এপ্রিল ২৪, ২০২১ ১৭:৪১ Asia/Dhaka

বিশাল একটি দেশ ইরান। এ দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইতিহাস-ঐতিহ্য,পুরাতত্ত্ব আর সংস্কৃতির বিচিত্র সমৃদ্ধ উপাদান।

আমরা ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় ঐতিহাসিক প্রদেশগুলো সফর গত কয়েক  কয়েক সপ্তা আমরা বুশেহর প্রদেশের বুশেহর শহর এবং তার আশপাশের পারস্য উপসাগরীয় নীল জলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ছোঁয়ায় দীপ্ত আরও বহু নিদর্শনের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। হরমুজগান প্রদেশ থেকে পারস্য উপসাগরের উপকূলীয় পথ ধরে এগিয়ে যেতেই বুশেহর প্রদেশ মায়াবি হাতছানি দিয়ে ডেকেছে আমাদের। বু শেহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এই প্রদেশের মর্যাদা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে।

তার পাশাপাশি এখানকার তেলের খনি এবং তেল শোধনাগারও শহরটির গুরুত্ব আগের তুলনায় অনেক বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে। তাছাড়া এখন তো বিশ্ববাসী খুব ভালোভাবেই জানে যে এই বু শেহরেই রয়েছে ইরানের পারমাণবিক বিদ্যুৎ স্থাপনা। তেলের খনির সুবাদে এখানে গড়ে উঠেছে তেল, গ্যাস ও পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও। বু-শেহর শহর থেকে আট কিলোমিটার দক্ষিণে প্রাচীন একটি এলাকা রয়েছে। সমুদ্র উপকূলবর্তী ওই শহরটি ‘রেইশহর’ নামেই সবার কাছে পরিচিত। ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে ফরাসি বিখ্যাত পুরাতত্ত্ববিদ পেজারের উদ্যোগে এবং নেতৃত্বে এই রেইশহরের ওপর পুরতত্ত্ব গবেষণার কাজ হয়েছিল। রেইশহর সৈকতের মজার একটি বৈশিষ্ট্যের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে আপনাদের। তা হলো সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে শহরের উচ্চতা বেশি হবারএ কারণে এখানে যারা বেড়াতে যান কিংবা সাঁতার কাটতে যান তাদেরকে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে সমুদ্রের জলে প্রবেশ করতে হয়। আমরা এই বু শাহরের সঙ্গে আরও বেশি পরিচিত হবার চেষ্টা করবো।

বু শেহরের স্থাপত্য কাঠামো একেবারেই ভিন্নরকম। চমৎকার সব ইমারতও আছে দেখার মতো। এই অনন্য সাধারণ স্থাপত্যশৈলীর সঙ্গে পরিচিত হতে আমরা প্রথমেই যাবো শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোতে। প্রায় আটত্রিশ হেক্টর জায়গাজুড়ে এই অনন্য সাধারণ আবাসিক এলাকাটি অবস্থিত। বিখ্যাত ইরানি শাসক নাদের শাহের সময় এই শহরটি নির্মাণ করা হয়েছিল বলে ইতিহাসে পাওয়া যায়। এখানে রয়েছে বিভিন্ন দেশের বহু কূটনৈতিক স্থাপনা মানে কনস্যুলেট, রয়েছে অনেক মসজিদ, গীর্জা, প্রাচীন বাজার, চমৎকার সব অলিগলি ইত্যাদি। এগুলো যে কোনো দর্শণার্থীকেই আকৃষ্ট করে। এইসব স্থাপত্য নিদর্শনের মধ্য থেকে আমরা “কজরুনি ইমারত” নামে বিখ্যাত ভবনটি ঘুরেফিরে দেখার চেষ্টা করবো। কাজার শাসনামলে নির্মিত হয়েছে ভবনটি। ভবনটির মালিক ছিল সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ রেজা কজরুনি। বু শেহরের নামকরা একজন ব্যবসায়ী ছিল এই ভদ্রলোক। ভবনটি তিনি ইরানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংস্থাকে উপহার দিয়ে যান।

