ইস্ফাহানের ঐতিহাসিক ৫ সেতু: প্রকৌশল ও শিল্পকলার অনন্য নিদর্শন
https://parstoday.ir/bn/news/iran-i152292-ইস্ফাহানের_ঐতিহাসিক_৫_সেতু_প্রকৌশল_ও_শিল্পকলার_অনন্য_নিদর্শন
পার্সটুডে: ইরানের ইস্ফাহান প্রদেশের জায়ানদে নদীর উপর নির্মিত সি-ও-সে পোল, খাজু, শাহরেস্তান, জুবি এবং মারনান সেতু— সাফাভি যুগের প্রকৌশল শিল্পের অনন্য নিদর্শন হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।
(last modified 2025-09-24T12:49:37+00:00 )
সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৫ ১৮:৩১ Asia/Dhaka
  • ইস্ফাহানের ঐতিহাসিক ৫ সেতু: প্রকৌশল ও শিল্পকলার অনন্য নিদর্শন

পার্সটুডে: ইরানের ইস্ফাহান প্রদেশের জায়ানদে নদীর উপর নির্মিত সি-ও-সে পোল, খাজু, শাহরেস্তান, জুবি এবং মারনান সেতু— সাফাভি যুগের প্রকৌশল শিল্পের অনন্য নিদর্শন হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।

এই স্থাপত্যকীর্তিগুলো কেবল নদী পারাপারের পথ নয়, বরং শিল্প-সৌন্দর্যের সঙ্গে প্রকৌশলী দক্ষতার এক অসাধারণ সমন্বয়। এগুলো ইরানি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্থায়ী প্রতীক হিসেবে টিকে আছে।

শাহ আব্বাস প্রথমের (১৫৮৭–১৬২৯) শাসনামলে ইস্ফাহানকে “আধা জাহান” নামে খ্যাত এক সমৃদ্ধ রাজধানী শহরে রূপ দেওয়া হয়, যেখানে নগর পরিকল্পনা ও স্থাপত্যের এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছিল।

জায়ানদে নদীর সেতুগুলো কেবল অবকাঠামোই ছিল না; এগুলো সামাজিক কেন্দ্র, বাজার এবং শিল্পকলা উপস্থাপনের মঞ্চ হিসেবেও ব্যবহৃত হতো।

সাফাভি যুগের সেতুগুলো তিমুরি, ইলখানি ও সেলজুক আমলের তুলনায় অনেক উন্নত। বহুতল খিলান, সূক্ষ্ম টাইলশিল্প ও নদীর প্রবাহের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নির্মাণ এগুলোকে করে তুলেছিল জলবিদ্যুৎ ও প্রকৌশলের এক উৎকৃষ্ট নিদর্শন।

শাহরেস্তান সেতু

শাহরেস্তান সেতু

ইস্ফাহানের প্রাচীনতম মূল সেতু হলো শাহরেস্তান সেতু, যা জে ব্রিজ বা 'জাসর হোসেইন ব্রিজ' নামেও পরিচিত। এটি শহরের পূর্বদিকে পুরোনো নদীপথে অবস্থিত।

ঐতিহাসিক ও প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, শাহরেস্তান সেতুর ভিত্তি সাসানীয় যুগে (খ্রিস্টীয় ৩–৭ শতক) স্থাপিত হয়।

বুয়িদ ও সেলজুক আমলে (১০–১২ শতক) এটি ছিল শহরের মধ্যে জায়ানদে নদীর একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ সেতু। ঐ সময়গুলোতে এটি মেরামত ও সম্প্রসারণ করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।

ইট ও কাদা দিয়ে নির্মিত, আর পাথরের ভিত্তির ওপর দাঁড়ানো এই সেতুটি ছিল সামরিক ও বাণিজ্যিক যোগাযোগের পথ। ১১২.৫ মিটার দৈর্ঘ্যের এই সেতুর ১১টি খিলান ও ৪.৮ মিটার প্রস্থ রয়েছে। পরবর্তী সেতুগুলোর তুলনায় এটি অপেক্ষাকৃত সরল স্থাপনা।

