পিতার রিসালাতের অন্যতম কাণ্ডারি ছিলেন ফাতিমা (সা)
বেহেশতি নারীদের নেত্রী হযরত ফাতিমা জাহরা (সা)’র শাহাদাত-বার্ষিকী
তেসরা জমাদিউস সানি বেহেশতি নারীদের নেত্রী হযরত ফাতিমা (সালামুল্লাহি আলাইহার) শাহাদত বার্ষিকী। তাঁর শাহাদত বার্ষিকী উপলক্ষে আমরা সবাইকে জানাচ্ছি গভীর শোক ও সমবেদনা এবং বিশ্বনবী (সা) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের শানে পেশ করছি অশেষ দরুদ আর সালাম।
হাদিসে কুদসিতে বলা হয়েছে: মহান আল্লাহ যদি বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা)-কে সৃষ্টি না করতেন তাহলে তিনি কিছুই সৃষ্টি করতেন না। কেউ কেউ এরই সূত্র ধরে বা এ জাতীয় অন্য বর্ণনার ভিত্তিতে বলেন যে আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলীকে সৃষ্টি না করলে মহান আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল ও বিশ্বজগতের জন্য মহান আল্লাহর রহমত মহানবী (সা)-কেও সৃষ্টি করতেন না এবং হযরত ফাতিমাকে সৃষ্টি না করলে হযরত আলীকেও সৃষ্টি করতেন না! তাই ঘুরিয়ে বললে এটাও বলা যায় যে হযরত ফাতিমাকে আল্লাহ সৃষ্টি না করলে তিনি কিছুই সৃষ্টি করতেন না।
টাকার নোটের মধ্যে যে সুতার মত অংশটি যোগ করা হয় তা না থাকলে যেমন নোট অচল বা মূল্যহীন বলে গণ্য হয় তেমনি ফাতিমা ছাড়া আলী হয়ে পড়তেন অপূর্ণ, আলী ছাড়া মহানবী হয়ে পড়তেন অপূর্ণ ও মহানবী ছাড়া মহান আল্লাহর সৃষ্টি-জগত হয়ে পড়ত অপূর্ণ!
দুঃখজনক হলেও সত্য যে হযরত ফাতিমাকে শাহাদাত বরণ করতে হয়েছে খুব কম বয়সে এবং আরও বেশি দুঃখজনক হল তার কবরও আজও অচিহ্নিত ও রাতের আঁধারে অত্যন্ত গোপনে তাঁকে দাফন করা হয়েছিল।
মর্যাদার দিক থেকে মহামানবদের মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ স্থানে সমাসীন হযরত ফাতিমা সালামুল্লাহ আলাইহা। অর্থাৎ মহানবী (সা) ও আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলীর পরই তাঁর অবস্থান। অথচ আধুনিক যুগের মুসলিম নারী সমাজেরও এক বিশাল অংশের কাছে হযরত ফাতিমার চেয়ে বস্তুবাদী ও ভোগবাদী পশ্চিমা নারী সমাজই বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে! তাদের অনেকেই হযরত ফাতিমার নামে বা তাঁর নানা উপাধির অনুকরণে নিজ কন্যার নাম রাখতে দ্বিধান্বিত হন।
এমন কোনো নারীর কথা কি কল্পনা করা যায় যিনি তার দুই শিশু-সন্তানসহ তিন দিন ধরে ক্ষুধার্ত হওয়া সত্ত্বেও স্বামীকে খাবার সংগ্রহের কথা বলছেন না ইসলামের জন্য তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজে মনোযোগ বিঘ্নিত হবে বলে? অথবা এমন নারীর কথা কি চিন্তা করা যায় যিনি পর পর তিন দিন শুধু পানি পান করে রোজা রাখা সত্ত্বেও ইফতারের সময় ক্ষুধার্ত সাহায্যপ্রার্থীকে খাদ্য দেয়ার জন্য সেই তিন দিন কেবল পানি দিয়েই ইফতার করেন?
