ইমামের কর্তিত শির মুবারক তাঁর শাহাদতের পর চল্লিশতম দিনে পুনরায় শরীরে যুক্ত করা হয়
শহীদ-সম্রাটের চিরঞ্জীব শাহাদাতের চেহলাম বা আরবাইন (চল্লিশা)
পবিত্র বিশে সফর তথা হযরত ইমাম হুসাইন (আ)'র শাহাদাতের চল্লিশা বা চেহলাম বার্ষিকী উপলক্ষে গভীর শোক ও সমবেদনা জানাচ্ছি সবাইকে এবং এই মহামানব, তাঁর পবিত্র পূর্বপুরুষগণ, বংশধর ও কারবালায় শহীদ তাঁর ৭২ সঙ্গীর প্রতি জানাচ্ছি অশেষ সালাম ও দরুদ।
অনেকেই প্রশ্ন করেন কেন ইসলামের মহাপুরুষদের মধ্য থেকে তাঁদের জন্ম, ওফাত বা শাহাদতের বার্ষিকী পালন করা হলেও একমাত্র ইমাম হুসাইন (আ.)’র জন্ম ও শাহাদতের বার্ষিকী ছাড়াও তাঁর শাহাদতের চেহলামও পালন করা হয়?
পবিত্র কুরআন ও হাদিসের আলোকে চল্লিশ সংখ্যাটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। (আরাফ:১৪২) মহানবী (সা.) বলেছেন: 'যে কেউ চল্লিশ দিনরাত আল্লাহর জন্য ইবাদত করে অর্থাৎ এ সময়ে তার মধ্যে যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্য না থাকে তবে আল্লাহ সে ব্যক্তির অন্তঃকরণ থেকে হিকমত ও জ্ঞানের এক ফল্গুধারা তার জিহ্বায় প্রবাহিত করেন।' কোনো কোনো হাদিসে এসেছে- 'যদি কোনো মৃত ব্যক্তির জন্য চল্লিশ জন মুমিন দোয়া করে তবে আল্লাহ তাঁদের দোয়ার বরকতে ঐ মৃত ব্যক্তিকে ক্ষমা করে দেন।' এ ছাড়াও হাদিসে বলা হয়েছে: 'চল্লিশ বছর বয়সে মানুষের বুদ্ধি পরিপক্বতা লাভ করে।' একজন মুমিনের মৃত্যুতে জমিন চল্লিশ প্রভাত শোক প্রকাশ করে বলেও হাদিসের বর্ণনা রয়েছে।
মানবজাতির ইতিহাসে ইমাম হুসাইন (আ)'র শাহাদাতের মত শোকাবহ কোন শাহাদাত নেই। তাই এ শাহাদাতের ঘটনা সময়ের সীমাকে পেরিয়ে অমরত্বের বৈশিষ্ট্য লাভ করেছে। স্বয়ং ইমাম হাসান (আ) ইমাম হুসাইনকে (আ)বলেছেন: 'হে হুসাইন, তোমার শাহাদাতের দিনের মতো কোন শোকাবহ দিন নেই।' আর এ জন্যই ইমাম হুসাইনের রক্ত-রঞ্জিত শাহাদতের চৌম্বকীয় আকর্ষণে তাঁর পবিত্র রক্তের শোকে মানবজাতির কয়েক সাগর বা মহাসাগর পরিমাণ শোকের অশ্রু কিয়ামত পর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে ইসলামকে চির-উন্নত রাখার প্রেরণা যুগিয়ে যাবে। ইমাম হুসাইন (আ.)'র শাহাদাতের চেহলাম পালনের উদ্দেশ্য হলো এ মহান ইমামের সেই অমর ত্যাগ ও বিপ্লবের শিক্ষাকে চির-জাগরূক রাখা। আর ইমাম হুসাইনের বিপ্লবের মধ্যে প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা অর্থাৎ ন্যায়পরায়ণ ও সত্যপন্থী নেতাদের শাসন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন লুকিয়ে রয়েছে বলে আমরা ইমাম হুসাইনকে যত বেশি স্মরণ করব তত বেশি ইসলামকে চিনতে পারব ও তা প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্বুদ্ধ হব। এ কারণেই আমরা দেখি কুরআনে বার বার বিভিন্ন নবীর জীবনী ও তাদের কর্ম সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করার জন্য রাসূল (সা.)কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
