'কিছু লোকের জন্য সরকারের বদনাম হয়, রোজিনার সঙ্গে যা ঘটেছে তা দুঃখজনক'
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে গ্রেফতারের ঘটনা খুবই দুঃখজনক। এতে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে পারে এবং এই পরিস্থিতি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে মোকাবিলা করতে হবে।
আজ (বৃহস্পতিবার) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকের পরে সাংবাদিকদের নিকট এমন মন্তব্য করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, এটি অনভিপ্রেত এবং দুঃখজনক ঘটনা। বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ম্যানেজ করা উচিত ছিল। গুটিকতক লোকের জন্য এই বদনামটা হচ্ছে এবং আমি জানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হিসেবে আমাদের এটি ফেস করতে হবে।
মন্ত্রী আরো বলেন, সংবাদ মাধ্যম দেশের জন্য বিরাট কাজ করছে। তাদের কারণে আমরা বালিশ কাণ্ড শুনেছি, আপনাদের কারণে আমরা লাখ টাকার সুপারি গাছের কথা শুনেছি, আপনাদের কারণে সেই শাহেদ করিমের (রিজেন্ট ডায়াগনোস্টিক সেন্টার) তথ্য পেয়েছি। সরকার প্রতিটা ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিয়েছে। এসব করে গণমাধ্যম কর্মীরা সরকারকে খুব সাহায্য করছেন।
কারাবন্দি সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম ন্যায় বিচার পাবেন উল্লেখ করেন মোমেন বলেন, ‘যেহেতু এটা বিচারাধীন আছে, এটা নিয়ে কথা চলছে, এটা এখন নরমাল সাবজেক্ট নয়। আর কালকে আমাদের হানিফ সাহেব এবং কাদের সাহেব খুব সুন্দরভাবে বলেছেন। আমাদের সব সহকর্মীরা বলেছেন, তিনি ন্যায় বিচার পাবেন, হবে।’
রোজিনার বিষয়টি সহানুভূতির সঙ্গে দেখা হবে: তথ্যমন্ত্রী
এদিকে, তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ জানিয়েছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের করা মামলায় প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলাম যাতে ন্যায় বিচার পান, সেটি চেষ্টা করছি। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করব। রোজিনা ইসলাম যাতে ন্যায়বিচার পান সে চেষ্টা প্রথম থেকেই আমি করে এসেছি।’
আজ সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) ও বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স ফোরামের নেতৃবৃন্দ মন্ত্রীর বাসভবনে যান। নেতারা তথ্যমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি প্রদান করেন। স্মারকলিপিতে রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার, অবিলম্বে মুক্তি ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে হেনস্তাকারী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তি দাবি করা হয়।
জাতীয় পার্টির প্রতিবাদ
সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের এমপি।
বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক মানববন্ধনে তিনি বলেন, রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ও দণ্ডবিধিতে মামলা করা হয়েছে, এটা যাতে বাংলাদেশে আর না থাকে সেটা দেখতে চাই।’ অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট বাতিলের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘রোজিনা ইসলামের কণ্ঠরোধ মানে স্বাধীন গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ।’
বাম গণতান্ত্রিক জোটের বিক্ষোভ সমাবেশ
এদিকে, অবিলম্বে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামের মুক্তি দাবি করেছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। বৃহস্পতিবার বাম গণতান্ত্রিক জোট কেন্দ্রীয় পরিচালনা পরিষদের উদ্যোগে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ সমাবেশে এ দাবি জানানো হয়।
বাম জোটের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ও বাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড বজলুর রশীদ ফিরোজের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য দেন সিপিবির প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুল্লাহ আল কাফি রতন, বাসদ মার্কসবাদী নেতা মানস নন্দী, ইউসিএলবি নেতা নজরুল ইসলাম, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সভাপতি হামিদুল হক, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির নেতা শহীদুল ইসলাম সবুজ। সমাবেশ পরিচালনা করেন বাসদ নগর নেতা জুলফিকার আলী।
সমাবেশে নেতৃবৃন্দ বলেন, রোজিনা ইসলামকে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার প্রমাণ করেছে, বর্তমান সরকার দুর্নীতিবাজদের রক্ষাকর্তা। রোজিনার গ্রেপ্তারের ঘটনা স্বাধীন সাংবাদিকতা, মানবাধিকার ও নাগরিক মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করেছে এবং নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করেছে। এই ঘটনা আরও প্রমাণ করেছে সরকার সত্য গোপন করতে চায়। শুধু তাই নয়, সরকার জনগণকে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের চাইতে দুর্নীতি লুকাতে তৎপর বেশি।