হযরত ফাতিমা যাহরা ছিলেন মানবজাতির চিরন্তন গৌরব ও আদর্শ মানুষের প্রতীক তথা মানবতা ও মনুষ্যত্বের পূর্ণতার অন্যতম মডেল। এ ধরনের মানুষ পৃথিবীতে জন্ম না নিলে আদর্শের দিক থেকে মানবজাতির মধ্যে বিরাজ করতো ব্যাপক অপূর্ণতা এবং আদর্শিক শূন্যতা।
হযরত ফাতিমা (আ.) রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর মেয়ে। কিন্তু এর চেয়ে বড় পরিচয় হল হযরত ফাতিমা হলেন বেহেশতের নারীদের নেত্রী এবং মহানবীর পবিত্র আহলে বাইতের শীর্ষস্থানীয় সদস্য। আর এটিই তাঁর আসল পরিচয়।
আমরা জানি যে, কেবল আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকলেই যে কেউ বেহেশতে যেতে পারবে না। যদি নবী-রাসূলগণের স্ত্রী-সন্তানও হয় তবুও না। হযরত নূহ (আ.)-এর স্ত্রী-সন্তান এবং হযরত লুত (আ.)-এর স্ত্রী জাহান্নামবাসী হয়েছে, এটি পবিত্র কুরআনেই বর্ণিত হয়েছে। বিশ্বনবীর পুত্র সন্তানরা শৈশবেই ইন্তিকাল করায় মক্কার কাফিররা যখন মহানবীকে আবতার বা নির্বংশ বলে বিদ্রূপ করতো তখন মহান আল্লাহ তাঁকে দান করেন হযরত ফাতিমা যাহরা । পবিত্র কুরআনে তাঁকে উল্লেখ করা হয়েছে 'কাওসার' হিসেবে যার অর্থ মহত্ত্ব আর নেয়ামতের চির-প্রবহমান ঝর্ণা।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) চল্লিশ বছর বয়সে রিসালাতের দায়িত্ব পালন তথা পবিত্র ইসলাম ধর্ম প্রচারের দায়িত্ব পান। ফলে মক্কার নেতৃস্থানীয় কুরাইশরা রাসূলের সঙ্গে শত্রুতা শুরু করে। আর এরিমধ্যে রাসূলের পুত্র সন্তানরা মারা গেলে কাফির-মুশরিকরা তাঁকে নিয়ে ঠাট্টা করতে থাকে। আস ইবনে ওয়ায়েল রাসূলকে ‘আবতার’ বা ‘লেজকাটা’ তথা নির্বংশ বলে গালি দেয়। সে বলত, ‘আরে মুহাম্মাদের তো কোন পুত্রসন্তান নেই, সে মরে গেলে তার নাম নেয়ার মতোও কেউ থাকবে না।’ রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এ কথায় খুব কষ্ট পেতেন। মহান আল্লাহ্ তাঁর এ কষ্ট দূর করার জন্য যে অমূল্য নেয়ামত তাঁকে দান করেন তিনিই হলেন হযরত ফাতিমা(আ.)। এর প্রেক্ষিতেই পবিত্র কুরআনে সূরা কাওসার নাযিল হয়।
মহান আল্লাহ সুরা কাওসারে বরকতময় এই জন্মের সুসংবাদ দেন এভাবে: আমরা তোমাকে কাওসার বা বরকতময় প্রস্রবণ দান করেছি। তাই তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশে নামাজ আদায় কর ও কুরবানি দাও। নিশ্চয় তোমার শত্রুরাই হচ্ছে নির্বংশ।
আল্লামা ফখরুদ্দীন রাযী বলেছেন, হযরত ফাতিমার শানে এ সূরা নাযিল হয়েছে। তিনি এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, অনেক অত্যাচার সত্ত্বেও হযরত ফাতিমার বংশধারা পৃথিবীতে টিকে আছে, অন্যদিকে বনু উমাইয়্যা ধ্বংস হয়ে গেছে।