'জিয়ারতে ওয়ারিস' নামে প্রসিদ্ধ জিয়ারতে ইমাম হুসাইনকে সকল নবীর ওয়ারিস বলা হয়েছে। সুতরাং তাঁর চেহলাম পালন ও তাঁর স্মরণের মধ্যে যেন সকল নবীর স্মরণ নিহিত রয়েছে। ইসলাম টিকে থাকার অর্থ সব নবীর মর্যাদা রক্ষা। ইমাম হুসাইন তাঁর আন্দোলনের মাধ্যমে সব নবীর মর্যাদাকে রক্ষা করেছেন।-বাইবেলের পুরনো ও নতুন পুস্তকে নবীদের যে রকম মন্দভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে তা লক্ষ্য করুন। রাসূল (সা.), হজরত মূসা (আ.), হজরত দাউদ (আ.) ও অন্যান্য নবি সম্পর্কে আমরা বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে এমন কিছু অবমাননাকর বর্ণনা দেখতে পাই যেগুলো ইহুদীরা ইসলামের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে। বনি উমা্ইয়ার শাসনামলে তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এ বিকৃতি ঘটেছে। কারণ তারা চেয়েছে নবীদের মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করে নিজেদের পর্যায়ে নামিয়ে এনে রাসূল (সা.) এর স্থলাভিষিক্ত খলিফা হিসাবে নিজেদের বৈধতাকে প্রমাণ করতে। ইমাম হুসাইন তাদের এ অপচেষ্টাকে প্রতিহত করেছেন। যদি ইমাম হুসাইন তাদের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়াতেন তবে ইসলামও আজ ইহুদী ও খ্রিস্টবাদের পরিণতি বরণ করতো। তাই প্রকৃতপক্ষে বলা যায় ইমাম হুসাইন কারবালায় ইসলামকে রক্ষার মাধ্যমে সব নবীর মর্যাদাকে রক্ষা করেছেন। এটিই তাঁর চেহলাম পালনের বিশেষত্ব।
শহীদ সম্রাট ইমাম হুসাইন (আ) এমন এক বিশাল ব্যক্তিত্বের নাম দিনকে দিন বিশ্বজুড়ে বাড়ছে যার নুর ও বহুমুখী আকর্ষণ। ইমাম হুসাইন (আ) সম্পর্কে বিশ্বনবী (সা) বলেছেন, হুসাইন আমার থেকে এবং আমি হুসাইন থেকে। তিনি আরও বলেছেন, হুসাইন আমার সন্তান,আমার বংশ ও মানবজাতির মধ্যে তাঁর ভাই হাসানের পর সে-ই শ্রেষ্ঠ। সে মুসলমানদের ইমাম, মুমিনদের অভিভাবক, জগতগুলোর রবের প্রতিনিধি বা খলিফা, ... সে আল্লাহর হুজ্জাত বা প্রমাণ পুরো সৃষ্টির ওপর, সে বেহেশতি যুবকদের সর্দার, উম্মতের মুক্তির দরজা। তাঁর আদেশ হল আমার আদেশ। তাঁর আনুগত্য মানে আমারই আনুগত্য করা। যে-ই তাঁকে অনুসরণ করে সে আমার সাথে যুক্ত হয় এবং যে তাঁর অবাধ্য হয় সে আমার সঙ্গে যুক্ত হতে পারে না। মহানবী আরও বলেছেন, নিশ্চয়ই হুসাইন বিন আলীর মূল্য আকাশগুলো ও জমিনগুলোর চেয়ে বেশি এবং নিশ্চয়ই তাঁর বিষয়ে আল্লাহর আরশের ডান দিকে লেখা আছে : হেদায়াতের আলো, নাজাতের নৌকা, ... মর্যাদা ও গৌরবের উৎস, এক সুউচ্চ বাতিঘর এবং মহামূল্যবান সম্পদ।
