রমজান: খোদাপ্রেমের বসন্ত (পর্ব- ১৮)
মে'রাজ সংক্রান্ত এক বর্ণনায় এসেছে: মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবিব তথা সর্বশেষ রাসুলকে বললেন, হে আহমাদ! তুমি কি জান রোজার উত্তরাধিকার বা ফসল কী? মহানবী বললেন: না। মহান আল্লাহ বললেন, রোজার ফসল হল কম খাওয়া ও কম কথা বলা।
এরপর মহান আল্লাহ বললেন, নীরবতা বয়ে আনে প্রজ্ঞা বা হিকমাত, হিকমাত বয়ে আনে মা'রেফাত তথা আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় জ্ঞান, মা'রেফাতের ফলে আসে ইয়াকিন বা নিশ্চিত বিশ্বাস। আর যখন আমার দাস নিশ্চিত বিশ্বাসে উপনীত হয় তখন তার কোনো ভয় থাকে না- দিনগুলো বিপদ-সংকুল না আরামপ্রদ, সুখময় না যন্ত্রণাদায়ক-এসব নিয়ে তার কোনো দুশ্চিন্তাই থাকে না, কারণ এসবই তখন তার কাছে সমান বা একই রকম মনে হয়। আর এ অবস্থা হল আমার সন্তুষ্টিকে শিরোধার্য করা ব্যক্তিদের অবস্থা। যারা আমার সন্তুষ্টির আলোকে কাজ করে তারা নিশ্চিতভাবে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য অর্জন করে। এ বৈশিষ্ট্যগুলো হল: এমন কৃতজ্ঞতা যার মধ্যে নেই অজ্ঞতা, আমার এমন স্মরণ বা জিকর্ যাতে ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই এবং এমন এক বন্ধুত্ব যার মধ্যে কখনও সৃষ্টির প্রতি ভালবাসা আমার (আল্লাহর) প্রতি ভালবাসার চেয়ে অগ্রাধিকার পায় না।
উল্লেখ্য, মহান আল্লাহর সঙ্গে আধ্যাত্মিক সাক্ষাত এবং বেহেশত ও দোযখ দেখাসহ নবী-রাসুলদের সঙ্গে মহানবী (সা)'র সাক্ষাৎকে বলা হয় মে'রাজ বা উর্ধ্বজগতে ভ্রমণ। বলা হয় বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর কয়েকবার মে'রাজ হয়েছিল। এমনই এক মে'রাজে তিনি মুসলমানদের প্রথম কিবলা বায়তুল মুকাদ্দাসও পরিদর্শন করেছিলেন।
বিশ্বনবী (সা) বলেছেন, বহু মানুষই রোজা রাখে। কিন্তু রোজা থেকে তারা ক্ষুধা ও তৃষ্ণার কষ্ট সহ্য করা ছাড়া অন্য কিছুই পায় না। -আমরা যেন এই শ্রেণীর রোজাদারের চেয়ে উন্নত রোজাদার হতে পারি মহান আল্লাহ'র কাছে সেই তৌফিক কামনা করছি। উন্নত রোজাদার হতে হলে গিবত, মিথ্যাচার, অপবাদ ও চোগলখোরিসহ সব ধরনের পাপ থেকে মুক্ত থাকতে হবে।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন, সব কিছুরই একটি ভিত্তি রয়েছে, আর ইসলামের ভিত্তি হচ্ছে আমাদের প্রতি তথা আমার পবিত্র বংশধরদের (আহলে বাইতের) প্রতি ভালবাসা।

তিনি আরও বলেছেন, 'প্রত্যেক বিষয়েরই রয়েছে জাকাত। আর শরীর বা দেহের জাকাত হচ্ছে রোজা।'
পবিত্র রমজানের ফজিলত সম্পর্কে বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ জনাব মুহাম্মাদ মুনির হুসাইন খান বলেছেন:
নামায ও রোযায় মহানবীর ( সা: ) চক্ষুর শীতলতা: মহানবী ( সা: ) বলেছেন: মহান আল্লাহ নামায ও রোযার মধ্যে মহানবীর ( সা: ) চক্ষুর শীতলতা স্থাপন করেছেন । ( অর্থাৎ নামায ও রোযা হচ্ছে মহানবীর চোখের শীতলতা ও নয়নমণি।)
ইমাম সাদিক ( আঃ ) বলেছেন: যে ব্যক্তির পাপ রমযান মাসে ক্ষমা করা হয় নি আগামী রমযানের আগমন পর্যন্ত তার গুনাহ মাফ করা হবে না । তবে যে ব্যক্তি আরাফাহর দিবস ( ৯ জিল হজ্জ ) পাবে কেবল সে ব্যতীত ( অর্থাৎ রমযান মাসে গুনাহ মাফের তৌফিক যে পায় নি সে যদি আরাফাহর দিবসে মহান আল্লাহ পাকের কাছে স্বীয় গুনাহ মাফের জন্য প্রার্থনা এবং ইবাদত- বন্দেগী করে কেবল তার গুনাহ মাফ করা হবে।)
আজ ১৯ তম রমজান শুরু হতে যাচ্ছে। ৪০ হিজরির এই সময়ে তথা ১৮ ই রমজানের দিন শেষে ১৯ রমজানের ভোর বেলায় ইবনে মোলজেম নামের এক ধর্মান্ধ খারেজি ফজরের নামাজে সিজদারত আমীরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আঃ)'র মাথায় বিষ-মাখানো তরবারি দিয়ে আঘাত হানায় দুই দিন পর তিনি শাহাদত বরণ করেন। এ ঘটনা ঘটেছিল কুফার গ্র্যান্ড মসজিদে।