অবশ্য পরবর্তী যুগে বনু আব্বাসও রাসূলের পরিবারের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়েছিল। অবশেষে তারাও ধ্বংস হয়ে গেছে। রাসূলের বংশধরদের নিশ্চিহ্ন করার সব ধরনের চেষ্টা করেও তারা সফল হয়নি। আবু জেহেল, আবু সুফিয়ানরা চেয়েছিল রাসূলকে হত্যা করতে, আবু সুফিয়ানের সন্তান মুআবিয়া চেয়েছিল হযরত আলীকে হত্যা করতে, তার রাজত্বকালেই ইমাম হাসানকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়, মুআবিয়ার ছেলে ইয়াযীদ কারবালায় নৃশংসভাবে ইমাম হুসাইনকে সপরিবারে শহীদ করে। পরবর্তীকালে একের পর এক রাসূলের বংশধরকে হত্যা করা হয়। তারপরও পুত্রসন্তান নিয়ে গর্বিতদের কোন খবর আজ বিশ্ববাসী জানে না, অথচ রাসূলের বংশধারা হযরত ফাতিমার মাধ্যমে কিয়ামত পর্যন্ত বজায় থাকবে। এ বংশধারাতেই ইমাম মাহদী (আ.) আবির্ভূত হয়ে সারা বিশ্বে আল্লাহর ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করবেন।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সকল নারীর সন্তানদের তাদের পুরুষদের সাথে সংযুক্ত করা হয় শুধু ফাতিমা ছাড়া। ফাতিমার সন্তানদের আমার সাথে সম্পর্কিত করা হয়েছে।’
আর সেজন্যই আমরা ইতিহাসে দেখতে পাই যে, হযরত ফাতিমার সন্তানদের মানুষ ‘ইয়াবনা রাসূলিল্লাহ’ অর্থাৎ ‘হে রাসূলের সন্তান’ বলে সম্বোধন করত।
হযরত ফাতিমার জন্মের মাধ্যমে মহানবী অপরিসীম মানসিক শান্তি অনুভব করেন। তিনি তাঁকে কতটা ভালবাসতেন তা তাঁর কথায় বারবার প্রকাশিত হয়েছে। হযরত ফাতিমার খোদা-প্রেম ও তাকওয়া, তাঁর দুনিয়াবিমুখতা, তাঁর দায়িত্বশীলতা সব মিলিয়ে মহান আল্লাহর কাছে তাঁর যে অবস্থান সে কারণেই রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁকে ভালবাসতেন। হযরত ফাতিমা রাসূলুল্লাহ্(সা.)-এর কাছে আসলে তিনি তাঁকে দাঁড়িয়ে সম্ভাষণ জানাতেন। এ ছিল বেহেশতের নারীদের নেত্রীর প্রতি মহান আল্লাহর রাসূলের সম্মান ও ভালবাসা প্রদর্শন।
মহানবী যখন কোনো সফরে যেতেন তখন সর্বশেষে বিদায় নিতেন ফাতিমার (সা. আ) কাছ থেকে। আর সফর থেকে ফেরার পর সবার আগে দেখা করতেন ফাতিমার সঙ্গে।
পবিত্র কুরআনের সুরা নুরে বিশ্বনবী (সা)-কে সাধারণ মানুষের মত আহ্বান বা সম্বোধন নিষিদ্ধ করা হলে হযরত ফাতিমা (সা)ও বিশ্বনবীকে ইয়া রাসুলুল্লাহ বলতে থাকেন। কিন্তু মহানবী (সা) তাঁকে বলেন, এ আয়াতটি তোমার ও তোমার সন্তান এবং তোমার বংশধরদের উদ্দেশ্যে নাজিল হয়নি। তুমি বরং আমাকে আগের মতই বাবাজান বলবে! কারণ, এ আহ্বান আমার হৃদয়কে করে প্রশান্ত ও আল্লাহকে করে সন্তুষ্ট ।
হযরত ফাতিমা এমন সময় জন্মগ্রহণ করেন যখন সারা বিশ্বে নারীদের মানুষ বলে ধরা হত না। তারা ছিল নানাভাবে নির্যাতিত। খ্রিস্টানরা নারীকে বলত ‘শয়তানের দোসর’ ও সব পাপের উৎস ! আরবরা কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দিত। হযরত ফাতিমা সেই অবস্থায় জন্ম নিয়ে মহানবীর মাধ্যমে নারী জাতিকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেন। মহানবী প্রথমে তাঁর স্ত্রী হযরত খাদীজার প্রতি সম্মান দেখিয়ে নারী জাতিকে করেন সম্মানিত; পরে নিজ কন্যা ফাতিমার প্রতি দায়িত্ব পালন করেও নারীদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেন।
