আধুনিক যুগের ‘শিমার’ শিমন পেরেজের মৃত্যু ও প্রতিক্রিয়া
https://parstoday.ir/bn/radio/uncategorised-i23245-আধুনিক_যুগের_শিমার’_শিমন_পেরেজের_মৃত্যু_ও_প্রতিক্রিয়া
হৃদযন্ত্রের অসুখে দুই সপ্তাহ ধরে সংজ্ঞাহীন থাকার পর ইহুদিবাদী ইসরাইলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট শিমন পেরেজ গত ২৮ সেপ্টেম্বর মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।
(last modified 2025-09-29T12:37:45+00:00 )
অক্টোবর ১৭, ২০১৬ ১৯:১৮ Asia/Dhaka
  • শিমন পেরেজ
    শিমন পেরেজ

হৃদযন্ত্রের অসুখে দুই সপ্তাহ ধরে সংজ্ঞাহীন থাকার পর ইহুদিবাদী ইসরাইলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট শিমন পেরেজ গত ২৮ সেপ্টেম্বর মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।

ফিলিস্তিনি ও আরব মুসলমানদের ভূখণ্ডে ইহুদিবাদীদের বহু গণহত্যা, জবরদখল, অবৈধ উচ্ছেদ-অভিযান, সন্ত্রাসী হামলা ও বর্বরোচিত যুদ্ধের কুখ্যাত পরিচালক বা প্রধান সহযোগী হিসেবে পরিচিত এই ইসরাইলি জালিমের বয়স হয়েছিল ৯৩ বছর।
পোল্যান্ডের উইজনিউ শহর ছিল পেরেজের জন্মস্থান যা বর্তমানে বেলারুশের অংশ। পেরেজ  ১৯৩৪ সালে ফিলিস্তিনে চলে আসে  মা-বাবাসহ পরিবারের অন্য সবার সঙ্গে। অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের সময় তার বয়স ছিল ২৪। পেরেজ সাত বছর ধরে ইসরাইলের প্রেসিডেন্ট হওয়া ছাড়াও দু’বার প্রধানমন্ত্রী ও ১২ বার মন্ত্রী হয়েছিল। দক্ষিণ লেবাননের কানা গণহত্যার জল্লাদ হিসেবে খ্যাত পেরেজ দু’বার ইসরাইলের যুদ্ধ-মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করে। কানা গণহত্যায় হতাহত হয়েছিল ২৫০ জনেরও বেশি বেসামরিক নাগরিক।  গাজা ও লেবাননের ওপর বার বার যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া এবং ফিলিস্তিনিদের ইন্তিফাদা গণঅভ্যুত্থান দমনেও ইসরাইলের শীর্ষস্থানীয় কসাইয়ের ভূমিকা পালন করেছে পেরেজ।  
পেরেজের সন্ত্রাসী ভূমিকা শুরু হয় ১৯৪৭ সালে ‘হ’গ’না’ নামের কুখ্যাত ইহুদিবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে। এই গোষ্ঠীর জন্য অস্ত্র সংগ্রহসহ নানা সন্ত্রাসী কাজে সরাসরি ভূমিকা রাখে পেরেজ। ফিলিস্তিনে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে লাখ লাখ ফিলিস্তিনিকে আশপাশের অঞ্চলে পালিয়ে যেতে  বাধ্য করার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এই গোষ্ঠী। ‘হ’গ’না’র প্রধান বেনগুরিয়ান ১৯৪৮ সালে ইসরাইলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হলে শিমন পেরেজ হয় ইসরাইলি নৌবাহিনীর প্রধান। পেরেজকে ইসরাইলের পরমাণু অস্ত্র অর্জনের স্থপতিও বলা হয়। বিশ্বের নানা অঞ্চল থেকে ইহুদিদেরকে ফিলিস্তিনে নিয়ে আসা ও তাদের জন্য অবৈধ ইহুদি-বসতি নির্মাণসহ ইসরাইলের সব ধরনের অপরাধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা রেখেছে শিমন পেরেজ। গাজাগামী তুর্কি জাহাজের ত্রাণ-কর্মীদের ওপর ইসরাইলি হত্যাযজ্ঞের ঘটনাও ঘটেছে তার শাসনামলে। পেরেজ ২০১৪ সাল পর্যন্ত ইসরাইলের প্রেসিডেন্ট পদে আসীন ছিল।
বহু নৃশংস হত্যাযজ্ঞে জড়িত হওয়া সত্ত্বেও পেরেজকে পশ্চিমাদের নিয়ন্ত্রিত ও প্রভাবিত কিছু গণমাধ্যম এবং ব্যক্তিত্ব ‘শান্তি-বাদী’ বলে স্মরণ করেছে। এর অজুহাত  হিসেবে অসলো আপোষ-চুক্তিতে তার ভূমিকা রাখার কথা বলা হয়। অথচ এই চুক্তির মাধ্যমে ফিলিস্তিনে জবরদখলের মাধ্যমে গড়ে-তোলা ইসরাইলের অস্তিত্ব বৈধ হোক বা না হোক এই বিষাক্ত ক্যান্সারের অস্তিত্বকে বাস্তবতার ময়দানে মেনে নিতে বাধ্য হয় আরব সরকারগুলো। কিন্তু এই চুক্তির পরও আরবদের ওপর ইসরাইলের অপরাধযজ্ঞের তীব্রতা তো কমেনি বরং বেড়েছে। এমনকি আরবদের জন্য কলঙ্কজনক ও নতজানুমূলক এই চুক্তির সুবাদে ইসরাইল অনেক আরব সরকারের সঙ্গে সরাসরি বা পরোক্ষ কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।  আসলে এই চুক্তি আরব বিশ্বে নিরাপত্তা সৃষ্টিতে কোনো ভূমিকাই রাখেনি, বরং সব দিক থেকেই এ চুক্তি কেবল ইসরাইলের স্বার্থই রক্ষা করেছে। যেমন, ১৯৯৩ সালে স্বাক্ষরিত ওই শান্তি চুক্তির আগের ২০ বছরে আরব সরকারগুলোর সঙ্গে ইসরাইলের কোনো যুদ্ধই হয়নি। বরং মিশর ১৯৭৯ সনে ইসরাইলের সঙ্গে ক্যাম্পডেডিভ আপোষ-চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। 
ইসরাইল অসলো চুক্তির পর গাজা ও দক্ষিণ লেবাননের ওপর বার বার  যুদ্ধ এবং গণহত্যা চাপিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এসব যুদ্ধের ব্যাপারে বেশিরভাগ আরব সরকারই নীরব থেকেছে কিংবা এসব যুদ্ধে ইসরাইলকে গোপনে সহযোগিতা করেছে। অতীতে আরব সরকারগুলো জনগণের ভোট পাওয়ার জন্য হলেও ইসরাইলের সঙ্গে শত্রুতা বা যুদ্ধ-নীতি বজায় রাখার কথা বলত। কিন্তু অসলো চুক্তির পর বেশিরভাগ আরব সরকারই ইসরাইলি জবর-দখলের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কথা আর মুখে আনছেন না। 
অসলো চুক্তির সময় শিমন পেরেজ ছিল ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। পেরেজ ছাড়াও সে সময়কার ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী ইসহাক রবিন ও পিএলও প্রধান ইয়াসির আরাফাতকেও নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়।  রবিন মারা যায় ১৯৯৫ সালে। আরাফাত মারা যায় ২০০৪ সালে। পেরেজের মৃত্যুকে ইহুদিবাদী ইসরাইলের অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠাতার মৃত্যু হিসেবেও দেখা হচ্ছে।