নেতৃবৃন্দ বলেন, তথ্য অধিকার আইনে তথ্য জানার অধিকার জনগণের আছে। জনগণকে তথ্য না জানানো চুরি, দুর্নীতি, জবাবদিহিতাকেই উৎসাহিত করে। দেশ ও জনগণের স্বার্থে দুর্নীতি, অনিয়মের তথ্য বের করে আনা কোনো মতেই চুরি না। আর এটা সাংবাদিকতার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। রোজিনা ইসলাম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের বেশ কয়েকটি দুর্নীতি ও অনিয়মের অনুসন্ধানী রিপোর্ট পত্রিকায় প্রকাশ করেন। এজন্যই তাকে সচিবালয়ে সাড়ে ৫ ঘণ্টা আটকে রেখে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করা হয়, যা সভ্য দেশে অকল্পনীয়।
তারা বলেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন ‘রোজিনাকে নির্যাতন করা হয়নি বরং রোজিনাই অতিরিক্ত সচিবকে খামচি দিয়েছেন, থাপ্পর মেরেছে’, যা আমলাদের পক্ষে মন্ত্রীর নির্লজ্জ সাফাই গাওয়া এবং এতে প্রমাণ হয় ‘চোরের সাক্ষী গাঁট কাটা’।
নেতৃবৃন্দ বলেন, মন্ত্রী বলেছেন, টিকা ক্রয়ের চুক্তির নথি রোজিনা সরিয়েছেন, ছবি তুলেছেন। তাহলে প্রশ্ন সচিবালয় কি কোনো উন্মুক্ত স্থান? তাছাড়া সচিব, একান্ত সচিবের কক্ষে যে বিনা অনুমতিতে ঢোকা যায় না তার প্রমাণ ঘটনার দিন সচিবের সঙ্গে সাংবাদিকরা সাক্ষাৎ করতে চাইলে তিনি সাক্ষাৎ দেননি। ফলে তথ্য চুরির ঘটনা সর্বৈব মিথ্যা ও বানোয়াট। আর যদি ঘটনা সত্যিই হয় তাহলে এই ঘটনার জন্য প্রধান আসামি হওয়া উচিত স্বাস্থ্য সচিবের, কারণ তিনি রাষ্ট্রীয় গোপন নথি কেন একান্ত সচিবের টেবিলে উন্মুক্ত জায়গায় রাখবেন।
নেতৃবৃন্দ আরও বলেন, ১৯২৩ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশিক আমলের আইন‘ অফিসিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্ট’, যা স্বাধীন দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারায় যুক্ত করা হয়েছে। সেই কুখ্যাত আইনে রোজিনাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
নেতৃবৃন্দ অবিলম্বে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের নিঃশর্ত মুক্তি, মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, রোজিনাকে হেনস্তাকারী আমলা ও পুলিশের শাস্তি; ব্যর্থ ও
দুর্নীতিবাজ স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্য সচিবকে অপসারণ এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল ও সংবাদপত্র-সাংবাদিকতার ওপর হস্তক্ষেপ বন্ধ করার জোর দাবি জানান।
দেশব্যাপী প্রতিবাদ
এর আগে, সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের নিঃশর্ত মুক্তি এবং তাকে হেনস্তাকারী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়ে দেশব্যাপী কর্মসূচি পালন করেছে বিভিন্ন পেশাজীবী, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। তারা রোজিনা ইসলামের মুক্তি ও তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে করা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন। বুধবার রাজধানী ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণে ও এর বাইরে বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠন আয়োজিত মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচিতে এ দাবি জানানো হয়। এছাড়া ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন জেলা শহরে বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন রোজিনা ইসলামকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ ও তার মুক্তির দাবিতে কর্মসূচি পালন করেছে।
রাজধানীতে জাতীয় প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণে একযোগে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে), ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে), বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স ফোরাম (বিএসআরএফ), ফটো জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন, বরিশাল ডিভিশনাল জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন, রংপুর বিভাগ সাংবাদিক সমিতি ও ফরিদপুর জার্নালিস্ট ফাউন্ডেশন। প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণের বাইরে কর্মসূচি পালন করে বিএফইউজে’র একাংশ এবং বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্র। রোজিনা ইসলামের ঘটনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটিও প্রত্যাখ্যান করেন সাংবাদিক নেতারা। তারা রোজিনাকে কারাবন্দি করার ঘটনাকে মুক্ত গণমাধ্যমের ওপর হস্তক্ষেপ বলে উল্লেখ করেন।#
পার্সটুডে/আবদুর রহমান খান/আশরাফুর রহমান/১৯