পাশ্চাত্যে জীবন ব্যবস্থা (পর্ব-১৭)
গত আসরে আমরা বলেছি পাশ্চাত্যের পাশাপাশি তাদের লাইফ স্টাইল অনুসরণকারী অন্য দেশগুলোতেও নারী ও শিশু অধিকার রক্ষার স্লোগানের আড়ালে চলছে অধিকার লঙ্ঘনের মহোৎসব।
নারী ও শিশুদের অপহরণ করে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে পতিতালয়গুলোতে। চিরদিনের জন্য বন্দী হয়ে পড়ছে এসব অসহায় মানুষ। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে পতিতাবৃত্তিকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। মানব জাতি বিশেষকরে নারীদের জন্য চরম অবমাননাকর এই ক্ষেত্রটিকে ব্যবসা হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। পাশ্চাত্যের দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে অনেক উন্নতি সাধন করলেও এসব নারীকে এ ধরণের অবমাননাকর অবস্থা থেকে মুক্তি দেওয়ার উদ্যোগ নেয় নি। তারা বলছে, অর্থের প্রয়োজনে এই কাজে নেমেছে ওই সব নারী। কিন্তু এতো অর্থ-বিত্তের দেশগুলো এসব নারীর আর্থিক অভাব মিটিয়ে তাদেরকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করছে না কেন, এটি একটি স্বাভাবিক প্রশ্ন।
ধারণা করা হয় যে, মানব পাচারের মাধ্যমে বছরে তিন হাজার কোটি ডলারের মুনাফা করে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহল। এর অর্ধেক অর্থাৎ এক হাজার পাঁচশ’কোটি ডলার পায় শিল্পোন্নত দেশগুলো। আর মানব পাচারের শিকার তিন চতুর্থাংশই হলেন নারী। জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ বিষয়ক গবেষণা পরিচালক অ্যাঞ্জেলো মে ২০১৬ সালের পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেছেন, মেয়েরাই যৌন দাসত্বের শিকার হয় বেশি, তাদেরকে নিয়ে ব্যবসা করা হয়। এখানে বলে রাখা ভালো, মহিলাদের পাচারের প্রধান গন্তব্য হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিম ইউরোপ।
পাশ্চাত্যে যৌন স্বাধীনতার আরেকটি পরিণতি হলো, গর্ভপাতের হার বৃদ্ধি। ১৯৭৩ সালে মার্কিন আদালত গর্ভপাতকে আইনি বৈধতা দেয়। এরপর থেকেই গর্ভপাত বেড়ে চলেছে। এরপর এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কোটি গর্ভপাতের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। সহজ ভাষায় বলা যায়, এ পর্যন্ত পাঁচ কোটি ভ্রূণ হত্যা করা হয়েছে। আইনি বৈধতার লেবেল লাগিয়ে পাঁচ কোটি অনাগত মানব সন্তানকে পৃথিবীতে আসার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
বিশেষ ওষুধ ব্যবহারের মাধ্যমে গর্ভপাতের ঘটনাগুলো হিসাব করলে দেখা যাচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর ১০ লাখের বেশি গর্ভপাত ঘটানো হয়। এখানেও স্বার্থপরতা, ভোগ ও আরাম-আয়েশই প্রধান কারণ। গবেষণা প্রতিবেদনগুলো থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে, গর্ভাবস্থা, জন্মের সময় এবং জন্ম পরবর্তী জটিলতা এড়িয়ে চলতে তথা কথিত নির্ঝঞ্ঝাট জীবনযাপনের লক্ষ্যে ৮৬ শতাংশ গর্ভপাত ঘটানো হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গর্ভে থাকা অনাগত নিষ্পাপ শিশুকে হত্যা করাও এখন ব্যক্তি স্বাধীনতার অংশ হয়ে উঠেছে। এ ক্ষেত্রে মানবাধিকারের কোনো গুরুত্ব নেই। তবে মানব জাতির ওপর পাশ্চাত্যের যৌন স্বাধীনতার ধ্বংসাত্মক প্রভাব অন্যানৗ ক্ষেত্রেও লক্ষণীয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখন শিশুদেরকেও প্রকৃতি বিরোধী সমকামিতার দিকে আকৃষ্ট করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে এনিমেশন ফিল্ম তৈরি করা হচ্ছে। শিশুদের জন্য নির্মিত ‘ফ্রোজেন-টু’ কার্টুনে দুই সমকামী রাজকন্যার মধ্যে বিয়ের ঘটনা দেখানো হয়েছে। আর এই কার্টুনকে উৎসাহিত করে সিএনএন নিবন্ধও প্রকাশ করেছে। স্যালি কোহেনের লেখা নিবন্ধটিতে ফ্রোজেন-টু কার্টুনের প্রশংসা করা হয়েছে। শিশুদের কাছে সমকামিতাকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার লক্ষ্যে নির্মিত এই কার্টুন সম্প্রচারিত হওয়ার পর তা নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও বেশ সমালোচনা হয়েছে।