ইমাম হুসাইন (আ)'র জন্মের পর এই নবজাতক শিশু সম্পর্কে বিশ্বনবী বলেছিলেন, 'হে ফাতিমা! তাঁকে নাও। নিশ্চয়ই সে একজন ইমাম ও ইমামের সন্তান। সে নয়জন ইমামের পিতা। তাঁরই বংশে জন্ম নেবে নৈতিক গুণ-সম্পন্ন ইমামবৃন্দ। তাঁদের নবম জন হবেন মাহদি।' ইমাম হুসাইনের মহাবিপ্লবের কারণে ইসলাম বিকৃতি ও বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে বলেই মহানবী (সা) নিজেকে তাঁর নাতির থেকে বলে সম্মান জানিয়েছেন। ইমাম হুসাইনের জন্য শোক প্রকাশ প্রসঙ্গে বিশ্বনবী (সা) বলেছেন, নিশ্চয়ই প্রত্যেক মু'মিনের হৃদয়ে হুসাইনের শাহাদতের ব্যাপারে এমন ভালবাসা আছে যে তার উত্তাপ কখনো কমবে না। তিনি আরও বলেছেন, 'নিশ্চয়ই সমস্ত চোখ কিয়ামতের দিন কাঁদতে থাকবে, কেবল সেই চোখ ছাড়া যা হুসাইনের বিয়োগান্ত ঘটনায় কাঁদবে, ঐ চোখ সেদিন হাসতে থাকবে এবং তাকে জান্নাতের সুসংবাদ ও বিপুল নেয়ামত দান করা হবে।'
ইসলামের শত্রুরা মহানবীর (সা) পবিত্র আহলে বাইতকে ও তাঁদের পবিত্র নামকে ইতিহাস থেকে মুছে দিতে চেয়েছিল চিরতরে। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে এর উল্টো। কারণ, মহান আল্লাহ নিজেই তাঁর ধর্মের নুরকে রক্ষার অঙ্গীকার করেছেন এবং এই আলোকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা কাফির-মুশরিকদের কাছে যতই অপছন্দনীয় হোক না কেন। বর্তমান যুগে বিভিন্ন মুসলিম মাজহাবের কোটি কোটি শোকার্ত মানুষ ইমাম হুসাইনের চেহলাম-বার্ষিকী পালন করছেন এবং ইমামের বন্দি কাফেলার পদযাত্রার স্মরণে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শত শত মাইল পথ হেঁটে কারবালায় যাচ্ছেন। এমন পদযাত্রা অতীতেও ছিল। ইমাম জাফর আস সাদিক (আ) বলেছেন, ইমাম হুসাইনের মাজার জিয়ারতের উদ্দেশ্যে যে ঘর থেকে বের হয়ে হাঁটতে থাকে তাঁর প্রত্যেক পদক্ষেপের জন্য একটি সাওয়াব লেখা হয় ও একটি করে পাপ ক্ষমা করা হয়। এমনকি বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী অনেক অমুসলমানও ইমাম হুসাইনের জন্য শোক প্রকাশ করছেন । ইমাম হুসাইন (আ) গোটা মানবতার জন্য গর্ব ও গৌরবের প্রতীক, কারণ তিনি অন্যায় ও অসত্যের মোকাবেলায় সত্যের পক্ষে চরম আত্মত্যাগের আদর্শ।
ইমাম জাফর আস সাদিক (আ) বলেছেন, 'আমাদের ওপর তথা মহানবীর আহলে বাইতের ওপর যে জুলুম করা হয়েছে তার কারণে যে শোকার্ত তাঁর দীর্ঘশ্বাস হল তাসবিহ এবং আমাদের বিষয়ে তাঁর দুশ্চিন্তা হল ইবাদাত।... হাদিসটি বর্ণনা শেষে তিনি বলেছেন, নিশ্চয়ই এ হাদিসটি স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখা উচিত। ইমাম হুসাইনের পবিত্র মাজার জিয়ারতের সাওয়াব শত শত হজের সাওয়াবের চেয়েও বেশি বলে বর্ণনা রয়েছে। ইমাম হুসাইন (আ.)-এর সপরিবারে শাহাদাত বরণের জন্য শোক ও মাতম করার মূল প্রোথিত রয়েছে ইতিহাসের গভীরে। মহান আম্বিয়ায়ে কেরাম, এমনকি আসমানের ফেরেশতাকুলও নিজ নিজ পন্থায় এ শহীদ ইমামের জন্যে মাতম করেছেন। রেওয়ায়েত অনুযায়ী আশুরার ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পরে চারদিকে আঁধার নেমে আসে এবং কারবালার আকাশ কালো ধুলোয় ভরে যায়। আর সেখানকার নুড়ি পাথরগুলো, এমনকি পানির মাছগুলো চল্লিশ দিন ধরে ইমামের শোকে ক্রন্দন করতে থাকে। তারিখে ইবনে আসিরের তৃতীয় খণ্ডের ২৮৮ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মুসিবতে আকাশ চল্লিশ দিন ধরে ক্রন্দন করে।’
