'করোনাকালেও বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প ইতিবাচক ট্রেন্ডে ফিরেছে'
মহামারি করোনার প্রথম দিকে বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশেষ করে গার্মেন্টস শিল্পে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও বর্তমানে ইতিবাচক অবস্থায় ফিরে এসেছে। আরও ভালো কিছু প্রত্যাশা করছি। রেডিও তেহরানকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে একথা বলেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট গার্মেন্টস শিল্পোদ্যোক্তা ড. কামরুজ্জামান কায়সার।
বিশিষ্ট এ ব্যাবসায়ী বলেন, করোনাকালে সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ আমাদের জন্য খুবই সহায়ক হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রতি বিদেশি ক্রেতাদের বড় আকর্ষণ রয়েছে। এর কারণ 'সস্তা শ্রম, কোয়ালিটি প্রোডাক্ট এবং লোয়ার এন্ডে কাজ। ফলে ক্রিসমাসকে সামনে রেখে- আমরা প্রচুর অর্ডার পাচ্ছি। একইসাথে তিনি বলেন, প্রবাসী শ্রমিক ভাইদের পাঠানো রেমিটেন্সে এবং আমদানি নির্ভরতা কমে যাওয়াও আমাদের রিজার্ভ অনেক বেড়েছে।
পুরো সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো। এটি গ্রহণ ও উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।
রেডিও তেহরান: জনাব, অনেক অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও প্রতিষ্ঠান ভবিষ্যৎবাণী করেছে যে, করোনাভাইরাসের মহামারীর কারণে বিশ্বজুড়ে গত কয়েক শতকের মধ্যে সবচেয়ে বড় ও সদূরপ্রসারী যে মন্দাটি ঘটবে বাংলাদেশেও তার বিরাট ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। এতে বাংলাদেশের সমস্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, জিডিপি উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাবে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কি ধরনের ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
ড.কামরুজ্জামান কায়সার: দেখুন, বাংলাদেশের অর্থনীতির একটা বড় অংশই তৈরি পোশাক রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল। আপনারা জানেন যে, বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের অন্যতম খাত হচ্ছে তৈরি পোশাক শিল্প। এই খাতটি আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের ক্ষেত্রে ৮৬ ভাগ অবদান রাখে। আরেকটি খাত হচ্ছে প্রবাসীদের রেমিটেন্স। এই দুটোর উপর ভিত্তি করেই বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদ্বণ্ড আবর্তিত হচ্ছে।
মহামারি করোনা পরিস্থিতিতে আমরা অর্থনৈতিকভাবে একটু ধাক্বা খেয়েছি। তবে আশার বাণী হচ্ছে সারা বিশ্বে গার্মেন্টের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের একটা ব্রান্ড ইমেজ তৈরি হয়েছে। আমরা কিন্তু 'লোয়ার এন্ডের' কাজ করি। লোয়ার এন্ড বলতে তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে যে আইটেমগুলোর প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি সেগুলো নিয়ে কাজ করি। আর আমাদের তৈরি আইটেমগুলোর প্রয়োজনীয়তা থাকবেই।
একথা সত্যি সারা বিশ্বের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে গেছে। অনেক ক্ষেত্রে কর্মী ছাটাই হয়েছে, অর্থনৈতিক মন্দা সরাসারি মানুষের জীবনযাত্রায় আঘাত হেনেছে। সেক্ষেত্রে আমরা যে বস্ত্রখাত নিয়ে কাজ করি সেটি তিনটি মৌলিক চাহিদার মধ্যে একটি। আর বাংলাদেশ এক্ষেত্রে যে বেসিক কাজ করে সেই আইটেমগুলোর চাহিদা আছে এবং থাকবে যে কথা আগেও বল্লাম। বিশ্বে করোনার বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যে আমরা কিন্তু বায়ারদের কাছ থেকে অর্ডার পাচ্ছি।
রেডিও তেহরান: গার্মেন্টস খাত যেহেতু বাংলাদেশের সবচেয়ে রপ্তানির বড় খাত সেজন্য একে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। এই প্রণোদনা প্যাকেজ আসলে কতটা উপকারী হয়ে দাঁড়িয়েছে?
