লেবাননের হিজবুল্লাহ, সিরিয়া সরকার এবং ফিলিস্তিনের ইসলামী জিহাদ ও হামাসকে নিয়ে প্রতিরোধ-জোট।    

ইরানের ইসলামী বিপ্লবী সরকারের কাছ থেকে এতসব পদাঘাত ও মুষ্টাঘাত খেয়ে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জালিম শক্তিগুলো, ইসরাইল ও আরব রাজতান্ত্রিক আর স্বেরতান্ত্রিক সরকারগুলো ইরানের বিপ্লবী নেতৃবৃন্দ ও জাতির ওপর আরোপ করে একের পর এক শ্বাসরুদ্ধকর নিষেধাজ্ঞা, যুদ্ধ, প্রতি-বিপ্লবী পদক্ষেপ ও রাষ্ট্র-পরিচালিত সন্ত্রাস । প্রকৃত ইসলামী বিপ্লবী সরকারের সঙ্গে এ ধরনের শত্রুতা আসলেই স্বাভাবিক। সন্ত্রাসী বোমা হামলা চালিয়ে শহীদ করা হয় ইরানের শীর্ষ পর্যায়ের বেশ কয়েকজন বড় আলেম ও নেতাসহ বহু উচ্চ-পদস্থ কর্মকর্তাকে। পশ্চিমা সরকারগুলোর মদদপুষ্ট সন্ত্রাসী মুনাফিক দল এমকেও ইসলামী ইরানের ১২০০ জন বড় কর্মকর্তাকে শহীদ করেছে। এ ছাড়াও তারা ইরানের হাজার হাজার সাধারণ জনগণকে করেছে হতাহত। পশ্চিমাদের অস্ত্র ও পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের আরব রাজাদের অর্থ সাহায্য নিয়ে মার্কিন নির্দেশে ইরাকের সাদ্দাম সরকার ব্যর্থ আগ্রাসন চালায় ইরানে। ৮ বছর স্থায়ী এ যুদ্ধে শহীদ হয়েছে লাখ লাখ ইরানি।

মার্কিন সরকার ছাড়াও সৌদি সরকার ও ইসরাইল ইরানে বিনা উস্কানিতেই আগ্রাসন চালানোর হুমকি দিয়ে আসছে। তাদের অনুচররা হত্যা করেছে ইরানের কয়েকজন বড় পরমাণু বিজ্ঞানী। রাজপথে অশান্তি ও বিক্ষোভ সৃষ্টি করতে ভাড়াটে অনুচরদের লেলিয়ে দিচ্ছে। অথচ ইসলামী বিপ্লবী ইরান কোনো দেশে হামলা চালায়নি ও কোনো স্বাধীন দেশে হামলা চালানোর হুমকিও দেয়নি। এই ইসলামী ইরানকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলার জন্য আফগানিস্তান ও ইরাকে সেনা পাঠিয়েছে মার্কিন সরকার। ইসরাইলের পরমাণু হামলার হুমকি ও পারস্য উপসাগরে বিমান আর ক্ষেপণাস্ত্রবাহী মার্কিন রণতরীর হামলার আশঙ্কা মোকাবেলা করে আসছে তেহরান। ইরানে হামলার পরিবেশ সৃষ্টির জন্যই লেবানন ও সিরিয়ায় অস্থিতিশীলতা জিইয়ে রাখতে চায় পাশ্চাত্য।

মার্কিন সরকারের ১৬টি প্রধান গোয়েন্দা সংস্থা ও জাতীয় গোয়েন্দা বিষয়ক জরিপ সংস্থা এনআইই এবং জাতিসংঘের পরমাণু বিষয়ক নজরদারি সংস্থা আইএইএ সুনিশ্চিত নানা তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে বার বার বলে এসেছে যে ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে না; এমনকি দেশটির পরমাণু তৎপরতা কারো জন্যই সামরিক হুমকি নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশটির ওপর ইতিহাসের কঠোরতম নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দিয়েছে মার্কিন সরকার ও তার মিত্ররা পরমাণু বোমা তৈরির কথি প্রচেষ্টার অভিযোগে। ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া ও আফগানিস্তানসহ বিশ্বের নানা অঞ্চলে মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপের আসল উদ্দেশ্য হল এ অঞ্চলের জ্বালানি সম্পদসহ নানা সম্পদের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং ইহুদিবাদী ইসরাইলকে সুরক্ষা দেয়া। ইরান ও তার মিত্র শক্তিগুলোকে দুর্বল করার লক্ষ্যে পশ্চিমা শক্তিগুলো ও তাদের অনুগত সেবাদাস শাসকরা শিয়া-সুন্নি মতভেদকে দাঙ্গা ও অনৈক্যের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করছে। ইরানকে দুর্বল করার জন্যই পশ্চিমা শক্তিগুলো ও তাদের অনুগত সেবাদাস-চক্র সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চেয়েছে বহিরাগত ভাড়াটে সন্ত্রাসী ও উগ্র ওয়াহাবিদের ব্যবহার করে। কিন্তু তাদের এই মহাষড়যন্ত্রও ব্যর্থ হয়েছে। 

ইসলামী ইরান যদি আজই ইহুদিবাদী ইসরাইলের প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয় তাহলে পাশ্চাত্য আবারও ইরানের বর্তমান সরকারকে শাহের আমলের মতই বন্ধু বলে ঘোষণা করবে এবং অর্থনৈতিক নানা সুযোগ-সুবিধার দরজা খুলে দেবে।  কিন্তু আপোষহীন ইরান পশ্চিমাদের শত বাধা ও নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও নানা ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি ও সাফল্য অব্যাহত রেখেছে। ইরান ও তার মিত্র শক্তিগুলো বিশেষ করে সিরিয়া, হামাস ও হিজবুল্লাহকে নতজানু করতে ব্যর্থ হয়ে মার্কিন সরকার এখন পোল্যান্ডে ইরান বিরোধী আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠানের চেষ্টা করছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এই সম্মেলনে সুন্নি-আরব ন্যাটো জোট গঠনের ডাক দিয়েছেন যাতে ইরানের নেতৃত্বাধীন প্রতিরোধ ফ্রন্টকে দুর্বল করা যায়। এ ধরনের প্রচেষ্টা যে ব্যর্থ হবে তা অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হয়েছে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্য। ইরানের ইসলামী বিপ্লব যে বিশ্ব-ব্যবস্থায় নতুন সমীকরণ সৃষ্টি করেছে এবং তা বিগত ৪০ বছরে শত শত বছরের পশ্চিমা আধিপত্যবাদকে যে বিপর্যস্ত করতে পেরেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর এই বাস্তবতাকে মেনে নেয়া ছাড়া পাশ্চাত্যের জন্য ভবিষ্যত বিপর্যয় এড়ানোর কোনো পথ নেই বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন।#

পার্সটুডে/এমএএইচ/মো.আবুসাঈদ/৭