অনেকেই মনে করেন ১৮ রমজানের দিবাগত রাত তথা ১৯ রমজানের রাত শবে কদর তথা মহিমান্বিত রাত। এ রাতের ইবাদত হাজার মাসের ইবাদতের চেয়ে উত্তম।
আলী (আ.) সর্বত্র প্রকৃত ইসলাম ও ন্যায়-বিচার কায়েমের তথা সংস্কারের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন বলেই সুবিধাবাদী, মুনাফিক এবং স্বল্প-জ্ঞানী ধর্মান্ধ ও বিভ্রান্ত শ্রেণীগুলো তাঁর শত্রুতে পরিণত হয়েছিল। যেমন, তিনি খিলাফত লাভের পর সব সাহাবির জন্য সরকার-প্রদত্ত ভাতা সমান করে দিয়ে রাসূল (সা.) সুন্নাত পুন:প্রবর্তন করেছিলেন। ফলে অনেকেই তাঁর শত্রুতে পরিণত হয়।
কোন এক বছর শাবান মাসের শেষ শুক্রবারে রমজানের ফজিলত সম্পর্কে বলতে গিয়ে বিশ্বনবী (সা.) ভাষণের শেষ পর্যায়ে কাঁদতে থাকেন। তা দেখে হযরত আলী (আ.) এর কারণ জানতে চান। জবাবে মহানবী বহু বছর পর রমজান মাসে আলী (আ.)'র মর্মান্তিক শাহাদতের ভবিষ্যদ্বাণীর কথা উল্লেখ করলেন। তিনি বললেন,"হে আলী! এই মাসে তোমার ওপর যা নেমে আসবে সে জন্য আমি কাঁদছি। আমি নিজেকে কল্পনা করছি তোমার স্থানে যখন তুমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছ এবং সামুদ জাতির কাছে পাঠানো খোদায়ী উটের পা কর্তনকারী লোকটির মতই মানব ইতিহাসের সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তিটি তোমার মাথার ওপর আঘাত হানবে এবং তোমার দাড়ি তাতে (রক্তে) রঞ্জিত হবে।"
নিজের শাহাদতের ভবিষ্যদ্বাণীর কথা শুনে সব কিছুর আগে হযরত আলী (আ.)'র মনে যে চিন্তাটির উদয় হয়েছিল তা এই বস্তু-জগত সম্পর্কিত ছিল না, বরং তা ছিল নিজের ঈমান সম্পর্কিত। তাই তিনি প্রশ্ন করলেন: " হে আল্লাহর রাসূল! সে সময় আমি কী ঈমানের ওপর অবিচল থাকব? "রাসূল (সা.) বললেন: " হ্যাঁ, সে সময় তোমার ঈমান নিরাপদ থাকবে।"
বিশ্বনবী (সা.) আরো বলতে লাগলেন, "হে আলী! যে তোমাকে হত্যা করে সে বাস্তবে আমাকে হত্যা করল, যে তোমাকে বিরক্ত করে সে আমাকে বিরক্ত করল এবং যে তোমার অবমাননা করল সে আমার অবমাননা করল, কারণ তুমি আমার আত্মা বা প্রাণের সমতুল্য। তোমার ও আমার মানসিকতা এবং স্বভাব অভিন্ন। নিঃসন্দেহে প্রশংসিত ও গৌরবান্বিত আল্লাহ প্রথমে আমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং এরপর সৃষ্টি করেছেন তোমাকে, তিনি প্রথমে বেছে নিয়েছেন আমাকে এবং এরপর বেছে নিয়েছেন তোমাকে। আল্লাহ আমাকে নবুওতের জন্য মনোনীত করেছেন, আর তোমাকে মনোনীত করেছেন ইমামতের জন্য। আর যে তোমার ইমামতকে অস্বীকার করবে সে কার্যত আমার নবুওতকে প্রত্যাখ্যান করল। হে আলী, তুমি আমার উত্তরাধিকারী, আমার সন্তানদের তথা নাতী-নাতনীর পিতা এবং আমার কন্যার স্বামী আর আমার উম্মতের জন্য আমার জীবদ্দশায় ও আমার মৃত্যুর পর আমার প্রতিনিধি বা খলিফা। তোমার নির্দেশ হল আমারই নির্দেশ, তোমার নিষেধাজ্ঞা হল আমারই নিষেধাজ্ঞা। সেই শক্তির শপথ করে বলছি যেই শক্তি আমাকে নবুওত দান করেছেন এবং আমাকে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসেবে তৈরি করেছেন, তুমি হচ্ছ সৃষ্টিকুলের জন্য হুজ্জাতুল্লাহ বা আল্লাহর নিদর্শন এবং তাঁর রহস্যগুলোর আমানতদার বা ট্রাস্টি ও সৃষ্টিকুলের ওপর আল্লাহর খলিফা।"
আলী (আ.) জিহাদ থেকে ফিরে আসলে মহানবী (সা.) তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে যেতেন এবং তাঁর মুখের ঘাম মুছে দিতেন নিজ হাতে। তাঁকে জিহাদ বা সফরের সময় বিদায় দিতে গিয়ে তাঁর বিজয়ের জন্য দোয়া করতেন এবং বলতেন: হে আল্লাহ, আলীর সঙ্গে এটাই যেন আমার শেষ দেখা না হয় কিংবা বলেছেন: হে আল্লাহ, আমার মৃত্যুর আগে আলীকে যেন আরো একবার দেখতে পারি।
বিশ্বনবী (সা) যখন আলী (আ)-কে এতো গভীরভাবে ভালবাসতেন তখন আমাদেরও উচিত মহানবীর (সা) পথ অনুসরণের চেষ্টা করা। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে মহানবীর প্রকৃত অনুসারী হওয়ার তৌফিক দান করুন।

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/মো.আবুসাঈদ/ ১৮