বর্তমান যুগের ইয়াজিদ বা শিমার হিসেবে তুলনা করার যোগ্য শিমন পেরেজের মৃত্যুতে কোনো কোনো আরব নেতার মন্তব্য ছিল অপ্রত্যাশিত। এ প্রসঙ্গে ফিলিস্তিন স্বশাসন কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ও বাহরাইনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খালিদ বিন আহমাদ আল খলিফার মন্তব্য প্রথমেই উল্লেখ করা যায়।    
 
বাহরাইনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খালিদ বিন আহমাদ আল খলিফা একটি সামাজিক নেটওয়ার্কে লিখেছেন, “ আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক শিমন পেরেজের ওপর! শান্তিতে ঘুমাও শিমন পেরেজ। তিনি ছিলেন যুদ্ধ ও শান্তির এমন এক ব্যক্তিত্ব মধ্যপ্রাচ্যে যার মতো কাউকে পাওয়া অসম্ভব।”  
মাহমুদ আব্বাস আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, পেরেজ শুধু ইসরাইলেরই আধ্যাত্মিক পিতা ছিলেন না, একইসঙ্গে ফিলিস্তিনি জাতিরও পিতা ছিলেন!
সংবাদ মাধ্যমগুলো  কানা গণহত্যার জল্লাদ শিমন পেরেজের শেষ-কৃত্য অনুষ্ঠানে উপস্থিত  মাহমুদ আব্বাসের দুঃখ-ভারাক্রান্ত ছবিও প্রচার করেছে।