এই ভবনটির উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো তার উচ্চতা। অনেক উঁচু করে নির্মিত ঐতিহাসিক এই ভবনটির মতো আরও দুটি ভবন রয়েছে করাচি বন্দর এবং মুম্বাই বন্দরে। সব কটি ভবনই কয়েক তলা। এ কারণেই উচ্চতা বেড়ে গেছে। ভবনটির অপর একটি বৈশিষ্ট্য হলো ভেতরের আবহাওয়া ঠাণ্ডা রাখার প্রাকৃতিক কৌশল। আগেকার দিনে বু শেহরে কয়েক তলা ভবন নির্মাণের প্রচলন ছিল। এই এলাকার লোকেরা বু শেহরের অতি উষ্ণ আবহাওয়া থেকে বাঁচার কৌশল হিসেবেই ভবনের উঁচু তলাগুলো বসবাসের জন্য বেছে নিতো। ভবনের চারপাশে তৈরি করা হতো অসংখ্য জানালা। এইসব জানালা দিয়ে বাতাস এসে ঘরের ভেতরের উষ্ণ আবহাওয়াকে উপভোগ্য শীতল করে দিতো। বু শেহরের বাড়িঘরগুলো একটির সাথে আরেকটি লাগোয়া, খুব বেশি দূরত্ব নেই। কোথাও কোথাও বড়জোর এক মিটার কিংবা তার চেয়েও কম। এই ভবনটি দুই হাজার এক খ্রিষ্টাব্দে ইরানের জাতীয় ঐহিত্যের তালিকাভুক্ত হয়।

কজরুনি ইমারত নিয়ে কথা হচ্ছিলো বিরতির আগে। এই ভবন ছেড়ে আমরা এবার যাবো এখানকার আরেকটি সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক স্থাপনা ‘নৃতত্ত্ব যাদুঘর’ দেখতে। এই যাদুঘরটি মনোযোগের সঙ্গে দেখলে বু শেহরের রীতি-নীতি, আচার-প্রথাসহ এখানকার সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলোর সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ পাবো। সুতরাং দ্রুত যাওয়া যাক যাদুঘরটির দিকে। মিউজিয়াম ভবনটিও কাজার শাসনামলের। দোতলা ভবনটিতে মোট দশটি কক্ষ রয়েছে। প্রতিটি কক্ষই আলাদা আলাদা একেকটি বিভাগ। দশ বিভাগে এই প্রদেশের মানুষের বিচিত্র সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের নানাদিক প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছে। বু শেহরের ঘরবাড়ির ডিজাইন, বাজারঘাট, কৃষি সরঞ্জামাদি, মিউজিকের বিচিত্র ইনস্ট্রুমেন্ট, রান্নাবান্নার নানা তৈজস, পানির ব্যবস্থাপনা, বিয়ে-শাদিসহ অন্যান্য অনুষ্ঠানাদির ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির নিদর্শন ইত্যাদি এই যাদুঘরে পরিপাটি করে সাজিয়ে গুছিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে।

বু শেহরের স্থাপত্য শৈলীতে বিট হিলানি রীতির অনুসৃতি লক্ষ্য করা যায়। বিট হিলানি একটি প্রাচীন স্থাপত্যরীতি। বু শেহরের ভবনগুলোর বহিরাঙ্গিক তাই সাদামাটা দেখতে। সে সময় সকল বাসা বাড়িই মোটামুটি চুনা পাথর দিয়ে তৈরি করা হতো। সেইসব ভবনের দরোজা জানালাগুলো বানানো হতো সাধারণত কাঠ দিয়ে। কাঠের দরোজার উপরিভাগে অর্ধচন্দ্রাকৃতির খালি জায়গা রাখা হতো আলো প্রবেশের জন্য। ওই স্থানটিকে বিচিত্র রঙীন কাঁচ দিয়ে সাজানো হতো। এর ফলে ঘরের ভেতরে বিচিত্র রঙের আলো প্রবেশ করতো। ঘরের ছাদগুলোও সাধারণত কাঠের পাটাতন দিয়ে বানানো হতো।

যাই হোক নৃতত্ত্ব যাদুঘর ভবনটি শুরুর দিকে ছিল এখানকার সিটি কর্পোরেশনের কার্যালয়। একটা সময় তাহেরি নামের এক ভদ্রলোক ভবনটি কিনে নেয় এবং ধীরে ধীরে হস্তশিল্প, পর্যটন এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংস্থার অধীনে চলে যায়। তারপর থেকে ভবনটি তাহেরি ভবন নামে পরিচিতি পায়। তারও পরে ভবনটি যাদুঘরের মর্যাদা পায়। উনিশ শ নিরানব্বুই খ্রিষ্টাব্দে এই যাদুঘর ভবনটিও ইরানের জাতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় নিবন্ধিত হয়। #

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ২৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