ফিলিস্তিনের উলামা পরিষদ প্রধান:
'আল আকসা তুফান' অভিযান পশ্চিমা গণতন্ত্রের মিথ্যা মুখোশ উন্মোচন করেছে
-
নওয়াফ তাকুরুরি
পার্সটুডে: ফিলিস্তিনের উলামা পরিষদের প্রধান বলেছেন, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর সংঘটিত 'আল আকসা তুফান' নামক ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধাদে সাহসী অভিযান একটি বৈশ্বিক জাগরণে রূপ নিয়েছে।
পার্সটুডে জানিয়েছে, 'আল আকসা তুফান' অভিযানের দ্বিতীয় বার্ষিকী উপলক্ষে ফিলিস্তিনের উলামা পরিষদের প্রধান 'নওয়াফ তাকুরুরি' ঐতিহাসিক এই অভিযানের গুরুত্ব, ইসরায়েলি দখলদার শাসকগোষ্ঠী এবং গাজায় চলমান গণহত্যার ওপর এর প্রভাব নিয়ে একটি বিশ্লেষণী বক্তব্য দিয়েছেন।
'আল আকসা তুফান' ইসরাইলকে বিশ্বের কাছে অপমানিত করেছে
নওয়াফ তাকুরুরি বলেন, “ইসরায়েল দীর্ঘ দশক ধরে নিজেদের অজেয় সামরিক শক্তি, গোয়েন্দা শ্রেষ্ঠত্ব ও পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের এক ভ্রম তৈরি করেছিল। কিন্তু 'আল আকসা তুফান' সেই ভ্রমকে ভেঙে দিয়েছে। এই ঝড় দখলদারদের শক্তির মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে এবং ইসরায়েল গোটা বিশ্বের সামনে অপমানিত হয়েছে।”
তিনি আরও যোগ করেন, "ইসরাইলি নিয়ন্ত্রিত এলাকায় অনুপ্রবেশ, সামরিক ঘাঁটি দখল এবং ইসরাইলি সৈন্যদের বন্দী করতে প্রতিরোধ গোষ্ঠীদের সক্ষমতা- দখলদারদের উপর একটি মানসিক ও কৌশলগত আঘাত হানে, যা ১৯৪৮ সালের পর অভূতপূর্ব।
গণহত্যা হচ্ছে ক্ষমতা নয়, অসহায়ত্বের প্রকাশ
ফিলিস্তিনের উলামা পরিষদের প্রধান জোর দিয়ে বলেন, আল-আকসা তুফান অপারেশনের পর থেকে, ইহুদিবাদী ইসরায়েল গাজার উপর একটি পূর্ণাঙ্গ হামলা চালিয়েছে; যা এখন গণহত্যা, অনাহার ও ধ্বংসের এক প্রচারণায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু এই নৃশংসতা আত্মবিশ্বাসের ফল নয়, বরং ভয়ের ও অপমানের প্রতিফলন। আজ দখলদাররা যে প্রতিটি অপরাধ করছে, তা কেবল হারানো মর্যাদা ফেরানোর এক মরিয়া চেষ্টা।”
তিনি বলেন, “তাদের এসব হত্যাযজ্ঞ উন্মত্ততার প্রকাশ। তারা তাদের গল্পের নিয়ন্ত্রণ, সামরিক মর্যাদা ও নৈতিক অবস্থান হারিয়েছে। তারা হত্যা করছে— শক্তিশালী দেখাতে, অথচ প্রতিটি বোমা তাদের দুর্বলতাকেই আরও নগ্ন করে তুলছে।”
একটি ঝড় যা বৈশ্বিক হয়ে উঠল
এই বিশ্লেষণে আরও বলা হয়েছে, আল-আকসা তুফান অপারেশন গাজার সীমানায় সীমাবদ্ধ থাকেনি, এর প্রভাব বিভিন্ন মহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে, ইহুদিবাদী রাষ্ট্রের ভণ্ডামি ও কপটতা উন্মোচন করেছে এবং সংহতি জাগ্রত করেছে। এই ঝড় সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। এটি মুক্ত মানুষের, শিক্ষার্থীদের, কর্মীদের এবং নাগরিকদের নীতিবাদী ও মানবিক চিত্র তুলে ধরেছে যারা লন্ডন, নিউইয়র্ক, মাদ্রিদ ও জাকার্তার রাস্তায় নেমে এসেছে। একই সময়ে, এটি পশ্চিমা গণতন্ত্রের মিথ্যাকে উন্মোচিত করেছে, ওয়াশিংটন ও প্যারিস থেকে