ইসরাইলি সংসদ নেসেটের লিকুদ দলের সদস্য আইয়ুব কোররা জানিয়েছেন, পারস্য উপসাগরীয় আরব সরকারগুলোর একজন পেরেজের মৃত্যুর সংবাদ শুনে কয়েক মিনিট ধরে তার জন্য কেঁদেছেন! এটা স্পষ্ট যে আরও অনেক আরব শাসক পেরেজের মৃত্যুতে ইসরাইলের সঙ্গে সমান মাত্রায় ব্যথিত হয়েছেন, কিন্তু তারা তা প্রকাশ্যে বলতে চাননি যাতে তাদের রাজনৈতিক প্রেস্টিজ কিছুটা হলেও টিকে থাকে।
মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক প্রখ্যাত গবেষক ও সাংবাদিক রবার্ট ফিস্ক ব্রিটেনের দৈনিক ইন্ডিপেন্ডেন্টে লিখেছেন, পশ্চিমা নেতারা পেরেজকে শান্তিকামী বলে প্রচারণা চালালেও পেরেজ  বাস্তবে কখনও শান্তিকামী ছিলেন না। ফিস্ক লিখেছেন, 

‘যখন শুনলাম পেরেজ মারা গেছে তখন রক্ত, গোলা-বর্ষণ-আগুন ও হত্যাযজ্ঞের কথাই মনে পড়লো। আমি তার নানা কাজের ফলাফল দেখেছি। দেখেছি শিমনের পরিচালিত গণহত্যায় শিশুদের টুকরো টুকরো হয়ে যেতে ও আশ্রয়প্রার্থীদের আর্তনাদ করতে এবং দেখেছি  তাদের পুড়ে যাওয়া দেহ। ওই স্থানটি ছিল লেবাননের ক্বানা নামক  স্থান। সেখানে ছিল জাতিসংঘের আশ্রয়-কেন্দ্র। ওই আশ্রয় কেন্দ্রের ধ্বংসস্তূপের নীচে চাপা পড়েছিল অন্তত ১০৬টি লাশ যার অর্ধেকই ছিল শিশুদের। ১৯৯৬ সালে ইসরাইলি গোলা বর্ষণে ওই ঘুমন্ত শিশুরা টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল।’
প্রখ্যাত আরব লেখক আবু আলী নায়মা লিখেছেন, যুদ্ধ-অপরাধের শাস্তি পাওয়ার আগেই মারা গেল শিমন পেরেজ।

ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ সংগঠন ইসলামিক জিহাদ ঘোষণা করেছে, ইহুদিবাদী ইসরাইলের সাবেক প্রেসিডেন্ট শিমন পেরেজ সন্ত্রাসবাদের প্রতীক ছিলেন। শান্তির ক্ষেত্রে তার কোনো অবদান নেই। পেরেজের মৃত্যুর পর ইসলামিক জিহাদের পক্ষ থেকে এক প্রতিক্রিয়ায় সংগঠনটির গণমাধ্যম বিষয়ক দপ্তরের প্রধান দাউদ শাহাব এ তথ্য জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, শিমন পেরেজ আজীবন ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে অপরাধ করে গেছেন। তার কারণে অসংখ্য ফিলিস্তিনি আজও শরণার্থী হিসেবে কোনোমতে দিনাতিপাত করছেন। পশ্চিমা গণমাধ্যম পেরেজকে শান্তি-মানব হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। কিন্তু তারা তাতে সফল হবে না। 

দাউদ শাহাব বলেন, ফিলিস্তিনিরা ইহুদিবাদী নেতাদের বিচারের দাবি থেকে সরে আসবে না।

ফিলিস্তিনের সংগ্রামী দল হামাসও শিমন পেরেজকে একজন অপরাধী ও ফিলিস্তিনে 'দখলদারিত্বের প্রতিষ্ঠাত'  হিসেবে উল্লেখ করেছে এবং তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে মাহমুদ আব্বাসের যোগ দেয়ার ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। লেবাননের জনপ্রিয় ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হিজবুল্লাহও শিমন পেরেজকে অপরাধী বলে উল্লেখ করেছে।    #

পার্সটুডে/মু.আ.হুসাইন/১৭