মহানবী (সা.) তাঁর কন্যাসন্তানের নাম রাখেন ফাতিমা। ‘ফাত্ম’ শব্দের অর্থ রক্ষা করা। আর এই নামকরণ সম্পর্কে মহানবী বলেন : ‘তার নামকরণ করা হয়েছে ফাতিমা। কেননা, আল্লাহ তাঁকে ও তাঁর অনুসারীদের জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত রেখেছেন।
ধর্ম প্রচারের কারণে রাসূলের ওপর কুরাইশরা নানাভাবে নির্যাতন শুরু করে। এভাবে হযরত ফাতিমার দুই বছর অতিক্রান্ত হয়। হযরত ফাতিমার জন্মের মাত্র দুই বছর পর মুসলমানরা সবচেয়ে কঠিন অবস্থায় পড়েন। বনু হাশিমের সাথে কুরাইশরা সকল সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দেয়। দিনের পর দিন তাঁদেরকে না খেয়ে থাকতে হত। হযরত ফাতিমা শিশু বয়সেই এমন এক অবস্থার মধ্যে পড়েন। দীর্ঘ তিন বছর তাঁরা এ অবস্থার মধ্যে কাটান। অবশেষে তিন বছর পর তাঁরা এ অবরোধ থেকে বেরিয়ে আসেন। কিন্তু সেই বছরই হযরত ফাতিমার প্রাণপ্রিয় মা খাদিজা (সা.আ) ইন্তেকাল করেন।
যে বয়সে শিশু ফাতিমার মাতৃস্নেহের প্রয়োজন, যে বয়সে তাঁর লালিত-পালিত হওয়ার কথা সে বয়সেই উল্টো তাঁর ওপর রাসূলের দেখাশুনার গুরুদায়িত্ব এসে পড়ে। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র পাঁচ। তিনি রাসূলকে মায়ের মতোই যত্ন করতেন, তাঁর দিকে খেয়াল রাখতেন। শুধু ঘরের মধ্যে নয়, ঘরের বাইরেও তিনি রাসূলের বিষয়াদির প্রতি লক্ষ্য রাখতেন। তিনি রাসূলের প্রতি এতটাই যত্নশীল ছিলেন যে, মহানবী তাঁকে ‘উম্মু আবিহা’ তথা ‘তাঁর পিতার মা’ বলে আখ্যায়িত করেন।
দ্বিতীয় হিজরিতেই হযরত ফাতিমার সাথে হযরত আলীর বিয়ে হয়। অনেক খ্যাতনামা সাহাবী হযরত ফাতিমাকে বিয়ে করার জন্য রাসূলের কাছে প্রস্তাব দেন। কিন্তু আল্লাহর রাসুল তাঁদের কারও প্রস্তাবই গ্রহণ করেননি। তিনি বলেন, ‘ফাতিমার বিয়ে মহান আল্লাহর নির্দেশে সম্পন্ন হবে।’ ফাতিমা (সা আ)র বিয়ের জন্য হযরত আলী (আ)র ঢালকে মোহরানা ধার্য করা হয়। এর মূল্য ছিল সর্বোচ্চ ৫০০ দিরহাম। অবশ্য ফাতিমা জাহরা বাবাকে অনুরোধ করেন যে, তাঁর দেন-মোহরকে কিয়ামতের দিন উম্মতের পাপী বান্দাদের মুক্তিপণ নির্ধারণ করা হোক। তাঁর এ আবেদন আল্লাহ কবুল করেছেন বলে জিব্রাইল সুসংবাদ নিয়ে আসেন।
যে কোনো নারীর জন্য বিয়ের পোশাক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু হযরত ফাতিমা (সা. আ) একজন দরিদ্র নারীর অনুরোধে নিজের বিয়ের জন্য কেনা পোশাকটি তাকে দান করে দিয়েছিলেন। মহানবী (সা.) হযরত ফাতিমার মর্যাদা সম্পর্কে বলেছেন: ‘চারজন নারী সমগ্র নারী জাতির মধ্যে সর্বোত্তম : মারিয়াম বিনতে ইমরান, আছিয়া বিনতে মুযাহিম, খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ এবং ফাতিমা বিনতে মুহাম্মাদ। তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে ফাতিমা।’ রাসূল (সা.) বলেন, ‘বেহেশতে সর্বপ্রথম আমার কাছে যে পৌঁছবে সে হচ্ছে ফাতিমা বিনতে মুহাম্মাদ।’ বুখারীর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল (সা.) বলেন, ‘ফাতিমা আমার অস্তিত্বের অংশ। যে তাকে রাগান্বিত করে সে আমাকে রাগান্বিত করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ফাতিমা কোন ব্যাপারে রাগান্বিত হলে আল্লাহ্ও রাগান্বিত হন এবং ফাতিমার আনন্দে আল্লাহ্ও আনন্দিত হন।’ পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে,যারা আল্লাহ ও রাসূলকে পীড়া দেয়, আল্লাহ তাদের দুনিয়া ও আখেরাতে অভিশপ্ত করেন এবং তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি।’ আরেকটি আয়াতে বলা হয়েছে : ‘...এবং যারা আল্লাহর রাসূলকে যাতনা দেয়, তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি।’
অনেকেই মনে করেন প্রিয় কন্যা ফাতিমাকে নিজের দেহের অংশ বলে মহানবী (সা) এটাও বুঝিয়েছেন যে পিতার রিসালাতের অন্যতম কাণ্ডারি ছিলেন ফাতিমা। এই মহীয়সী নারীর অনন্য ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সেবা না থাকলে ইসলাম বিলুপ্ত হয়ে যেত।
হযরত ফাতিমা জাহরা (সা.আ) ছিলেন গোটা মানব জাতির জন্য অসাধারণ ত্যাগ,বিশ্বস্ততা, অন্যায়ের ব্যাপারে আপোষহীনতা, সততা, দানশীলতা, ধৈর্য, চারিত্রিক পবিত্রতা, লজ্জাশীলতা ও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্টিসহ অনেক মহৎ গুণের আদর্শ। আর এ জন্যেই তাঁর উপাধি ছিল আস-সিদ্দিক্বা বা সত্য-নিষ্ঠ, আল-মুবারাকাহ বা বরকতপ্রাপ্ত, আত-ত্বাহিরা বা পবিত্র, আল-মারজিয়া বা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট, বাতুল বা শ্রেষ্ঠত্বের ক্ষেত্রে অতুলনীয় আদর্শ, আজ জাকিয়া বা সতী, মুহাদ্দিসাহ বা হাদিসের বর্ণনাকারী, সাইয়্যিদাতুন নিসায়িল আলামিন বা নারীকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, খাতুনে জান্নাত বা বেহেশতি নারীদের নেত্রী, আজ জাহরা বা দ্যুতিময় ইত্যাদি। হযরত ফাতিমা যখন নামাজের জন্য দাঁড়াতেন তখন তাঁর জ্যোতি আকাশের ফেরেশতা ও অন্যান্যদের দিকে ছড়িয়ে পড়ত। আর এ কারণে তাঁকে জাহরা উপাধি দেয়া হয়। রাসুল (সা)’র ওফাতের পর তাঁকে সান্ত্বনা দিতে আসতেন ওহির ফেরেশতা। ওহির ফেরেশতা তাঁকে ভবিষ্যৎ বিষয়ে অনেক কিছু জানান। আর তার থেকে সেসব বিষয় লিখে রাখেন হযরত আলী (আ)। আর এ জন্যই ফাতিমাকে বলা হয় মুহাদ্দিসা।
হযরত ফাতিমা খুবই সাধারণ জীবন যাপন করতেন। সংসারের যাবতীয় কাজ তিনি নিজের হাতে করতেন। মশক দিয়ে পানি তোলার ফলে তাঁর শরীরে দাগ পড়ে গিয়েছিল। তিনি যাঁতার মাধ্যমে এত পরিমাণ আটা তৈরি করতেন যে, তাঁর হাতে ফোস্কা পড়ে যেত। আর তিনি সেই আটা দিয়ে রুটি তৈরি করে মদীনার দরিদ্র ব্যক্তিদের মধ্যে বিতরণ করতেন। হযরত ফাতিমা কাপড়ে তালি লাগিয়ে সেই কাপড় পরতেন। পার্থিব কোন বস্তুই তাঁকে আকৃষ্ট করতে পারত না। আর এজন্যই রাসূল (সা.) তাঁকে ‘বাতুল’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।
