আসমাউল হুসনা (পর্ব-৮)
গত কয়েক পর্বে আমরা পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত সুন্দরতম নাম বা আসমাউল হুসনা হিসেবে খ্যাত মহান আল্লাহর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নামের অর্থ ও তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা শুনেছি।
আজ আমরা মহান আল্লাহর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নাম মু'মিন-এর সামগ্রিক অর্থ, ব্যাখ্যা ও গুরুত্ব নিয়ে কথা বলব।
আরবি আম্ন্ শব্দটি থেকে উদ্ভূত মু'মিন শব্দের অর্থ নিরাপত্তা-দাতা ও প্রশান্তি-দাতা। হযরত ইমাম জাফর আসসাদিক্বের মতে মানুষ আল্লাহর আনুগত্য করায় আল্লাহ তাকে দোযখের শাস্তি থেকে রক্ষা করেন। আর তাই আল্লাহর অন্যতম নাম মু'মিন। আর যে আল্লাহর পক্ষ থেকে নিরাপদ তাকেও মু'মিন বলা হয়। আবার ঈমান আনার কারণে বিশ্বাসীকেও বলা হয় মু'মিন।
সুরা হাশরের ২৩ নম্বর আয়াতে মু'মিন শব্দটি নিরাপত্তাদাতা ও আশ্রয়দাতা অর্থে মহান আল্লাহর নাম হিসেবে এসেছে। এই আয়াতের অর্থ হল :
'তিনিই আল্লাহ তিনি ছাড়া কোন উপাস্য নেই। তিনিই একমাত্র মালিক, সব ত্রুটি থেকে পবিত্র, শান্তি এবং ভীত-সন্ত্রস্তদের নিরাপত্তাদাতা ও আশ্রয়দাতা, বিশ্বজগত ও বিশ্ববাসীর রক্ষাকারী, সব কিছুর ওপর পরাক্রান্ত ও অপরাজেয়, প্রতাপান্বিত, গৌরবান্বিত ও মাহাত্যশীল। তারা যাকে অংশীদার করে আল্লাহ তা’ আলা তা থেকে পবিত্র।'
মহান আল্লাহ হচ্ছেন সব ধরনের নিরাপত্তা ও প্রশান্তির উৎস। মু'মিন ব্যক্তিরাও খোদায়ি এই নামের প্রকাশ। তাদের পক্ষ থেকে বা তাদের মাধ্যমে অন্য কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়না।
ইমাম রেজা (আ) ইরানের নিশাপুরে এক হাদিসে বলেছেন, মহানবী (সা) বলেছিলেন, মহান ফেরেশতা জিব্রাইল (আ) গৌরবময় মহান আল্লাহ বলতে শুনেছেন যে তিনি বলেছেন, আল্লাহ ছাড়া কোনো মা'বুদ বা উপাস্য নেই- এই বাক্যটি হচ্ছে আমার দূর্গ, তাই যে তাতে প্রবেশ করবে সে আমার শাস্তি থেকে নিরাপদ থাকবে। এতটুকু বলার পর ইমামের কাফেলার যানবহন নিশাপুর থেকে বাদশাহ মামুনের প্রাসাদ অভিমুখে চলা শুরু করলে তিনি আরও বলেন, অবশ্য এর তথা মহান আল্লাহর ওই ঘোষণার শর্তাবলী রয়েছে এবং আমি হচ্ছি এর অন্যতম শর্ত! অর্থাৎ তিনি এটা বোঝাতে চেয়েছেন যে তাঁর ইমামত আল্লাহর পক্ষ থেকেই মনোনীত। আর তাই তাঁর আনুগত্য করা ফরজ। অন্য কথায় মু'মিন হতে হলে বা মহান আল্লাহর সুরক্ষার অধিকারী হতে হলে নিজ নিজ যুগের নিষ্পাপ ইমাম বা নেতার আনুগত্য করতে হবে।

মহান আল্লাহ মানুষের প্রশান্তি-দাতা। সুরা রাদের ২৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: জেনে রাখো যে একমাত্র আল্লাহর স্মরণেই হৃদয় প্রশান্ত হয়। খোদায়ি এই গুণের প্রকাশ প্রকৃত মু'মিন অন্য মানুষের জন্য ভয় ও দুশ্চিন্তার কারণ হয় না। মহানবী (সা) বলেছেন, প্রকৃত মু'মিন সেই যে মানুষের ওপর জুলুম করে না। যে অন্যদের অধিকার লঙ্ঘন করে ও যার কথা বা কাজ থেকে অন্যরা নিরাপদ নয় তাকে দেখতে বাহ্যিকভাবে মু'মিন মনে হলেও সে বাস্তবে মু'মিন নয়। মহান আল্লাহর প্রতি সুধারণা রাখাও মু'মিনের অন্যতম লক্ষণ। মহান আল্লাহর ক্ষমাশীলতা ও দয়ার ওপর আস্থা না রাখলে আল্লাহও দয়া ও ক্ষমা প্রদর্শন করবেন না বলে বর্ণনা রয়েছে। মহান আল্লাহ তাঁর প্রতি সুধারণা পোষণকারীর সুধারণার বিপরীত আচরণ করতে লজ্জা বোধ করেন। কিন্তু তার মানে এই নয় আল্লাহ ক্ষমাশীল বলে এখন যত খুশি পাপ করব-এমনটি ভাবা হবে খুবই অযৌক্তিক। আবার আমি তো অনেক পাপ করেছি-এখন আর তওবা করলেও আল্লাহ নিশ্চয়ই ক্ষমা করবেন না- আল্লাহর প্রতি এমন ধারণারও উৎস হচ্ছে শয়তানের প্ররোচিত হতাশা। আল্লাহ বলেছেন, কেবল অবিশ্বাসীরাই আল্লাহর রহমতের ব্যাপারে আস্থাহীন ও হতাশ।
