রাশিয়া ইসরাইলের মতো ১৭০ সাংবাদিককে হত্যা করলে পশ্চিমা মিডিয়া কী করতো?
গত বছর ৭ অক্টোবর,গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরাইলি সেনারা সব রকমের যুদ্ধাপরাধে লিপ্ত হওয়া ছাড়াও প্রায় ১৭০ ফিলিস্তিনি সাংবাদিককে শহীদ করেছে এবং আহত হয়েছে আরো বহু সাংবাদিক। গাজার প্রকৃত অবস্থা যাতে বাইরের দেশের মানুষ জানতে না পারে সেজন্যই সাংবাদিক হত্যা করেছে ইসরাইল।
পার্সটুডে জানিয়েছে, 'মার্ক গ্লেন' একজন বিখ্যাত মার্কিন লেখক ও সাংবাদিক। তিনি ইরানের মেহর বার্তা সংস্থার সাথে এক সাক্ষাত্কারে ফিলিস্তিন ইস্যুতে পশ্চিমা দেশগুলোর দ্বিমুখী নীতি সম্পর্কে কিছু কথা বলেছেন। এখানে তার সেই সাক্ষাতকারের অংশ তুলে ধরা হলো:
ইসরাইলি সেনারা গাজা যুদ্ধে এ পর্যন্ত বহু সংখ্যক সাংবাদিককে হত্যা করেছে। এই হত্যাকাণ্ডকে কি কাকতালীয় বলে মনে করেন? নাকি তাদেরকে ইচ্ছাকৃতভাবে টার্গেট করা হয়েছিল?
যেসব বুদ্ধিমান ব্যক্তি যারা ইসরাইলকে ভালো করেই চেনে তারা জানেন যে, ইসরাইলি সেনারা ইচ্ছাকৃত এবং পরিকল্পিতভাবে সাংবাদিকদের হত্যা করেছে। হত্যাকাণ্ড, জবরদখল, প্রতারণা ও মিথ্যাচারিতার ওপর ভর করে ইসরাইল নামক অবৈধ রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে। এরাই গাজার স্কুলে কিংবা সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালিয়ে বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে দাবি করে ভুলক্রমে তারা ওই হামলা চালিয়েছে। কিন্তু এটা তাদের অপরাধের অংশ মাত্র। তারা শুধু সাংবাদিকদেরকে শুধু যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হত্যা করছে তাই নয় বরং এটাকে তারা খুবই উপভোগ্য বলে মনে করে।
বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র বিকাশের জন্য সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি, কিন্তু তারপরও কেন ইসরাইল সাংবাদিকদের টার্গেট করেছে?
গ্রীস, রোম, পারস্য, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য বা দূরপ্রাচ্যের বিভিন্ন যুগের ইহুদিরা শিখেছে অইহুদিদের চিন্তাভাবনা কেমন এবং সেই অনুযায়ী তারা জাতিগুলোর সাথে আচরণ করে বা নিজেদের চিন্তাকে কাজে লাগায়। এই কারণে, ১৮৯৮ সালে থিওডর হার্জেল কর্তৃক ইহুদিবাদীদের প্রথম কলঙ্কজনক কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হওয়ার পরপরই, তাদের মনে ফিলিস্তিন এবং বাকি মধ্যপ্রাচ্যকে দখল করার অভিপ্রায় তৈরি হয়েছিল। আর এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য ইহুদিবাদীরা সেই সময়ে আমেরিকাসহ পাশ্চাত্য বিশ্বের প্রধান গণমাধ্যমগুলোকে কব্জা করেছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল যে, তাদের সেই লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে হলে সারা বিশ্বের জনগণের চিন্তাচেতনার ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে হবে। অর্থাৎ ইহুদিদের নিয়ন্ত্রিত মিডিয়াগুলো যে খবর দেবে, যে ছবি দেবে তাই বিশ্বের জনগণকে বিশ্বাস করতে হবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে তথ্য সংগ্রহের জন্য সাংবাদিকদের উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা থাকা সত্ত্বেও কেন ইসরাইল সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকে টার্গেট করেছে? প্রকৃতপক্ষে, ইসরাইল গণতন্ত্রে আগ্রহী নয় এবং কখনও ছিল না এবং আগামীতেও হবেও না। যেমন দুর্নীতিগ্রস্ত এবং জঘন্য ব্যক্তিরা তাদের শরীরের দুর্গন্ধ লুকানোর জন্য সুগন্ধি ব্যবহার করে, তেমনি ইসরাইলও তার অপরাধী কর্মকাণ্ডের যৌক্তিকতা তুলে ধরতে গণতন্ত্রের মতো শব্দের আশ্রয় নেয়। ইসরাইলের আচরণের সাথে উগ্র তাকফিরি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দায়েশ বা আইএস-এর আচরণের হুবহু মিল রয়েছে। আইএস জঙ্গিরা যেমন ভিন্নমতকে সহ্য করতে পারে না এবং অত্যন্ত নৃশংস আচরণ করে তেমনি ইসরাইলও একই আচরণ করে।
আপনি জানেন যে, সাংবাদিকরা সত্য ঘটনাকেই তুলে ধরে। অথচ এই সাংবাদিক হত্যায় ইসরাইলি ভূমিকার ব্যাপারে ইউরোপীয় দেশগুলো সম্পূর্ণ নীরব রয়েছে। ইউরোপের এই দ্বিমুখী নীতির কি ব্যাখ্যা থাকতে পারে? ইউক্রেন যুদ্ধে যদি রাশিয়ান বাহিনী প্রায় ১৭০ সাংবাদিককে হত্যা করে, তখন পশ্চিমা মিডিয়া কী করবে?