হযরত ফাতিমা সারারাত জেগে নামায পড়তেন, মহান আল্লাহর যিকির করতেন এবং রাসূলুল্লাহ'র (সা.)- উম্মতের জন্য দো‘আ করতেন। তিনি এত বেশি নামায পড়তেন যে, তাঁর পা ফুলে যেত। সংসারের কাজ করার সময়ও তাঁর মুখে আল্লাহর যিকির থাকত। রাসূলের সম্মানিতা স্ত্রী হযরত উম্মে সালামাহ্ বলেন : রাসূলের ওফাতের পর ফাতিমাকে দেখতে যাই এবং তাঁর অবস্থা জানতে চাই। তিনি জবাব দিলেন : অত্যন্ত দুঃখ-কষ্টে দিন অতিবাহিত হচ্ছে। -এ রকম কষ্টের মধ্য দিয়েই রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ওফাতের অল্প কিছুদিন পরই হযরত ফাতিমা এ পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণ করেন। হযরত ফাতিমার বয়স তখন খুব বেশি ছিল না, আবার তিনি কোনরকম অসুস্থতায়ও ভুগছিলেন না, তবে কেনো তিনি মৃত্যুবরণ করলেন? রাসূল (সা.) ওফাতের আগে হযরত ফাতিমার কানে কানে বলে গিয়েছিলেন যে, তিনিই তাঁর সাথে প্রথম মিলিত হবেন। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় রাসূলকে কন্যার শাহাদাতের খবর দিয়েছিলেন। আর সেজন্যই কি রাসূল (সা.) বারবার তাঁর উম্মতকে সতর্ক করছেন যে, তারা যেন হযরত ফাতিমাকে কষ্ট না দেয়, তাঁকে অসন্তুষ্ট না করে?
হযরত ফাতিমা জাহরা (সা. আ)’ পিতার শারীরিক বিদায়ের চেয়েও বেশি দুঃখ-কাতর হয়েছিলেন পিতার আদর্শ তথা ইসলামের শিক্ষা ম্লান ও বিকৃত হয়ে পড়ার নানা অশুভ লক্ষণ দেখে। রাসুলে খোদার কাছেই তিনি শুনেছিলেন তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের ওপর অনেক মুসিবত তথা ইসলামের ওপরই অনেক দুর্যোগ নেমে আসবে। আর সেইসব বিপদের মুকাবিলা করার মত কঠিন ধৈর্যের খোদায়ী পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হয়েছিলেন সর্বকালের সেরা মহামানবী হযরত ফাতিমা জাহরা (সা. আ) ঠিক যেভাবে সিফফিন ও কারবালা প্রান্তরসহ যুগে যুগে নানা বিপদ, সংকট ও শত্রুতার মোকাবেলায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন বিশ্বনবী (সা)’র পবিত্র আহলে বাইতের অন্যান্য সদস্য। কোনো কোনো ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী রাজনৈতিক কারণে হযরত ফাতিমাকে আহত করা হয়েছিল ক্ষমতাসীন মহলের পক্ষ হতে এবং পরবর্তীকালে এ আঘাতজনিত কারণেই তিনি শাহাদাত বরণ করেন।
অনেকেই মনে করেন শত্রুতার প্রেক্ষাপটে হযরত ফাতিমা (সা)-কে দাফন করা হয়েছিল মধ্যরাতে গোপনীয়ভাবে অতি গোপন স্থানে যা আজো গোপন রয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত গোপন থাকবে। হযরত ফাতিমার ওসিয়ত অনুযায়ী গোপনীয়তা বজায় রাখতে তাঁর দাফনেও অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানানো হয় মাত্র কয়েকজন অতি ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিকে। মুসলমানদের মধ্য থেকে বিশ্বনবীর আহলে বাইতের অতি ঘনিষ্ঠ ওই কয়েকজন ব্যক্তি দাফনে অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন।
