মার্কিন সরকার ইসরায়েলি গণহত্যার প্রধান স্থপতি
৬০টিরও বেশি সরকার ইসরায়েলি গণহত্যায় জড়িত: জাতিসংঘের প্রতিবেদন
-
জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক ফ্রান্সেসকা আলবানিজ
পার্সটুডে: অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের জন্য নিযুক্ত জাতিসংঘের বিশেষ দূত বিশ্ব সংস্থার সাধারণ পরিষদের সদস্যদের অবহিত করেছেন যে কীভাবে ষাটেরও বেশি সরকার, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে পশ্চিমা শক্তি এবং বেশ কয়েকটি আরব রাষ্ট্র গাজায় ইসরায়েলি "গণহত্যা যন্ত্র"কে সক্ষম করে তুলেছে।
মঙ্গলবার ফ্রান্সেসকা আলবানিজ দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে অবস্থিত ডেসমন্ড এবং লিয়া টুটু লিগ্যাসি ফাউন্ডেশনে সাধারণ পরিষদে তার সর্বশেষ প্রতিবেদনের উপস্থাপনা প্রদান করেন, যার অগ্রিম সংস্করণ এক সপ্তাহেরও কম সময় আগে প্রকাশিত হয়েছিল।
'গাজা গণহত্যা: একটি যৌথ অপরাধ' শীর্ষক তার ২৪ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে যে, উপকূলীয় অঞ্চলের দুই মিলিয়নেরও বেশি যুদ্ধবিধ্বস্ত এবং অবরুদ্ধ জনসংখ্যা বোমা হামলা, অনাহার এবং নিশ্চিহ্ন হওয়ার সময় কীভাবে সেই সরকারগুলো চোখ বন্ধ করে রেখেছে।
'বর্ণবাদ থেকে গণহত্যা'
বর্ণবাদ বিরোধী সংগ্রামের প্রতীকী ভিত্তি হিসেবে পরিচিত দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, ওয়াশিংটন ও বার্লিন থেকে লন্ডন এবং তার বাইরেও বিস্তৃত সামরিক, অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক জটিলতার বিশাল জাল ইসরায়েলি গণহত্যার সহযোগী।
আলবানিজ বলেন, বিশ্ব শক্তিগুলো "ইসরায়েলের সামরিকায়িত বর্ণবাদকে প্রতিপালন করেছে, প্রতিষ্ঠা করেছে এবং রক্ষা করেছে", যার ফলে এর বসতি স্থাপনকারী-ঔপনিবেশিক প্রকল্পটি গণহত্যায় রূপান্তরিত হয়েছে, যা "ফিলিস্তিনের আদিবাসীদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত অপরাধ"।
তার ২৪ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে যে কীভাবে সহযোগিতাকারী দেশগুলোর অস্ত্র, প্রযুক্তি এবং গোয়েন্দা তথ্য গাজায় আক্রমণ চালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে, যা তার ভাষায়, "শ্বাসরোধ, ক্ষুধার্ত, ছিন্নভিন্ন" করে দিয়েছে।
গণহত্যায় সহযোগিতার স্থপতি মার্কিন সরকার
আলবানিজের অনুসন্ধানে দেখা গেছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই ইসরায়েলি শাসকগোষ্ঠীর যুদ্ধ অর্থনীতির মূলে রয়েছে, যা তাদের অস্ত্র আমদানির দুই-তৃতীয়াংশের জন্য দায়ী এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সাতটি ভেটোর মাধ্যমে জবাবদিহিতাকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কূটনৈতিক আবরণ প্রদান করেছে মার্কিন সরকার।
প্রতিবেদনে গণহত্যার প্রমাণ পাওয়ার পরও জার্মানি, ব্রিটেন এবং অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তিগুলোকে ইসরায়েলের কাছে উন্নত অস্ত্র সরবরাহের জন্য দায়ি বলে উল্লেখ করা হয়েছে আলবানিজের অনুসন্ধানে।