শিশুদেরকে অ্যানিমেশনের মাধ্যমে সমকামী হওয়ার জন্য উৎসাহিত করার এই প্রচেষ্টা সত্যিই নিন্দনীয়। লেখক স্যালি কোহেন পাশ্চাত্যে দুই সমকামীর পরিবারকে পারিবারিক কাঠামোর নতুন অধ্যায় হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। এটাকে তিনি একবিংশ শতাব্দীর এক নতুন ঘটনা হিসাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। কোহেনের খোড়া যুক্তিটা এমন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সমকামী পরিবার গড়ে উঠছে। এ কারণে এই বাস্তবতার সঙ্গে শিশুদেরকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে বলে তার দাবি। তার মতে, শিশুদের জানা উচিত আমেরিকায় এ ধরণের পরিবার রয়েছে। কিন্তু অস্বাভাবিক এমন পরিবারকে গ্রহণযোগ্য হিসেবে তুলে ধরার ক্ষতিকর প্রভাব তিনি বিবেচনায় নেননি। প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার আগেই শিশুদের সামনে এ ধরণের অস্বাভাবিক সম্পর্ককে স্বাভাবিক হিসেবে তুলে ধরার কারণে অনেক শিশুই বিপথে চলে যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা। ওয়াল্ট ডিজনি’র নির্মিত এনিমেশন ও কার্টুনগুলো সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত গতিতে। এ ধরণের এনিমেশন তৈরির মাধ্যমে পুঁজিবাদীরা সারা বিশ্বেই সমকামিতার মতো ঘৃণ্য সম্পর্ককে স্বাভাবিক সম্পর্ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে।
মুসলিম দেশগুলোর শিশুদের মাঝেও তা গ্রহণযোগ্য করে তোলার ষড়যন্ত্র চলছে। পাশ্চাত্যের লাইফ স্টাইলের অনুসরণকারী দেশগুলোই এসব অপসংস্কৃতির মাধ্যমে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও কানাডা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি এবং ইতালিসহ পাশ্চাত্যের বহু দেশেই সমকামিতাকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। পাশ্চাত্যে বিশেষকরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যে এই ধরণের লোকদের জন্য যে ধরণের রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়েছে তা বিস্ময়কর। এসব দেশে ব্যাপক সুযোগ-সুবিধার আওতায় এনে সমকামীর সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। এর ফলে যুক্তরাজ্যে এখন সমকামীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার দেড় শতাংশে পৌঁছেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেখানে সমকামিতার মতো বিকৃত আচরণকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেখান থেকেও সমকামীদের এনে জড়ো করা হচ্ছে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে। সহজেই তাদেরকে নাগরিকত্ব দিচ্ছে পাশ্চাত্যের দেশগুলো। একইসঙ্গে সমকামিতা-কে বৈধতা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন দেশের ওপর চাপ দিচ্ছে পাশ্চাত্য শক্তি।
২০০৪ সাল থেকে যুক্তরাজ্যে এই বিকৃত যৌনাচারে অভ্যস্তদেরকে সাধারণ দম্পতির মতো অধিকার দেওয়া হয়েছে। এই যৌন বিকৃতিটিকে একটি সাধারণ সামাজিক আচরণ হিসাবে পরিণত করার জন্য তাদেরকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। মার্কিন এবং ব্রিটিশ পাসপোর্ট থেকে পিতা-মাতা শব্দ উঠিয়ে দিয়ে অভিভাবক-১ এবং অভিভাবক-২ শব্দ যুক্ত করা হয়েছে। সমকামী দম্পতিদের কাছে শিশু দত্তক দেওয়ার জন্য এতিমখানাগুলোকে চাপ দেয়া হচ্ছে। সমকামী বিবাহ অনুষ্ঠান করার জন্য গির্জার প্রতি হাস্যকর অনুরোধ জানানো হচ্ছে। এমনকি কোনো কোনো গির্জাকে এ ধরণের আয়োজন করতে বাধ্যও করা হচ্ছে। এছাড়া দেওয়া হচ্ছে নানা ধরণের সহায়তা। তারা এই বিষয়টিকে কেবল মানবাধিকারের স্লোগানের আলোকে বিশ্লেষণ করছে। কিন্তু এই যৌন বিকৃতিকে কেন রোগ হিসেবে চিহ্নিত করে তাদেরকে চিকিৎসা সহযোগিতা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে না?
কিছু মানুষের মধ্যে এই অস্বাভাবিক প্রবণতা বা যৌন বিকৃতি নানা কারণে হয়ে থাকতে পারে, সেটা মনস্তাত্ত্বিক, শারীরবৃত্তীয় এমনকি ভারসাম্যহীনতার কারণে হয়ে থাকতে পারে। এ জন্য চিকিৎসার প্রয়োজন। মানসিক কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমেও এসব বিকৃত রুচির মানুষের মন-মানসিকতায় পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা উচিত। কিন্তু তারা এটা না করে এই বিচ্যুতিকে উত্সাহিত করছে, এর পক্ষে প্রচার চালাচ্ছে এবং সার্বিক সমর্থন ও সহযোগিতা দিচ্ছে। এমন অনেক ঘটনাই ঘটছে যে, কেবল রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার জন্য অনেকেই এমন বিকৃত যৌনাচারকে বেছে নিচ্ছে এবং নিজেদেরকে সমকামী হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে। দরিদ্র দেশগুলোর অনেকেই পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে যাওয়ার সুযোগ পেতে সমকামী হয়ে উঠছে এবং নিজেদের সমকামী প্রমাণ করে ভিসা নিচ্ছে। এটা কি সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি পৃথিবীতে বিদ্যমান সুষ্ঠু ধারার বিপরীতে বিচ্যুতি ও বিকৃতি ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা নয় ?#
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ২৩
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।