বার্লিন পর্যন্ত, যেখানে তাদের নেতারা স্বাধীনতার কথা বলেন কিন্তু গণহত্যাকে সমর্থন করেন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, “২০২৩ সালের অক্টোবরের পর থেকে বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষ নজিরবিহীনভাবে ফিলিস্তিনের সমর্থনে বিক্ষোভে নেমেছে। স্পেন, আয়ারল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলো সাহসী অবস্থান নিয়েছে, আর তথাকথিত ‘মানবাধিকার রক্ষাকারী’ মার্কিন ও ইউরোপীয় শক্তিগুলো দখলদারদের অস্ত্র দিচ্ছে এবং জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে ভেটো দিচ্ছে। ফলে পশ্চিমা নেতৃত্বের নৈতিক ভাবমূর্তি আরও গভীরভাবে ভেঙে পড়েছে।”
স্বাভাবিকীকরণ প্রকল্প সত্যের কাছে ধসে পড়েছে
ফিলিস্তিনের উলামা পরিষদের প্রধান জোর দিয়ে বলেন, আল-আকসা তুফানের আগে, বেশ কয়েকটি আরব দেশ ইহুদিবাদী ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিল। আজ, সেই প্রকল্পগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এই ঝড় যে কোনো সৎ মানুষের জন্য স্বাভাবিকীকরণের পথ বন্ধ করে দিয়েছে। যারা একসময় দখলদারকে আলিঙ্গন করতে চেয়েছিল, তারা এখন তাদের নিজেদের মানুষের কাছে লজ্জিত ও নীরব। যদি স্বাভাবিকীকরণ চলতেই থাকে, তবে তা হবে দুর্নীতিবাজ নেতাদের কাছ থেকে, জনগণের কাছ থেকে নয়। মুসলিম উম্মাহ তাদের চূড়ান্ত কথা বলেছে: ফিলিস্তিন বিক্রয়যোগ্য নয়।
মানবতার জন্য নৈতিক জাগরণ
এই বিশ্লেষণে জোর দেওয়া হয়েছে যে, আল-আকসা তুফান অভিযান যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরেও একটি বৈশ্বিক নৈতিক জাগরণ সৃষ্টি করেছে। গাজা থেকে অটলতা ও বিশ্বাসের ছবি বিশ্বজুড়ে আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করেছে এবং কর্মী, শিক্ষার্থী ও সাধারণ নাগরিক তাদের সরকারের নীরবতাকে চ্যালেঞ্জ করছে।
গাজাবাসী তাদের কষ্ট দিয়ে বিশ্বের বিবেককে জাগিয়ে তুলেছে। পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়ের যুবকরা, রাস্তায় বিক্ষোভকারীরা, যারা বয়কট করে এবং সত্য কথা বলে; এর সবই আল আকসা তুফানের ফল।
এক স্থানীয় প্রতিরোধ থেকে বৈশ্বিক আন্দোলনে
তাকরুরি বলেন, “আল-আকসা তুফান অভিযানের দুই বছর পর, ফিলিস্তিনিদের সংগ্রাম এখন এক স্থানীয় প্রতিরোধ থেকে রূপ নিয়েছে বৈশ্বিক ইসলামী আন্দোলনে। ইয়েমেন থেকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, লেবাননের হিজবুল্লাহর সীমান্ত লড়াই, জাকার্তা থেকে জোহানেসবার্গ পর্যন্ত সংহতির মিছিল—সবই প্রতিরোধ ফ্রন্টের সম্প্রসারণের প্রমাণ।”
তিনি উপসংহারে বলেন, “ফিলিস্তিনের সংগ্রাম এখন ইসলামী বিশ্বের নৈতিক দিকনির্দেশনায় পরিণত হয়েছে— এমন এক আদর্শ যা নিপীড়িতদের একত্রিত করে এবং অত্যাচারীদের ভণ্ডামি উন্মোচন করে।”
“আল-আকসা তুফান কেবল একটি সামরিক অভিযান ছিল না— এটি ছিল এক আদর্শের পুনর্জন্ম, এক জাতির জাগরণ এবং দীর্ঘ দখলের অবসানের সূচনা।”#
পার্সটুডে/এমএআর/৭