হযরত ইমাম হুসাইন (আ)'র জন্য বিশ্বনবী (সা) ছাড়াও হযরত আদম (আ) ও হযরত জাকারিয়া নবীর মত মহান নবীদের আগাম ক্রন্দনের কথা জানা যায় ইসলামী বর্ণনায়। হযরত জাকারিয়া (আ) কারবালার শোকাবহ ঘটনাগুলো জানতে পেরে এতোই ব্যথিত হন যে তিনি কয়েক দিন ধরে ইবাদতের ঘর থেকে বের হননি এবং লোকজনকেও ওই কয়েক দিনের জন্য নিষেধ করে দেন তাঁর সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করতে। তিনি ইমাম হুসাইনের শাহাদতের স্মরণে কান্না করে মহান আল্লাহর কাছে বলেন: হে আল্লাহ আপনি আপনার নবী মুহাম্মাদ মুস্তাফার হৃদয়কে পরীক্ষা করবেন মুসিবত ও শোকের মাধ্যমে যাতে বিশ্বের জনগণের কাছে ইসলামের নীতিমালা ও বিধান ছড়িয়ে দেয়া যায়! ইমাম আলী আর ফাতিমাও শোক প্রকাশ করবেন ও ইমাম হুসাইনের শাহাদতের কারণে তাঁরা কালো পোশাক পরবেন।–
ইমাম হুসাইন (আ.) এর জন্য শোক পালন একটি প্রাচীন রীতি এবং আল্লাহ্ ও রাসূল (সা.)-এর পক্ষ থেকে প্রবর্তিত বিষয়। যেমন রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ইমাম হুসাইনের ঠোঁটে এবং গলায় চুম্বন দিতেন এবং কাঁদতে কাঁদতে বলতেন : ‘আমি তলোয়ারের জায়গাগুলোতে চুম্বন করছি।’ ইবনে আসিরের বর্ণনা অনুযায়ী হযরত আলীও মাতম ও ক্রন্দন করেছেন। এছাড়াও মা ফাতিমা যাহ্রা মহানবীর কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে ইমাম হুসাইনের দোলনা দোলানোর সময় থেকে নিজের শাহাদাতের মুহূর্ত পর্যন্ত সবসময় হুসাইনের মজলুম হওয়া ও নির্মমভাবে শহীদ হবার কথা স্মরণ করে কাঁদতেন। আর কন্যা যাইনাবকে উপদেশ দিতেন যাতে তিনি সেই দুঃসময়ে তাঁর ভাইয়ের সঙ্গী হন। ইমাম হুসাইন (আ) নিজেও একাধিকবার কারবালার পথ অতিক্রম করার সময় মহা বিপদ সংঘটিত হওয়া মর্মে তাঁর প্রিয় নানা ও পিতার ভবিষ্যদ্বাণীর আলামতগুলো দেখে কেঁদেছিলেন। আশুরার রাতে সঙ্গী-সাথী ও পরিবারবর্গের মাঝে শোক অনুষ্ঠান করেন, সন্তানদের থেকে বিদায় নেন। তিনি বনি হাশিমের একেক জন যুবকের মুখের দিকে তাকাচ্ছিলেন এবং কাঁদছিলেন।
