ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস (২৭ পর্ব): ‘ফাতহুল মুবিন’ নামক অভিযান
তারেকুল কুদস অভিযান চালানো হয়েছিল আবাদান অবরোধমুক্ত করার অভিযান- সামেনুল আয়েম্মের দুই মাস পর।
এই দুই অভিযানে ইরানি যোদ্ধাদের সফলতার পর যুদ্ধের দ্বিতীয় বছরে আগ্রাসী ইরাকি বাহিনী আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে চলে যেতে বাধ্য হয়।অন্যদিকে ইরান নেয় আক্রমণাত্মক অবস্থান। এ অব্স্থায় শত্রু যাতে আবার আগের মনোবল ফিরে পেতে না পারে সেজন্য ইরান দ্রুত পরবর্তী অভিযানের প্রস্তুতি নেয়। ইরানি সামরিক কর্মকর্তারা অভিযান পরিচালনার জন্য দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় ‘পশ্চিম দেজফুল’ অথবা খোররামশাহর শহরের আশপাশের এলাকাগুলোর যেকোনো একটিকে বেছে নেয়ার জন্য আলোচনায় বসেন। কয়েকদিন ধরে আলোচনার পর ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসির পক্ষ থেকে বেশ কয়েকটি কারণ দেখিয়ে পশ্চিম দেজফুলে অভিযান চালানোর প্রস্তাব দেয়া হয় এবং যৌক্তিকতার বিবেচনায় প্রস্তাবটি গৃহিত হয়।সম্ভাব্য বৃহৎ অভিযানটির নাম দেয়া হয় ফাতহুল মোবিন।
এদিকে পরপর দু’টি বড় সফল অভিযানের পর ইরানের রাজনৈতিক অঙ্গনেও নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে সামেনুল আয়েম্মে অভিযানের আগে রাজনৈতিক অঙ্গনে যে অস্থিতিশীলতা ছিল ফাতহুল মোবিন পরিচালনার আগে সে সমস্যাটি দূর হয়ে যায়। নিরাপত্তা বাহিনীর একের পর এক হামলায় সন্ত্রাসী মোনাফেকিন গোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় কমান্ড তছনছ হয়ে যায় এবং বিপ্লব বিরোধী অন্যান্য গোষ্ঠীও মারাত্মক দুর্বল হয়ে পড়ে। ওদিকে যুদ্ধক্ষেত্রেও ইরানি যোদ্ধাদের একের পর এক বিজয়ের ফলে আগ্রাসী ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম গোপনে ইরানের কাছে যুদ্ধ বন্ধ করার প্রস্তাব পাঠান।সেই সঙ্গে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন ও ইসলামি সম্মেলন সংস্থা বা ওআইসি’র পক্ষ থেকে যুদ্ধ বন্ধের লক্ষ্যে ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়। ওআইসিভুক্ত কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা ইরাক ও ইরান সফর করেন।
এ সম্পর্কে ১৯৮২ সালের ১৮ মার্চ মার্কিন দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্ট জানায়: “ইরাক সরকার ইরান থেকে সেনা প্রত্যাহার এবং তেহরানকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিষয়ে গোপন প্রস্তাব পাঠিয়েছে। তবে বাগদাদ এই শর্ত দিয়েছে যে, ইরাক-ইরান যুদ্ধ শুরু করার জন্য দায়ী পক্ষকে শনাক্ত করার জন্য ইরান যে আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিটি গঠনের আবেদন জানিয়েছে তা প্রত্যাহার করে নিতে হবে।” ইরাকের এই শর্ত মেনে নেয়ার অর্থ ছিল ইরানের ভূমিতে আগ্রাসন চালানোর জন্য সাদ্দাম সরকারকে আর দায়ী করা যাবে না এবং ওই আগ্রাসনকে বৈধতা দিতে হবে। ইরান যদি তা মেনে নেয় তাহলে সাদ্দাম যে দু’দিন পর আবার আগ্রাসন চালাবে না তার কোনো গ্যারান্টি থাকে না। এ কারণে ইরান সরকার ইরাকের সঙ্গে যেকোনো যুদ্ধবিরতি বা শান্তি প্রক্রিয়ায় আগ্রাসী দেশকে শনাক্ত করার দাবিতে অটল থাকে।
এরকম পরিস্থিতিতে ১৯৮২ সালের ২২ মার্চ ফাতহুল মোবিন অভিযান পরিচালিত হয়। এ অভিযানেও ইরানি যোদ্ধাদের সৃজনশীল মনোভাব এবং আত্মোৎসর্গের অনন্য নজির স্থাপিত হয়। বেশ কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে এই অভিযানের পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। এগুলোর মধ্যে শত্রুসেনাদের অবস্থান ও রণসজ্জাকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেয়া হয়। ইরাকি বাহিনী যতটা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকার পরিকল্পনা নিয়ে ইরানে আগ্রাসন শুরু করেছিল পরবর্তীতে ততটা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকতে পারেনি বলে তাদের প্রতিরক্ষা লাইন সঠিকভাবে সাজাতে ব্যর্থ হয়। ইরানি যোদ্ধারা বিষয়টি সঠিকভাবে উপলব্ধি করে প্রথমেই ইরাকি বাহিনীর পেছনের সারির প্রতিরক্ষা ব্যুহ গুঁড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। এর ফলে ইরাকি সেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে এবং অল্প সময়ের মধ্যে যুদ্ধের চাবিকাঠি ইরানি যোদ্ধাদের হাতে চলে আসে।