সাফাভি যুগে এর চূড়ান্ত রূপ দেওয়া হয়, তখন উত্তরের দিকে একটি টোলগেটও নির্মিত হয়। বর্তমানে এটি কেবল পথচারীদের জন্য ব্যবহৃত হয়।

মারনা'ন সেতু

মারনা'ন সেতু

মারনা'ন সেতুটি শহরের পশ্চিমে, শাহরেস্তান সেতুর প্রায় আট কিলোমিটার উজানে অবস্থিত। ঐতিহাসিক দলিলে এর বিভিন্ন নাম পাওয়া যায়— মারবানা'ন, মারবিন, সারফরাজ ও আব্বাস আবাদ।

গবেষকদের ধারণা, এটি প্রথম নির্মিত হয় শাহ তাহমাস্প প্রথম-এর (১৫২৪–১৫৭৬) আমলে, আর পরে শাহী সুলাইমানের শাসনামলে (১৬৬৬–১৬৯৪) জোলফার আর্মেনীয়রা এটি সংস্কার করেন।

১৮০ মিটার দীর্ঘ এই সেতু উত্তর-দক্ষিণমুখী এবং এতে ১৭টি খিলান রয়েছে। এর প্রস্থ ৪.৭ থেকে ৬.৬ মিটার পর্যন্ত ভিন্ন। কাজার যুগে এর পাশে একটি শহরদ্বার ছিল।

এটি নকশা ও সরলতার দিক থেকে শাহরেস্তান সেতুর মতোই, যেখানে পাথরের ভিত্তি ও পিলার, সূচালো ইটের খিলান এবং পিলারের ওপর প্রশমিত খোলা জায়গা রয়েছে।

১৯৭০-এর দশকে এটি পুনর্নির্মাণ করা হয়, কারণ বন্যায় দক্ষিণাংশের ছয়টি খিলান ধসে পড়েছিল।

সি-ও-সে-পোল

সি-ও-সে-পোল: শহরের মেরুদণ্ড

সত্যিকারের সাফাভি প্রকৌশলের সূচনা ঘটে সি-ও-সে-পোল বা “৩৩ খিলানের সেতু” দিয়ে। ইতিহাসে এটি বিভিন্ন নামে পরিচিত: আল্লাভেরদি খান ব্রিজ, আব্বাস ব্রিজ, চাহারবাগ ব্রিজ, জোলফা ব্রিজ, জায়ানদে নদীর ব্রিজ এবং দ্য গ্রেট ব্রিজ।

১৫৯০-এর শেষ দিকে রাজধানী কাজভিন থেকে ইস্ফাহানে স্থানান্তরের পর শাহ আব্বাস প্রথম শহরকে দক্ষিণে জায়ানদে নদীর দিকে সম্প্রসারণের নির্দেশ দেন।

শহরের এই নগর পরিকল্পনার মূল অক্ষ ছিল ১.৬৫ কিমি দীর্ঘ চাহারবাগ বুলেভার্ড, যার দক্ষিণ প্রান্তেই ছিল সি-ও-সে-পোল।

সেতুটি রাজকীয় উদ্যান ও নতুন জোলফা এলাকায় (অটোমান হামলা থেকে পালিয়ে আসা আর্মেনীয়দের জন্য গড়ে তোলা) যোগাযোগের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

সি-ও-সে-পোল

বিশ্বের অন্যান্য সেতুর তুলনায় এটি অস্বাভাবিকভাবে নদীর সবচেয়ে প্রশস্ত অংশে নির্মিত হয়, যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৩০০ মিটার।

এই সেতুর নির্মাণ তদারকি করেছিলেন খ্যাতিমান সাফাভি সেনাপতি আল্লাভেরদি খান, যিনি পর্তুগিজ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে বিজয়ের জন্য খ্যাতি ও সম্পদ অর্জন করেছিলেন।

ইতিহাসবিদদের মতে, সেতুটি শুধু আঞ্চলিক নয়, ইউরোপীয় মিত্র ও প্রতিদ্বন্দ্বীদেরও মুগ্ধ করার জন্য নির্মিত হয়েছিল, যাতে ইস্ফাহানকে অটোমান ইস্তাম্বুল ও মুঘল দিল্লির চেয়ে উন্নত দেখানো যায়।