ইমাম হুসাইন (আ) পবিরারবর্গকেও বলেছিলেন তাঁর জন্য কাঁদতে। বিশেষ করে বোন যাইনাব ও প্রাণপ্রিয় পুত্র যাইনুল আবেদীন (আ.)-কে নির্দেশ দেন তাঁর শাহাদাতের পর যেন বন্দী অবস্থায় চলার পথে যেখানেই যাত্রাবিরতি করা হবে, সেখানে তাঁর মজলুম হওয়ার কথা বর্ণনা করা হয় এবং জনগণের বিশেষ করে শামের জনগণের কানে তা পৌঁছানো হয়। এছাড়াও ইমাম হুসাইন (আ) তাঁর অনুসারীদের আশুরার শোক ও ব্যাপক কান্নাকাটি বা মাতম অনুষ্ঠান করার মাধ্যমে তা ভবিষ্যতের মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার নির্দেশ দেন। শোকাশ্রু বিসর্জন করা এবং আশুরার দিনে তাঁর মুসিবতের কথা স্মরণ করে শোক প্রকাশ বা আযাদারি পালন করার মধ্যে যে বার্তা নিহিত রয়েছে, সেটা বুঝাতে তিনি বলেছেন : ‘আমি অশ্রুর শহীদ, আমি নিহত হয়েছি চরম কষ্ট স্বীকার করে, তাই কোন মুমিন আমাকে স্মরণ করলে ক্রন্দন না করে পারে না।’
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জন্য ক্রন্দন ও শোক প্রকাশের শিকড় প্রোথিত রয়েছে ইসলাম ধর্মের বিশ্বাসের ভেতরে এবং বিভিন্ন রেওয়ায়েত মোতাবেক এর অশেষ প্রভাব ও বরকত রয়েছে। তার মধ্যে উৎকৃষ্টতম প্রভাব হল তা আমাদের অন্তরগুলোর মরিচা দূর করে, আমাদের জীবনকে উন্নত করে এবং সত্যের পথে অকুতোভয় ও বাতিলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার দুর্নিবার মানসিকতা দান করে। ফলে আল্লাহ্র রহমত সকলের ওপরে অবারিত হয়। শোকের এ শক্তি কত জালিমকে উৎখাত করেছে, কত মজলুমের অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছে ও ইসলামকে কতবার যে ধ্বংসের কবল থেকে উদ্ধার করেছে তা কেবল ইতিহাসই বলতে পারে। তাই ইমাম যাইনুল আবেদীন (আ.) তাঁর পিতার শাহাদাতের পর ইবনে যিয়াদের কাছে যেসব দাবি তুলে ধরেন তার অন্যতম ছিল, একজন বিশ্বাসভাজন লোককে কাফেলার সাথে পাঠাও যাতে সে পথিমধ্যে যেসব জায়গায় যাত্রা বিরতি করা হবে, সেখানে শোক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে দেয়। আল্লাহ্র ইচ্ছায় সেদিন দুশমন এ শর্তটি মেনেও নেয় এবং নোমান ইবনে বাশীরকে কাফেলার সাথে পাঠায়।
কাফেলা যেখানেই যাত্রাবিরতি করছিল, নোমান সেখানেই তাঁদের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরি করে দিচ্ছিল যাতে ইমাম-পরিবার শোক অনুষ্ঠান করতে পারে। সেখানে ইমাম হুসাইনসহ কারবালার শহীদদের কঠিন বিপদ ও দুর্দশার কথা বর্ণনার মাধ্যমে একদিকে সাধারণ মানুষের মধ্যে ইমাম পরিবার সম্পর্কে সহানুভূতি সৃষ্টি, অপরদিকে জালেম ইয়াযিদ ও তার দোসরদের মুখোশ খুলে দিতে সক্ষম হন। স্বয়ং নোমান ইবনে বাশীর দীর্ঘ এ যাত্রাপথে ইমাম যাইনুল আবেদীন ও হযরত যাইনাবের বয়ান শুনে উচ্চস্বরে কাঁদতে থাকেন। এরপর কাফেলা যখন মদীনায় পৌঁছে, তখন ইমাম-প্রেমিক নোমান সবার আগে ছুটে গিয়ে মদীনায় প্রবেশ করেন এবং আকুলভাবে কেঁদে কেঁদে একটি কাসিদার মাধ্যমে আহলে বাইতের মুসিবতের কথা মদীনার জনগণের কাছে বর্ণনা করেন। কাসিদাটির অংশবিশেষ নিম্নরূপ : ‘হে মদীনাবাসী! তোমাদের জন্য আর কোন থাকার জায়গা রইল না। কারণ, হুসাইন কতল হয়েছেন। গায়ের জামাগুলো ছিঁড়ে ফেল, কেননা, তাঁর পবিত্র দেহ কারবালার ময়দানে টুকরো টুকরো হয়েছে। আর তাঁর কাটা মস্তক এখন বর্শার মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়ানো হচ্ছে।’