চারটি ধাপে ফাতহুল মোবিন অভিযানটি পরিচালিত হয়। চার ধাপের অভিযান পরিচালনার জন্য সম্পূর্ণ চারটি দলে আলাদা আলাদা পূর্ণশক্তির যোদ্ধাদলকে প্রস্তুত করা হয়। একটি ধাপ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি ধাপের অভিযান শুরু হয়ে যায়। এর যেকোনো একটি ধাপের পর পরবর্তী ধাপটি শুরু হতে কিছুক্ষণ দেরি হলেই গোটা অভিযানটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারত। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। অভিযানের দ্বিতীয় ধাপে ‘রোকাবিয়ে’ প্রণালী পুনরুদ্ধার হওয়ার পর ইরাকি সেনারা পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং তারা প্রাণ বাঁচাতে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যায়।বহু শত্রুসেনা ইরানি যোদ্ধাদের হাতে বন্দি হয়। ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি- স্বেচ্ছাসেবী ও গণবাহিনীর সহযোগিতায় ১২ ব্রিগেড সৈন্য নিয়ে ফাতহুল মোবিন অভিযানে অংশগ্রহণ করে।
অথচ এর আগের তারেকুল কুদস অভিযানে তাদের ব্রিগেডের সংখ্যা ছিল মাত্র চারটি। এ ছাড়া, এই অভিযানে আইআরজিসি ইরানের সেনাবাহিনীর শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা থেকে শুরু করে একেবারে নীচের সারির কর্মকর্তা পর্যন্ত সব পর্যায়ে প্রয়োজনীয় যোগাযোগ ও সমন্বয় গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। এর আগে ইরানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল থাকায় বিশেষ করে সাবেক প্রেসিডেন্ট বনি সদর পদাধিকার বলে সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়কের পদে থাকায় এই সমন্বয় ও সহযোগিতা সম্ভব ছিল না। কিন্তু বনি সদর দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার ফলে ইরানের সেনাবাহিনী ও আইআরজিসি’র মধ্যে কাঙ্ক্ষিত সদ্ভাব ও সমন্বয় গড়ে ওঠে। এর ফলে নিজেদের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে তা দূর করা এবং সক্ষমতার দিকগুলোকে আরো শক্তিশালী করা সহজ হয়।
ফাতহুল মোবিন অভিযানে বিজয়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল বিপুল সংখ্যায় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ। এসব মানুষের বেশিরভাগ ছিল ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠী এবং তারা যুদ্ধের ময়দানে রাতের বেলায় কুরআন তেলাওয়াত ও অন্যান্য নফল ইবাদতে মেতে ওঠেন। ফলে ফ্রন্টে তৈরি হয় এক নির্মল আধ্যাত্মিক পরিবেশ যা ইরানি যোদ্ধাদের মনোবল চাঙ্গা রাখতে সহযোগিতা করে। আগ্রাসী ইরাকি সেনারা ইরানি যোদ্ধাদের মুহর্মুহু আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়ে পশ্চাদপসরণ করে এবং যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে নিজেদের জীবন বাঁচায়। ফাতহুল মোবিন অভিযানে বিপুল সংখ্যক ইরাকি সেনাকে বন্দি করার পাশাপাশি তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত গনীমতের বিশাল ভাণ্ডার থেকে এই অভিযানের সফলতার ব্যাপকতা উপলব্ধি করা যায়।
এ সম্পর্কে আমেরিকার তৎকালীন নৌবাহিনীর অন্যতম কমান্ডার ও ব্রুকিংস ফরেন স্টাডিজের ফেডারেল ডিরেক্টরেটস কমিটির সদস্য জেনারেল উইলিয়াম এফ. হাইকম্যান বলেন: “ইরানিদের একের পর এক বিজয় থেকে বোঝা যায়, তারা আগের তুলনায় বেশি সংখ্যায় সৈন্য নিয়ে অভিযান চালিয়েছে এবং তাদের সেনাবাহিনী ও আইআরজিসি’র মধ্যে আগের তুলনায় অনেক বেশি সংহতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।” ফাতহুল মোবিন অভিযানে শত্রুসেনাদের পলায়ন সম্পর্কে তিনি লিখেছেন: “যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত ফাতহুল মোবিন অভিযান ছিল ইরাকিদের জন্য সবচেয়ে লজ্জাজনক পরাজয়। এর ফলে ইরাক-ইরান সীমান্তের বেশিরভাগ এলাকা থেকে ইরাকি বাহিনী সীমান্তে ওপারে চলে যায় এবং তাদের তিনটি ডিভিশন সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়।#
পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ১৭
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।