আল্লাহর প্রতি যে ঈমান রাখে ও যে আল্লাহর বিধি-বিধান বা নির্দেশের অনুগত সে যেমন মুমিন তেমনি আল্লাহ নিজেও মু'মিন হিসেবে নিজেকে নিজেও স্বীকৃতি দিয়ে সুরা আলে ইমরানের ১৮ নম্বর আয়াতে বলেছেন, 'আল্লাহ সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তিনি ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই। ফেরেশতাগণ এবং ন্যায়নিষ্ঠ জ্ঞানীগণও সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। তিনি পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।'
পরকাল ও মহান আল্লাহর ন্যায়বিচারের প্রতি বিশ্বাস এবং মহানবীর আদেশ-নিষেধ মানাও মু'মিন হওয়ার অন্যতম শর্ত। মহানবী (সা) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইত হচ্ছে পবিত্র কুরআনের বাস্তব দৃষ্টান্ত। সুরা আনফালের দ্বিতীয় ও তৃতীয় আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, 'যারা ঈমানদার, তারা এমন যে, যখন আল্লাহর নাম নেয়া হয় তখন ভীত হয়ে পড়ে তাদের অন্তর। আর যখন তাদের সামনে পাঠ করা হয় কালাম, তখন তাদের ঈমান বেড়ে যায় এবং তারা নিজ পরওয়ারদেগারের প্রতি ভরসা পোষণ করে। এরা সেইসব ব্যক্তি যারা নামায কায়েম করে এবং আমি তাদেরকে যে রুযী দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে।'
প্রকৃত মু'মিনের অবস্থা আল্লাহর ব্যাপারে সেই শিশুদের বিশ্বাসের মত যারা মনে করে যে বাবা পাশে থাকায় তারা নিরাপদ, তবে খারাপ কাজ করলে বাবা রাগ করবেন ও শাস্তিও দিতে পারেন, ঠিক তেমনি আল্লাহও নিরাপত্তাদাতা তবে পাপ করলে ঠিকই শাস্তি দেবেন। তাই মু'মিনের মনে রাখা উচিত ভালো কাজের কারণে আল্লাহ বেহেশত দেবেন আর মন্দ কাজের কারণে দোযখে পাঠাবেন। মু'মিনের কি কি গুণ থাকা উচিত এমন প্রশ্নের জবাবে মহানবী (সা) হযরত আলীর কাছে ১০৩টি গুণের কথা তুলে ধরেন। এসবের মধ্যে রয়েছে: ধৈর্যশীল ও সহিষ্ণু, সদালাপী ও উদার-মনা, আনন্দকে প্রকাশ করলেও ও দুঃখকে গোপন রাখেন, যা তার সঙ্গে সম্পর্কিত নয় সেই অঙ্গনে প্রবেশ করেন না, কখনও কারো গিবত করেন না, খুবই দানশীল, কারো গোপন বিষয় ফাঁস করেন না, অনেক বেশি ইবাদতকারী, মানুষের আমানত রক্ষার ব্যাপারে খুবই বিশ্বস্ত, সত্যবাদী ও সৎ চরিত্রের অধিকারী, জীবনের ব্যয় নির্বাহে মিতব্যয়ী, প্রতারক বা মিথ্যাবাদীর বন্ধু হন না এবং সত্যকে শত্রুর কাছ থেকে হলেও মেনে নেন, রক্তের সম্পর্ক ছিন্ন করেন না বরং তাদের প্রতি, বিশেষ করে বাবা-মায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং ইয়াতিমদের প্রতি দয়ালু।
মু'মিন ব্যক্তি ইমান ও ধর্মকর্মসহ সব ক্ষেত্রে হবেন আন্তরিক। কেবল নিয়ত পরিশুদ্ধ হলেই চলবে না, বাস্তবে তার প্রকাশও থাকতে হবে। মহান আল্লাহ আমাদেরকে প্রকৃত মুমিন হওয়ার তৌফিক দান করুন।#
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ২৪
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।