যেমনটি আগেই বলেছি, গত এক শতাব্দীতে ইসরাইল সব ধরনের গণযোগাযোগ ও মিডিয়া দখল করতে শুরু করে এবং এই লক্ষ্য তারা অর্জন করে। এরপর তারা ধীরে ধীরে সেই সমস্ত সংবাদপত্র বা সংবাদ সংস্থাগুলোকে সংবাদ পরিবেশন বা বিশ্লেষণের বিষয়গুলো নির্ধারণ করে দেয়া শুরু করে। যেসব সাংবাদিক এই নির্দেশ মানতে রাজি হতো না তাদেরকে শুধু যে বহিস্কার করো হতো তাই নয় একই সাথে সমস্ত মিডিয়া অঙ্গন থেকে তাদেরকে বিচ্ছিন্ন রাখা হতো। ইহুদিবাদীরা তাদের অবস্থানের বিরুদ্ধে ভিন্নমতের কণ্ঠস্বর বা প্রতিবাদ মেনে নিতে পারে না এবং মধ্যপ্রাচ্যে লুট তরাজ ও সকল অপকর্মের তালিকার শীর্ষে রয়েছে ইহুদিবাদীরা।
মূলত, প্রশংসা পাবার ইচ্ছা মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। এছাড়া, মানব প্রকৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, নৈতিক বিষয়গুলোর চেয়ে ঝামেলামুক্ত সহজ কাজের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বেশি। সাংবাদিকরাও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে, অনেক সাংবাদিক আছে যারা সত্য বলে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। তাই আমি বলতে পারি খুব কম স্বাধীন মিডিয়া আছে যারা কি ঘটছে তার একটি সম্পূর্ণ এবং সঠিক চিত্র তুলে ধরতে ইচ্ছুক।
বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক মিডিয়া দাবি করে যে তারা সত্য বলতে ভয় পায় না, কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, যখন কোনো ঘটনা ঘটে তখন তারা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো এড়িয়ে যায়। ওই ঘটনা সম্পর্কে তারা যদি বিশদ বিবরণ দিয়েও থাকে তখন তারা কাহিনীকে বিকৃত করে ভিন্নভাবে বর্ণনা করে।
কোনো একটি খবর সত্য না মিথ্যা তা যাচাইএর জন্য সে ব্যাপারে ইহুদিবাদীরা কি বলছে সেটা আমি লক্ষ্য করি। যদি তারা যা বলে তা নেতিবাচক হয়, তাহলে সেই রিপোর্টের ব্যাপারে আমার আস্থা তৈরি হয়।
গাজায় মিডিয়াকর্মীদের জীবন রক্ষার জন্য সারা বিশ্বের সাংবাদিক ও কর্মীরা কী ব্যবস্থা নিতে পারে?
দুর্ভাগ্যবশত, আমরা একটি হাতি এবং একটি পিঁপড়ার মধ্যে যুদ্ধের মতো পরিস্থিতির মধ্যে আছি। অবশ্য সামরিক শক্তির দিক থেকে ইসরাইল, আমেরিকা ও পশ্চিমাদের পরাজিত করা কঠিন হলেও পরিস্থিতি এক্ষেত্রে ভিন্ন দিকে মোড় নিয়েছে। গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়া পর গণহত্যায় জড়িত ইসরাইল, আমেরিকা এবং পশ্চিমারা তাদের গায়ের দুর্গন্ধ আড়াল করার জন্য যে সুগন্ধি এবং পারফিউম ব্যবহার করেছে এতোদিন, তা শেষ হয়ে গেছে। বিবেকবান জাতিগুলো ইরানকে সমর্থন দিচ্ছে এবং তারা ইসরাইল নামক দানবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। হয়তো খুব শীঘ্রই ইসরাইল ধ্বংস হয়ে যাবে। #
পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/১৩
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।