ফাতিমা (সা) জানতেন কখন তাঁর মৃত্যু হবে। আর এ জন্য তিনি নিজে গোসল করে নতুন ও পরিষ্কার পোশাক পরে কিবলামুখী হয়েছিলেন।
তিনি নিজের মৃত্যু কবে হবে এবং তাঁর দুই প্রিয় সন্তান হাসান ও হুসাইন (আ.) কিভাবে মারা যাবেন সেই তথ্যসহ ভবিষ্যৎ ইতিহাসের অনেক খবর রাখতেন। হুসাইন (আ.)'র হত্যাকারীদের অভিশাপ দিয়ে গেছেন তিনি।
মদিনার নারী সমাজ ধর্মীয় বিষয়সহ নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করত ফাতিমা (সা.আ.)'র কাছ থেকে। ফাদাক ও মানজিল শীর্ষক তাঁর ভাষণ এই মহামানবীর অতুল জ্ঞান, খোদাভীরুতা এবং দূরদর্শিতাকেই তুলে ধরে। বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন, মহান আল্লাহ আলী, তাঁর স্ত্রী ও তাঁদের সন্তানদেরকে মানুষের জন্য হুজ্জাত বা দলিল করেছেন এবং তাঁরা হল জ্ঞানের দরজা।
নবী-নন্দিনী (সা:) বলেছেন, পৃথিবীতে তিনটি জিনিস আমার খুবই প্রিয়। আল্লাহর পথে ব্যয়, রাসূলে খোদা (সা.)র চেহারার দিকে তাকানো এবং পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত। পবিত্র কোরআনের আয়াত শ্রবণ মুসলমানদেরকে মুক্তির তীরে পৌঁছে দেয়।
হযরত ফাতিমা (সা. আ.) রাসূল (সা.)'র উম্মতের উদ্দেশে বলেছেন: আল্লাহ ঈমানকে তোমাদের জন্য শিরক হতে পবিত্র হওয়ার ও নামাজকে অহংকার থেকে পবিত্র হওয়ার এবং আমাদের আনুগত্যকে করেছেন ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যম। এ ছাড়াও মহান আল্লাহ আমাদের নেতৃত্বকে করেছেন অনৈক্যের পথে বাধা। আর তিনি আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্বকে করেছেন ইসলামের জন্য সম্মানের মাধ্যম ।
হযরত ফাতিমা বলেছেন, আল্লাহর সেবায় মশগুল হয়ে যে সন্তুষ্টি পাই তা আমাকে অন্য সব সন্তুষ্টি বা আনন্দ থেকে বিরত রাখে এবং সব সময় মহান আল্লাহর সুন্দর দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ রাখার প্রার্থনা ছাড়া আমার অন্য কোনো প্রত্যাশা নেই।
তিনি বলেছেন, নারীদের জন্য সর্বোত্তম বিষয় হচ্ছে, তারা যেন কোনো অচেনা পুরুষকে না দেখে এবং কোনো অচেনা পুরুষও তাদের না দেখে।
ফাতিমা বা তাঁর বংশধরদের কেউই ঐশী সম্মানকে পার্থিব ভোগের কাজে লাগান নি। আত্মত্যাগের বিশালত্বে ফাতিমা এবং তাঁর বংশধররা ইতিহাসে অনন্য। হজরত ফাতিমা(সা) আদর্শ মানবাত্মার প্রতীক। তাঁর প্রতি জানাচ্ছি অশেষ দরুদ ও সালাম। হযরত ফাতিমা (সালা.)'র শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষে বিশ্বনবী (সা.) ও তাঁর পবিত্র বংশধর, বিশেষ করে ফাতিমা (সা)’র প্রতি অশেষ দরুদ ও সালাম পাঠানোর পাশাপাশি সবাইকে আবারও শোক ও সমবেদনা জানাচ্ছি আজকের এই গভীর শোকের দিনে। #
পার্সটুডে/এমএএইচ/২৬
খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন