ইরানে ইসলামী বিপ্লবের গৌরবময় অগ্রযাত্রার ৪২ বছর (পর্ব-১)
ইরানের ইসলামী বিপ্লব অতিক্রম করল তার গৌরবময় অগ্রযাত্রার ৪২টি বছর। হাজার বছরের মহাবিস্ময় হিসেবে স্বীকৃত এ বিপ্লবের সাফল্যের পালকে যুক্ত হচ্ছে প্রায় প্রতি বছরই একের পর এক অভাবনীয় নানা সাফল্য।

বিশ্বব্যাপী ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও ইসলামী সভ্যতার একটি আদর্শ মডেল গড়ে তুলতে সক্রিয় ইরানের ইসলামী বিপ্লবী জনগণ ও নেতৃবৃন্দ দিনকে দিন বিশ্বের জনগণের কাছে আরও বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন। এর প্রমাণ আমরা দেখেছি ইরানের কুদস্ ব্রিগেডের সাবেক প্রধান ও সন্ত্রাস-বিরোধী যুদ্ধের কিংবদন্তীতুল্য সফল মহানায়ক কাসেম সুলায়মানির শাহাদাতে এবং তাঁর শাহাদাতের প্রথম বার্ষিকীতে বিশ্বের মুক্তিকামী জাতিগুলো ও ব্যক্তিত্বদের পক্ষ থেকে তাঁর প্রতি অসাধারণ শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও আবেগময় অনুরাগের প্রকাশ থেকে।
অনেক বিশ্লেষকই এখন বলছেন, জীবিত সুলায়মানির চেয়ে শহীদ সুলায়মানি এবং তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শ মার্কিন-ইহুদিবাদী ও শয়তানি শক্তিগুলোর জন্য আরও বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠ্ছে।
ইরানের ইসলামী বিপ্লব যে এখনও তার আদর্শিক ও বৈষয়িক লক্ষ্যগুলো অর্জনের পথে জোর কদমে এগিয়ে চলছে তার প্রমাণ হল এর প্রতি সাম্রাজ্যবাদী ও শয়তানি শত্রুগুলোর অব্যাহত শত্রুতা ও তা দিনকে দিন তীব্রতর হতে থাকা।
বর্তমান বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদী শয়তানি শক্তিগুলোর সবচেয়ে বড় শত্রু ও চক্ষুশুল হয়ে-থাকা ইসলামী ইরান মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শক্তিগুলো ও তাদের তাবেদার সরকারগুলোর পক্ষ থেকে গত কয়েক বছরে নজিরবিহীন ও সর্বোচ্চ মাত্রায় নিষেধাজ্ঞার শিকার হওয়া সত্ত্বেও ইসলামী এই দেশটি এইসব নিষেধাজ্ঞা ও বাধাকে অনেকাংশেই অকার্যকর ও ব্যর্থ করে দিচ্ছে। পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর সংবাদপত্র ও মিডিয়াগুলোই তা প্রায়ই স্বীকার করছে।
সম্প্রতি মার্কিন ও ইহুদিবাদী চক্র এক জটিল অভিযান চালিয়ে ইরানের শীর্ষস্থানীয় পরমাণু বিজ্ঞানী ও উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোহসেন ফাখরিজাদে’কে শহীদ করেছে। ফলে গোটা ইরানি জাতির মধ্যে জুলুম-বিরোধী এবং আশুরা বিপ্লবের শহীদী সংস্কৃতি-কেন্দ্রীক ঐক্যের চেতনা আবারও জোরালো হয়ে উঠেছে। এ অবস্থায় ইরান তার শান্তিপূর্ণ পরমাণু গবেষণা ও তৎপরতা বহু গুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। ইরান সাম্রাজ্যবাদী দাম্ভিক শক্তিগুলোকে এই হুঁশিয়ারি দিয়ে বলছে, শহীদ সুলায়মানি ও ফাখরিজাদেহ এবং ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যায় জড়িত সবার জন্য অত্যন্ত কঠোর ও ভয়াবহ শাস্তি অপেক্ষা করছে।
সুলায়মানির স্থলাভিষিক্ত ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি’র কুদস ফোর্সের প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইসমাইল কায়ানি বলেছেন, সুলায়মানির হত্যার বদলা কেউ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভেতর থেকেই নিতে পারে!
ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমির হাতামি সম্প্রতি বলেছেন, মোহসেন ফাখরিজাদে’কে হত্যা করে শত্রুরা ইরানের গবেষণা কাজে বিন্দুমাত্র ব্যাঘাত ঘটাতে পারেনি । তিনি বলেন, যে বিজ্ঞানীকে ফাখরিজাদের স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে তিনি আগের চেয়েও দ্রুত গতিতে গবেষণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। জেনারেল হাতামি জানান, ইরান সরকার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের গবেষণা ও উদ্ভাবনি খাতের বাজেট ২৫০ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছে। ইরানের সংসদ এক্ষেত্রে সরকারকে পূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
ইরানের জেনারেল কাসেম সুলায়মানি পশ্চিম এশিয়ায় মার্কিন-ইহুদিবাদী ও তাদের আঞ্চলিক তল্পিবাহক সেবাদাস শক্তিসহ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন তথা সন্ত্রাসের বিস্তার ঘটিয়ে এ অঞ্চলে পশ্চিমাদের লুটপাট ও ত্রাসের শাসন কায়েম করার অপকৌশলকে আঞ্চলিক জিহাদি ও দেশপ্রেমিক গণবাহিনীর মাধ্যমে পুরোপুরি বানচাল করেছিলেন। তার সহযোগিতায় লেবাননের হিযবুল্লাহ ও ফিলিস্তিনের হামাস আর 'জিহাদ'সহ সংগ্রামী গোষ্ঠীগুলো সামরিক প্রশিক্ষণ ও কৌশলগত আধুনিক অস্ত্র ব্যবহারের দিক থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। সুলায়মানি তার কূটনৈতিক প্রজ্ঞার মাধ্যমে রাশিয়ার মত শক্তিকেও আগ্রাসী শক্তির লেজুড়দের বিপক্ষে ব্যবহার করতে সক্ষম হন।
আর এসবেরই পেছনে মূল আদর্শিক প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে ইরানের ইসলামী বিপ্লবের মহান আলোকোজ্জ্বল নীতিমালা যার উৎস হচ্ছে খাঁটি মুহাম্মাদি সংগ্রামী-ইসলাম যা আধুনিক যুগে তুলে ধরেছেন ইসলামী জাগরণের কিংবদন্ততুল্য সফল মহানায়ক মরহুম ইমাম খোমেনী। আর ওই মহান ইমামের দেখানো পথকে অব্যাহত রাখতে অনেকাংশেই সফল হয়েছেন তাঁরই সুযোগ্য উত্তরসুরি ইসলামী বিপ্লবের বর্তমান সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ি- (মহান আল্লাহ তাকে দীর্ঘজীবী করুন)।
আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ির সুযোগ্য নেতৃত্বে ইরান শত্রুদের মোকাবেলায় অপোষকামিতার পরিবর্তে সবক্ষেত্রেই শক্তিমত্তা ও স্বনির্ভরতা অর্জনে সচেষ্ট হয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সফল হয়েছে। বিশেষ করে সৃষ্টিশীল বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও বৈজ্ঞানিক উন্নয়ন এবং সামরিক প্রযুক্তি খাতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের দিক থেকে অভাবনীয় ও বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করেছে ইসলামী ইরান। অভ্যন্তরীন ক্ষেত্রে জাতীয় ঐক্য এবং শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখাও মূলত তাঁর প্রজ্ঞাপূর্ণ নেতৃত্বের কাছে ঋণী।
মহানবীর বংশধর ও বিজ্ঞ-দূরদর্শী এই মহান নেতার অসাধারণ সাহসিকতার প্রতিফলন ঘটেছে সুলায়মানি হত্যার পর পরই ইরাকে আইনুল আসাদ নামক মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানের ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঘটনায়। ওই হামলায় সেই মার্কিন ঘাঁটি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয় এবং বহু মার্কিন সেনা তাতে আহত হয় বলে পেন্টাগন জানায়। ইরানের ওই হামলায় বহু মার্কিন সেনা নিহত হলেও ট্রাম্প সরকার তা গোপন রেখেছে বলে অনেকেই মনে করেন। এর আগেও ইরান তার পানি-সীমা লঙ্ঘনের দায়ে ব্রিটিশ ও মার্কিন নৌ-সেনাদের বন্দি করে বিশ্ব-অঙ্গনে ইসলামী এই দেশের নেতৃবৃন্দের নির্ভিকতাকে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অন্যতম প্রধান সহযোগী ব্রিটেন ইরানের একটি তেল ট্যাংকারকে অবৈধভাবে আটক করলে ইরান পারস্য উপসাগরের আইন লঙ্ঘনকারী একটি ব্রিটিশ তেল ট্যাংকারকে আটক করে তার নৌ-শক্তির অসাধারণ সক্ষমতাও প্রমাণ করেছে। এ ছাড়াও সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ইরানের তেল ট্যাংকার বার বার মার্কিন আঙ্গিনার পাশেই অবস্থিত মার্কিন বিরোধী শক্তি ভেনিজুয়েলায় পৌঁছে দিচ্ছে জ্বালানী তেল।
অন্যদিকে ফরাসি সরকারের ইসলাম-বিদ্বেষী চরিত্র তুলে ধরে ও বাক-স্বাধীনতার ক্ষেত্রে দেশটির সরকারের দ্বিমুখী চরিত্র তুলে ধরে ইসলাম আর মানবীয় মূল্যবোধ বিরোধী সাংস্কৃতিক আগ্রাসন মোকাবেলার অঙ্গনেও ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আদর্শিক প্রচারকের নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রাখছেন। মার্কিন সরকারসহ পশ্চিমা সরকারগুলোর আদর্শিক দেউলিয়াত্ব, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে তাদের কপটতা ও ব্যর্থতা তুলে ধরার ক্ষেত্রে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার স্পষ্টভাষী, যৌক্তিক ও অকাট্য প্রতিবাদী বক্তব্য এবং নির্যাতিত মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর প্রতি তার অসাধারণ দরদ চিন্তাশীল ও মুক্তিকামী মহলে তার জনপ্রিয়তা দিনকে দিন বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফিলিস্তিন, ইয়েমেন, কাশ্মির ও মিয়ানমারসহ বিশ্বের যে কোনো অঞ্চলের মজলুম জাতি ও মুসলমানদের ব্যাপারে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার জুলুম-বিরোধী এবং ন্যায়বিচারকামী অবস্থান কেবল বক্তৃতাতেই সীমিত নয়, একইসঙ্গে তা সক্রিয় সহযোগিতায়ও সুবিস্তৃত। এইসব দিক লক্ষ্য করে অনেকেই বলছেন যে খামেনেয়ী হচ্ছেন দ্বিতীয় খোমেনী।
এভাবে ইরানের ইসলামী বিপ্লব আজো বিশ্বের প্রধান চমক হয়ে নানাভাবে আকৃষ্ট করছে ন্যায়বিচারকামী ও মুক্তিকামী জাতিগুলোকে এবং জাগিয়ে রাখছে তাদের আশার আলোকে।
ইরানের ইসলামী বিপ্লবের সাফল্যের নানা দিক নিয়ে আমরা আরও কথা বলব বিশেষ এই ধারাবাহিক অনুষ্ঠানের আগামী পর্বগুলোতে। আশা করছি তখনও আমাদের সঙ্গ দিতে ভুলবেন না।#
পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/৩১
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।