আকাশ থেকে তোলা সি-ও-সে-পোল-এর ছবি

১৭শ শতকে ইস্ফাহান ছিল বিশ্বের বৃহত্তম শহরগুলোর একটি, যার জনসংখ্যা ৬ থেকে ১১ লাখের মধ্যে অনুমান করা হয়।

সেতুটি ছিল কেবল যোগাযোগের পথ নয়; এটি ছিল একটি বাঁধ, যা পানি আটকে শহরের উদ্যান ও বাড়িঘরে খাল (মা’দি) দিয়ে সরবরাহ করত।

সেতুর স্থাপত্যে দ্বিস্তরীয় খিলান, ৩৩টি প্রধান খিলান— যা আর্মেনীয় খ্রিস্টানদের কাছে যিশু খ্রিস্টের বয়সের প্রতীক— এবং মোট ৯৯টি খিলান, যা ইসলামে আল্লাহর নামের প্রতীক, এক অনন্য সমন্বয় তৈরি করেছে।

ইতিহাসবিদ, ভ্রমণকারী ও কবিদের বর্ণনায় সি-ও-সে-পোলকে ইরানের সবচেয়ে মহিমান্বিত স্থাপত্যকীর্তি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

৩০০ মিটার দৈর্ঘ্যের সি-ও-সে-পোল সেতু তৈরিতে কারিগরি দক্ষতার প্রমাণ মেলে

খাজু সেতু

সি-ও-সে-পোল থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার ভাটিতে অবস্থিত খাজু সেতু আকারে ছোট হলেও নকশা ও কার্যকারিতায় তার অনুরূপ।

১৬৫০ সালে শাহ আব্বাস দ্বিতীয়ের আমলে নির্মিত এই সেতু ১৩২ মিটার লম্বা ও ১২ মিটার চওড়া। এটি শুধু পারাপারের পথ নয়, বরং অবসর, উৎসব ও সামাজিক আড্ডার কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। এর কেন্দ্রে একটি অষ্টকোণী প্যাভিলিয়ন রয়েছে, যেখানে রাজা বসে নদী ও আশেপাশের দৃশ্য উপভোগ করতেন।

খাজু সেতুতে উৎসবমুখর নওরোজ অনুষ্ঠান, আলোকসজ্জা, আতশবাজি ও নৌকাবাইচ হতো। সেই সময়ের বিখ্যাত কবি সাএব তাবরিজি তাঁর কবিতায় এসব অনুষ্ঠানকে অমর করেছেন।

খাজু সেতু

জুবি সেতু

শাহ আব্বাস দ্বিতীয়ের শাসনামলে ১৬৬৫ সালে নির্মিত জুবি সেতুটি সি-ও-সে-পোল ও খাজু সেতুর মধ্যে অবস্থিত। এটি সাদাতাবাদ উদ্যানের সঙ্গে সংযুক্ত থাকায় সাদাতাবাদ ব্রিজ নামেও পরিচিত।

জুবি সেতু ছিল কেবল রাজকীয় ব্যবহারের জন্য। এটি রাজকীয় উদ্যান ও প্রাসাদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করত। একতলা এই সেতুতে ২১টি খিলান রয়েছে এবং এটি ছিল উভয়ই একটি পারাপারের পথ ও জলসেচের খাল, যা সাদাতাবাদ ও কারান উদ্যানগুলোতে পানি সরবরাহ করত।

সেতুটি ১৪৭ মিটার লম্বা ও ৪ মিটার প্রশস্ত। এতে দুটি অষ্টকোণী প্যাভিলিয়ন রয়েছে, যেখানে অবসর উপভোগের জন্য জানালাও খোলা ছিল।

এইভাবে, ইস্ফাহানের সেতুগুলো শুধু স্থাপত্যশিল্প ইতিহাস, সংস্কৃতি, ধর্মীয় বৈচিত্র্য ও নগরজীবনের এক অনন্য প্রতীক হয়ে টিকে আছে।#

পার্সটুডে/এমএআর/২৪