তিনি যুদ্ধের সময় গাজায় ওপর প্রায় পুরোপুরি নিশ্ছিদ্র ও সম্পূর্ণ অবরোধ আরোপ এবং ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর নৃশংসতার অবদানের কথা উল্লেখ করেছেন যার ফলে সম্মিলিতভাবে দুর্ভোগ এবং হতাহতের সংখ্যা সর্বাধিক হারে বৃদ্ধি পায়।
ইসরায়েলি গণহত্যার সহযোগী আরব সরকারগুলো
প্রতিবেদনটিতে আরব সরকারগুলোর প্রতিও আহ্বান রয়েছে। এতে উঠে এসেছে, গাজায় আগুন জ্বলার সময় তেল আবিবের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিককারী আরব রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকার কথা। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, মিশর "ইসরায়েলের সাথে উল্লেখযোগ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে, যার মধ্যে রয়েছে জ্বালানি সহযোগিতা এবং রাফাহ ক্রসিং বন্ধ করা," যা গাজার জীবনরেখা, গাজার শেষ মানবিক লাইফলাইনের উপর ফাঁসি শক্ত করে তুলেছে।
অস্ত্র ও বাণিজ্যের বাইরেও আলবানিজ বহুপাক্ষিক ব্যবস্থার কয়েক দশকের "নৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যর্থতার" নিন্দা করেছেন। তিনি বলেছেন, এমন একটি বিশ্ব ব্যবস্থা যা বাস্তব সময়ে গণহত্যা সংঘটিত হতে দিয়েছে, সরাসরি সম্প্রচার করেছে কিন্তু তা সত্ত্বেও আমলাতান্ত্রিক পক্ষাঘাতের মুখোমুখি হয়েছে।
তার প্রতিবেদনে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখন "আইনের শাসনের পতন এবং আইনের শাসনের নবায়নের আশার মাঝখানে পতনের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে।" তিনি বলেন আইনের শাসন কেবল তখনই ফিরে আসবে যখন গণহত্যার প্রতি সহযোগিতাকে রোখা হয়, দায়িত্বগুলো পালন করা হয় এবং ন্যায়বিচার সমুন্নত থাকে।"
ইসরায়েলের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ও আলবানিজের কড়া জবাব
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে আলবানিজের এই প্রতিবেদন প্রকাশের ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে ইসরায়েলি দূত তাকে দুষ্ট ডাইনি বলে অভিহিত করেছেন। মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা ইসরায়েলি দূতের এই প্রতিক্রিয়াকে আপত্তিকর বলে নিন্দা জানিয়েছেন।
বিচলিত না হয়ে, আলবানিজ উত্তর দেন, "যদি তুমি আমাকে সবচেয়ে খারাপ জিনিসের জন্য জাদুবিদ্যার অভিযোগ করতে পারো, আমি তা মেনে নেব। কিন্তু যদি আমার মন্ত্র তৈরির ক্ষমতা থাকত, তাহলে আমি তা ব্যবহার করে তোমাদের অপরাধ চিরতরে বন্ধ করতাম এবং দায়ীদের কারাগারে পাঠানো নিশ্চিত করতাম।"
আলবানিজ বিশ্বের দেশগুলোকে তেল আবিবের সাথে সমস্ত সামরিক ও বাণিজ্য চুক্তি স্থগিত করার আহ্বান জানিয়ে তার প্রতিবেদনের উপসংহার টানেন। তিনি যুদ্ধের জন্য মোতায়েনযোগ্য দ্বৈত-ব্যবহারের পণ্যসহ সব ধরনের পণ্য ইসরায়েলে রপ্তানি নিষিদ্ধ করার দাবি জানান।
আলবানিজের ফিলিস্তিন সংক্রান্ত জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রতিবেদন এমন সময় প্রকাশ হল যখন গত দুই বছরেরও বেশি সময়ে গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যায় নিহত হয়েছে প্রায় ৭০ হাজার ফিলিস্তিনি যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু এবং আহত ও পঙ্গু হয়েছে প্রায় দেড় লাখ। #
পার্স টুডে/এমএএইচ/২৯
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।