ড.কামরুজ্জামান কায়সার: বাংলাদেশ সরকার করোনাকালীন সময়ে তিন মাসের যে প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছিল সেটি আমাদের অনেক কাজে লেগেছে। যারা নতুন শিল্পোদ্যোক্তা-তাদের ক্ষেত্রে খুব সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। আমরা আশা করি আগামীতে আমরা আরও ভালো করব। কারণ গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শতকরা ৩ ভাগ প্রবৃদ্ধি হয়েছে যারমধ্যে শতকরা ১ ভাগ হচ্ছে রপ্তানি পোশাক শিল্পের অবদান। আমরা কিন্তু এখনও নেতিবাচক ট্রেন্ডে যাই নি।
২০২০-২১ অর্থ বছরের প্রথম প্রান্তিকের মধ্যে করোনার বিষয়টি ছিল। তার মধ্যেও আমরা শতকরা ১ ভাগ গ্রোথে এসেছি। আমরা আশা করছি অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর কোয়ার্টারে অর্থাৎ দ্বিতীয়ভাগের ভালো দিক হচ্ছে ইউরোপ আমেরিকার ক্রিসমাসকে কেন্দ্র করে এরইমধ্যে আমাদের কাছে প্রচুর অর্ডার এসেছে। আমরা সেটি এক্সিকিউট করছি। তবে আগামী নতুন অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের অবস্থা কেমন হবে সে-কথা এখনই বলতে পারছি না। বর্তমান অর্থবছরের প্রথম ও দ্বিতীয় প্রান্তিকেও আমরা ইতিবাচক ট্রেন্ডে আছি একথা বলতে পারি। আগামীতে হয়তো আমরা আরও ভালো কিছু করতে পারব বলে আশাবাদী। কারণ বাংলাদেশের প্রতি বিদেশি ক্রেতাদের একটা বড় আকর্ষণ রয়েছে। এর কারণ 'সস্তা শ্রম, কোয়ালিটি প্রোডাক্ট এবং লোয়ার এন্ডে কাজ । এই তিনটি বিষয়ই তাদের আকর্ষণের মূল কারণ।'
রেডিও তেহরান: বাংলাদেশের গার্মেন্টসের সবচেয়ে বড় রপ্তানি মার্কেট কোনটি এবং করোনার ভেতরে আমাদের উল্লেখযোগ্য মার্কেটে রপ্তানির মাত্রাটা কেমন হয়েছে?
ড.কামরুজ্জামান কায়সার: বাংলাদেশের গার্মেন্টসের সবচেয়ে বড় রপ্তানি মার্কেট হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং উত্তর আমেরিকার দেশগুলো। শতকরা হিসাবে যদি আমি পরিসংখ্যানটা আপনাকে দেই তাহলে এরকম হবে- শতকরা ৫৩ ভাগ গার্মেন্টস পণ্য যুক্তরাষ্ট্র এবং উত্তর আমেরিকার দেশ-কানাডা, মেক্সিকো, ব্রাজিল কিংবা ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে যাচ্ছে। তারমধ্যে সবচেয়ে বেশি যাচ্ছে নিটওয়্যার, ওভেন, সোয়েটার, জিন্স-ডেনিম আইটেমগুলো।
আর দ্বিতীয় মার্কেট হচ্ছে ইউরোপ এবং বাকি বিশ্ব। করোনাকালে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে আমাদের একটু ঘাটতি হয়েছে। বিশেষ করে এপ্রিল থেকে জুন-এই সময়টাতে আমাদের কিছুটা নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ছিল। বারাবর আমাদের যে ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের টার্নওভার থাকে। ২০২০-২১ অর্থবছরেও সেই লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও আমরা ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছতে পেরেছি। আমাদের শর্টেজ ছিল ২ বিলিয়ন। তবে এখন আবার ইতিবাচক ট্রেন্ডে ফিরে এসেছি এবং বর্তমান ধারা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে আমরা আমাদের ইস্পিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব।
রেডিও তেহরান: ড. কামরুজ্জামান-প্রসঙ্গে ধরেই আমি জানতে চাইছি, আপনারা বলছেন যে, পোশাক শিল্পের প্রোডাকশনের যে ট্রেন্ড তাতে ফিরে এসেছেন। আপনারা প্রণোদনা চেয়েছেন- সরকার দিয়েছে। কিন্তু এখনও প্রায়ই দেখা যাচ্ছে কিছু কারাখানার শ্রমিক বেতন পাচ্ছে না। তারা বেতনের দাবিতে রাস্তাও নামছে। অনেকে কাজ হারিয়েছে। এসব অভিযোগ দেখা যাচ্ছে। তো আপনার বক্তব্য অনুসারে আমরা কি একথা বলতে পারি যে করোনার প্রভাবে বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতে যে বড় রকমের একটা সংকট দেখা গিয়েছিল তা কেটে গেছে?