মদীনার জনগণ এ খবর শুনে নিজ নিজ ঘর ছেড়ে ছুটে বের হয়ে উচ্চস্বরে কাঁদতে থাকে এবং মদীনার আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে এমন এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয় যা মদীনা কোনদিন দেখেনি। একটি তাঁবু বসানো হয় ইমাম যাইনুল আবেদীন (আ.)-এর জন্য। শোকার্ত মানুষ তাঁকে ঘিরে রেখেছিল, সান্ত্বনা দিচ্ছিল এবং তাঁর হাতে-পায়ে ভক্তিভরে চুম্বন করছিল। মদিনার পুরুষরা উচ্চস্বরে কাঁদছিল ও ফরিয়াদ তুলছিল। আর নারীরা তাদের মুখ ও বুক চাপড়াচ্ছিল। কাফেলা যখন শহরে প্রবেশ করে, তখন ইমাম হুসাইন (আ.)-এর ইয়াতিম বাচ্চাগুলোকে মদীনার নারীরা বুকে টেনে নেন। আর পুরুষরা ইমাম যাইনুল আবেদীনকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন।
ইমাম হুসাইনের শাহাদাতের পর বিখ্যাত সাহাবী হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ্ আল আনসারী কারবালা প্রান্তরে যান। সেখানে তাঁর বুকফাটা ক্রন্দন এবং সাইয়্যেদুশ শুহাদা হযরত ইমাম হুসাইনের কবরের পাশে তাঁর আকুলতার ভাষাগুলো যে কোন মুমিনের অন্তরে শোকের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এভাবে শোক ও মাতমের মজলিসের বিস্তার ঘটতে ঘটতে গোটা দুনিয়া জুড়ে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর স্মরণে শোক ও মাতম এক আদর্শে রূপ নেয়। এ শোক পালনের ফলে সত্য সমহিমায় প্রোজ্জ্বল হতে থাকে । ইমাম হুসাইনের অনুরাগ ও প্রেম মানুষকে যোগায় মহাবিপ্লবের এমন অনন্য শক্তি যে তাতে সংগ্রামীরা আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকেই ভয় পায় না। প্রকৃত হুসাইন প্রেমিক সত্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠাকে নিজ জীবনের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। ফলে এ লক্ষ্যে নিজের জীবন ও নিজ পরিবার-পরিজনকে উৎসর্গ করাটাও তার জন্য খুবই সহজ হয়ে পড়ে।
আসলে সমাজে আশুরার শোক-ভিত্তিক বিপ্লবী সংস্কৃতি চালু হওয়ার ফলেই ধর্মদ্রোহী উমাইয়্যারা ও ইয়াযিদরা ধর্মব্রতী সেজে আর ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি। হুসাইনী হয়ে বেঁচে থাকার প্রবল আকুতি-মাখা এসব শোক অনুষ্ঠান ইতিহাসে অনেক অসাধ্য সাধনের ও অনেক বীরত্ব-গাঁথার উৎস। ইরানের ইসলামী বিপ্লব, ৮ বছরের পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ও দখলদার ইসরাইলের মোকাবেলায় লেবাননের হিযবুল্লাহর এবং ফিলিস্তিনিদের সাফল্যও আধুনিক যুগে হুসাইনি আদর্শেরই সুফল। মুমিনদের আত্ম পরিচয় খুঁজে পাওয়ার ও উন্নত মনোবৃত্তির সব শিক্ষা জড়িয়ে আছে আশুরা বিপ্লবের শোক মাতমের মধ্যে। যতদিন এ মহান ইমামের মহান আত্মত্যাগের স্মরণে অন্তরে শ্রদ্ধা ও ভালবাসা থাকবে, আর জিহ্বায় থাকবে তার সাহসী প্রকাশ, ততদিন এ রক্তাক্ত শাহাদাতের বাণী সমুন্নত ও চিরন্তন হয়ে পৌঁছে যাবে পরবর্তী বংশধরদের কাছে। ইমাম হুসাইনের চেহলাম পালনকে ঘিরে বিশ্বের বৃহত্তম মানব-সমাবেশ ইসলামী জাগরণ জোরদারের পাশাপাশি মানবজাতির শেষ ত্রাণকর্তা ইমাম মাহদির আবির্ভাবও ত্বরান্বিত করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
