ইরানের ইলাম প্রদেশের 'ভেলি কেল্লা': কালজয়ী ইতিহাস ও শিল্পের নিদর্শন
পার্সটুডে: পশ্চিম ইরানের ইলাম শহরের কেন্দ্রস্থলে, জাগরোস পর্বতমালার কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে এক ঐতিহাসিক স্থাপনা—ভালি কেল্লা। এটি কেবল কাজার যুগের স্থাপত্যশৈলীর এক চমৎকার নিদর্শন নয়, বরং ইলামের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের এক জীবন্ত সাক্ষ্য।
ইতিহাস ও নির্মাণ
কাজার শাসনামলের প্রভাবশালী গভর্নর গোলামরেজা খান ভালি-এর আদেশে ১৯০৮ সালে 'ভেলি কেল্লা' নির্মাণ করা হয়। এটি নির্মিত হয়েছিল 'চোখা মিরাক' নামে একটি ছোট টিলার উপর, যার চারপাশে শহরের সম্প্রসারণের ফলে এখন দুর্গটি শহরের মধ্যভাগে অবস্থিত।
পার্স টুডে'র রিপোর্ট অনুযায়ী, এক সময়ের পোশ্তকুহ প্রদেশের গভর্নরের আবাসস্থল ছিল এই দুর্গ। বর্তমানে এটি রূপ নিয়েছে ইলাম নৃবিজ্ঞান জাদুঘরে, যেখানে সংরক্ষিত রয়েছে এই অঞ্চলের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ঐতিহ্য ও জীবনধারা।
অবস্থান ও আয়তন
শহরের সম্প্রসারণের সাথে সাথে কেল্লার চারপাশের জমি সমতল করা হয় এবং বর্তমানে এটি ইলাম শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত। কেল্লার মোট আয়তন প্রায় ৪,৭০০ বর্গমিটার, যার নির্মিত অংশ ১,৪৬৬ বর্গমিটার এবং এটি একটি ৭০০ বর্গমিটারের কেন্দ্রীয় প্রাঙ্গণকে ঘিরে গঠিত। এটি একইসাথে প্রশাসনিক কেন্দ্র ও ক্ষমতার প্রতীক ছিল।

স্থাপত্যশৈলী
ভেলি দুর্গে কাজার যুগের রুচিশীল স্থাপত্যশৈলী ও ব্যবহারিক নকশার সমন্বয় দেখা যায়। এতে রয়েছে ২০টিরও বেশি বড় কক্ষ, ৫টি ছোট কক্ষ, ৪টি বারান্দা এবং দক্ষিণ পাশে দুটি উঁচু ছাদবিশিষ্ট সিঁড়ি।।
উত্তরের কোণদ্বয়ে আধা-বৃত্তাকার দুটি পাহারাদার মিনার নির্মিত হয়েছে, যেখানে ছিল নজরদারি ও প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা। তিনটি প্যাঁচানো সিঁড়ি ছাদে ওঠার পথ হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
ছাদগুলো গম্বুজ, সমতল ও নলাকার খিলান সহ ঐতিহ্যবাহী নকশায় তৈরি, যা ইরানি ও ইউরোপীয় (বিশেষ করে রোমান) স্থাপত্যের মিশেলকে নির্দেশ করে।
অলংকরণ ও নান্দনিকতা
ভেলি কেল্লায় হাতে কাটা আয়তাকার ইট দিয়ে গড়া জ্যামিতিক নকশা, খিলানযুক্ত জানালা, রঙিন কাচের জানালা এবং খোদাই করা কলামগুলো স্থাপত্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। কেন্দ্রীয় প্রাঙ্গণে একটি পুকুর রয়েছে, যা কেল্লার ইটের দেয়ালকে প্রতিফলিত করে এবং চারপাশে সুউচ্চ সাইপ্রাস ও পাইন গাছ দাঁড়িয়ে আছে।
ভেতরের অংশে, অভ্যর্থনা কক্ষ (পশ্চিম অংশে এখনও দৃশ্যমান) প্লাস্টারের ফুল-পাতার নকশা ও সূক্ষ্ম আয়না কাজে সজ্জিত। আরসি জানালা (কাঠের জালি ও রঙিন কাচ) সূর্যের আলোকে নানা রঙে ছড়িয়ে দেয় এবং একটি উষ্ণ ও জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করে।

পানি সরবরাহের অভিনব পদ্ধতি
কেল্লাটির একটি কার্যকরী ও আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য ছিল এর পানি সরবরাহ ব্যবস্থা। নিকটবর্তী বিবি ঝরনা থেকে মাটির পাইপ দিয়ে প্রাঙ্গণে স্বচ্ছ পানি আনা হতো। যদিও এখন এই ঝর্না শুকিয়ে গেছে, তবুও এই ব্যবস্থা কাজার যুগের প্রকৌশলী দক্ষতার প্রমাণ বহন করে।
কেল্লা থেকে জাদুঘর
১৯৮০ সালে শুরু হওয়া ৮ বছরব্যাপী ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় কেল্লাটি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে ইরানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ সংস্থা দুর্গটির পুনরুদ্ধারে ব্যাপক কাজ করে। মূল নকশা অক্ষুণ্ণ রেখে কিছু ছাদে ইস্পাত বিম সংযোজনের মাধ্যমে স্থায়িত্ব বাড়ানো হয়। ১৯৯৭ সালে এটি জাতীয় ঐতিহ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। ২০০৬ সালে দুর্গটিকে রূপান্তরিত করা হয় ইলাম নৃবিজ্ঞান জাদুঘরে। বর্তমানে এখানে ইলামের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী—কুর্দ, লুর, লাক ও আরবদের ঐতিহ্য, পোশাক, বিয়ের রীতি, কালো তাঁবু, গালিচা বুনন, নমদ তৈরির সরঞ্জাম ও দৈনন্দিন জীবনের উপকরণ প্রদর্শিত হয়।
একটি সাংস্কৃতিক আইকন
ভেলি কেল্লা কেবল একটি স্থাপত্য নয়, এটি একটি জীবন্ত সাংস্কৃতিক প্রতীক। নওরোজের সময় এর প্রাঙ্গণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ঐতিহ্যবাহী খাবারের মেলা ও হস্তশিল্পের বাজারে মুখরিত হয়ে ওঠে এবং সারা দেশ থেকে পর্যটকদের আকর্ষণ করে।
এই কেল্লা কাজার যুগের নান্দনিকতা, সূক্ষ্ম পুনর্নির্মাণ ও সাংস্কৃতিক ভূমিকার মাধ্যমে ইলামের অন্যতম প্রধান দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। ভেলি কেল্লা শুধু পাথর ও গাঁথুনির স্থাপনা নয়, এটি ইলামের আত্মার একটি জীবন্ত অংশ—যা এই অঞ্চলের রাজনৈতিক শক্তি, জটিল সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সহনশীলতার সাক্ষ্য বহন করে।
ভ্রমণ টিপস:
অবস্থান: ইলাম শহরের কেন্দ্রে
সময়: সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা
প্রবেশ মূল্য: স্থানীয়দের জন্য সাশ্রয়ী, বিদেশি পর্যটকদের জন্য আলাদা ফি
বিশেষ অনুষ্ঠান: নওরোজ ও স্থানীয় সাংস্কৃতিক উৎসবে বিশেষ প্রদর্শনী
পার্সটুডে/এমএআর/৪