ড.কামরুজ্জামান কায়সার: আপনি যথার্থই বলেছেন। বর্তমানে আমাদের বিজিএমইএ নিবন্ধিত প্রায় আড়াই হাজার পোশার কারখানা আছে। তারমধ্যে আপনি বলেছেন কিছু কারাখানা তাদের শ্রমিকদের বকেয়া পরিশোধ করে নি। এটি শুধু করোনাকালীন সময়ের জন্যই নয়, এ ধরনের একটা বিষয় প্রায় সব সময়ই থাকে।
অনেক ফ্যাক্টরি কমপ্লায়েন না। কোনো কমপ্লায়েন ফ্যাক্টরি তাদের শ্রমিকদের বেতন না দিয়ে বা বকেয়া রেখে এভাবে ঘুরাতে পারবে না। তবে কিছু ফ্যাক্টরি আছে- যাদেরকে বলা হয় সাব-কন্ট্রাক্ট ফ্যাক্টরি। হয়তো এই দুর্যোগের সময় তারা ভাবছে আমরা যেহেতু পরোক্ষভাবে কাজ করি। আর এসময় আমাদের যে আয় হচ্ছে তা দিয়ে আমাদের ব্যাংক ঋণসহ মজুরি পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। সেক্ষেত্রে তারা শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে কিছুটা টালবাহনা করছে।
তবে এটিই বাংলাদেশের সামগ্রিক চিত্র নয়। যেখানে আড়াই হাজার কারখানা চলছে এই করোনাকালীন সময়ে সরকারের প্যাকেজের আওতায় তারা পুরোপুরিভাবে শ্রমিকদের পাওনা এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধাদি দিয়েছে।
রেডিও তেহরান: প্রসঙ্গক্রমে আরেকটি বিষয় জানতে চাই যে, করোনা মহামারিতে যেখানে সারা বিশ্ব বিপর্যয়ের মুখে সেখানে আমাদের প্রবাসী আয় বেড়েছে। এটা কিভাবে সম্ভব হলো? এর পেছনের কারণ কি?
ড.কামরুজ্জামান কায়সার: প্রবাসীদের আয় বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রেখেছে। আপনি হয়তো জানেন যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে- ৪০ বিলিয়ন ইউএস ডলার। এটা বৃদ্ধির একটা বড় কারণ হচ্ছে –আমাদের আমদানি বলতে গেলে প্রায় বন্ধ গেছে। বড় আকারের আমদানি কিন্তু আমরা এখন করছি না। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্টগুলো সেভাবে বাইরে যাচ্ছে না। আমাদের রিজার্ভ ধীরে ধীরে বাড়ছে।
প্রবাসে আমাদের যে ভাইয়েরা আছেন তারা দেশের কথা চিন্তা করে তাঁদের জীবনযাত্রাকে অনেক সঙ্কুচিত করে তাঁদের পরিবার-পরিজনকে আরো বেশি আকারে সাপোর্ট দেয়ার জন্য হয়তো বৈধভাবে বেশি পরিমাণে টাকা পাঠিয়েছে। করোনার সময় এবং আগে পরে তাঁরা বিভিন্নভাবে অর্থ পাঠিয়েছে। আর বর্তমানে তারা প্রোপার ব্যাংকিং চ্যানেলে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠানোর কারণে আমাদের রিজার্ভের মাত্রাটা একটু বেশি দেখা যাচ্ছে।
একইসাথে বিদেশ থেকে আমদানি নির্ভরতা অনেকটা কমে যাওয়ার কারণে ফরেন পেমেন্টও কমে এসেছে যেকথা একটু আগেই বল্লাম। যে-কারণে আমাদের রিজার্ভ বেড়েছে।
আর আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পের রপ্তানি আবার কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর কারণে এ খাত থেকে এবং প্রবাসীদের কাছ থেকে আসা বৈদেশিক মুদ্রার কারণেই মূলত আমাদের রিজার্ভ বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ আমাদের এখন ব্যয় কম কিন্তু আয় বেশি।
রেডিও তেহরান: তো জনাব ড. কামরুজ্জামান কায়সার করোনাকালে বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা, গার্মেন্টস খাত ও প্রবাসী খাতে এর প্রভাব নিয়ে রেডিও তেহরানের সাথে কথা বলার জন্য আপনাকে আবারও অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
ড.কামরুজ্জামান কায়সার: জ্বি, আপনাদেরকে এবং দর্শক-শ্রোতাদেরকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।#
পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/০৪
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।