যে অজ্ঞতায় সেদিন মুসলিম উম্মাহ নিমজ্জিত ছিল তা হল সত্য ইমামকে না চেনা এবং বাতিল শাসকের আনুগত্যকে মেনে নেয়া। চেহলাম পালন আমাদের এ শিক্ষা দেয় যে আমাদেরকে বর্তমান সময়ের সত্য পন্থীদের চিনতে হবে। এরপর জামানার ইয়াজিদদের সনাক্ত করতে হবে যারা ইসলামের লেবাস পরে মুসলমানদের শত্রুদের সাথে হাত মিলিয়ে মুসলিম উম্মাহর ক্ষতি সাধনে লিপ্ত হয়েছে। এরপর এ গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র সম্পর্কে উম্মাহকে সচেতন করে তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইমাম হুসাইনের চেহলাম বার্ষিকীর পদযাত্রাকে নজিরবিহীন এবং প্রেম ও ইমানে ভরপুর সফর বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, হায় যারা আরবাঈন উপলক্ষে পায়ে হেঁটে কারবালায় যাচ্ছেন তাদের মতই যদি সৌভাগ্যবান হতে পারতাম! ইমাম হুসাইনের জন্য যুগ যুগ ধরে মানুষ যত অশ্রুপাত করেছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত করবে তা জমা করা হলে হয়ত একটি সাগরের রূপ নেবে।
ইসলামী বর্ণনা অনুযায়ী ইমাম হুসাইন (রা.)’র কর্তিত শির মুবারক তাঁর শাহাদতের পর চল্লিশতম দিনে সিরিয়া থেকে কারবালায় ফিরিয়ে আনা হয় এবং তা ইমামের পবিত্র শরীরের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। ইমাম জয়নুল আবেদিন অলৌকিকভাবে কুফার কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে ইমাম হুসাইন (রা.) সহ কারবালার অন্যান্য শহীদদের লাশ দাফন করেছিলেন।
শিমার যখন দুধের শিশুপুত্রসহ সঙ্গী-সাথীহারা আহত ও ক্ষত-বিক্ষত ইমাম হুসাইনকে শহিদ করতে তাঁর বুকের ওপর চড়ে বসে তখন ইমাম বলেছিলেন: তুমি কি জানো তুমি কত বড় স্থানে চড়ে বসেছ! এ সেই স্থান যেখানে হাজারো বার চুমো খেয়েছেন আমার নানা মহানবী (সা.)! ইমাম হুসাইনকে হাজার হাজার কুফাবাসী দাওয়াত দিয়েছিল ইয়াজিদি জুলুম থেকে মুক্তির আন্দোলন গড়ে তুলতে! তিনি আশুরার রাতে সেসব চিঠি পুড়ে ফেলেন যাতে ওইসব নাম জেনে ইয়াজিদি প্রশাসন কুফাবাসীকে কষ্ট না দেয়! অথচ তাদেরই অনেকে ইমামের বিরুদ্ধে ও তাঁর ক্ষুদ্র বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল! কি নির্দয় ও নির্মম মেহমানদারি!
মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে আরবাঈন পালনের উদ্দেশ্য তথা ইমাম হুসাইনের আদর্শের অনুসারী হওয়ার তৌফিক দিন। #
পার্সটুডে/এমএএইচ/১৬
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।