বিশ্লেষণ:
ইরানের ওপর আরোপিত নতুন মার্কিন নিষেধাজ্ঞাগুলোর উদ্দেশ্য
-
ইরানের তেল রপ্তানি বন্ধের ব্যর্থ মার্কিন চেষ্টা
পার্সটুডে – ইরানের তেল বিক্রি রোধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
পার্স-টুডে জানিয়েছে গতকাল মঙ্গলবার মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ তেহরানের বিরুদ্ধে ওয়াশিংটনের সর্বোচ্চ চাপের ধারাবাহিকতায়, তেহরানের তেল বিক্রিতে ভূমিকা রাখা এবং ইরান-বিরোধী নিষেধাজ্ঞা এড়াতে ভূমিকা রাখার অজুহাতে ৭টি কোম্পানি এবং ৯টি তেল ট্যাংকারকে নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে।
মার্কিন ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট দাবি করেছে যে আজকের এই পদক্ষেপটি ৩ জুলাই, ২০২৫ তারিখে মার্কিন ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের বৈদেশিক সম্পদ নিয়ন্ত্রণ অফিস (OFAC) কর্তৃক জারি করা নিষেধাজ্ঞার উপর ভিত্তি করে নেয়া হয়েছে, সে সময় সেলিম আহমেদ সাঈদ নেটওয়ার্ককে লক্ষ্য করে নিষেধাজ্ঞার ওই কর্মসূচি তৈরি করা হয়েছিল। আমেরিকানদের মতে, এই নেটওয়ার্কটি ইরাকি ও ইরানি তেল মিশ্রভাবে পাচার করত এবং ইরান সরকারের জন্য উল্লেখযোগ্য রাজস্ব আয় করত।
মার্কিন এই বিভাগ থেকে আরও দাবি করা হয়েছে যে ইরাকের অর্থনীতির ওপর ইরানের যে প্রভাব রয়েছে তা ঠেকাতে মার্কিন সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ তারিখে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানের ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ চাপের নীতি অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে একটি স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর করেন, যেখানে দাবি করা হয় যে তিনি ইরানের রাষ্ট্রপতির সাথে কথা বলতে প্রস্তুত।
কিন্তু ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পাঁচ দফা পরোক্ষ আলোচনা ও তেহরানের প্রতি কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির দাবি এবং ষষ্ঠ দফা আলোচনা ১৫ জুন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকা সত্ত্বেও গত ১৩ জুন, ২০২৫ তারিখে ইসরায়েল তেহরানের বিভিন্ন এলাকা ও ইরানি পারমাণবিক স্থাপনাসহ আরও কিছু শহরকে সামরিক আক্রমণের শিকার করে এবং এতে বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী, সামরিক কমান্ডার ও বেসামরিক নাগরিক শহীদ হন।
২২শে জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ফোরদো, নাতানজ ও ইসফাহানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলিতেও আক্রমণ করে এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সশস্ত্র বাহিনী এই সামরিক আগ্রাসনের জবাব দেয়। ওয়াশিংটনের এই পদক্ষেপ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কোনও অনুমোদন ছাড়াই জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রের উপর আক্রমণ করার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবৈধ পদক্ষেপের দৃষ্টান্ত, সেইসাথে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা এবং এনপিটির আইনি ধারাগুলোর সম্পূর্ণ পরিপন্থী কর্মকাণ্ড।
সামরিক হামলার পর মার্কিন সরকার এখন ইরানের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ চাপ-প্রয়োগ অভিযানের কাঠামোর মধ্যে ও নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে ইরানের তেল রপ্তানি হ্রাস বা বন্ধ করার জন্য সর্বাধিক চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করছে, যার এক একটি নতুন দফা সময়ে সময়ে ঘোষণা করা হয়। এটা স্পষ্ট যে ইরানের তেল রপ্তানির ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য হল ইসলামী প্রজাতন্ত্রের ওপর অর্থনৈতিক চাপ বৃদ্ধি করা এবং এর আর্থিক সম্পদ সীমিত করা।
এই পদক্ষেপগুলো "সর্বোচ্চ চাপ"-এর নীতি বা কৌশলের অংশ যার লক্ষ্য ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি, গোটা অঞ্চলে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলনের প্রতি সমর্থন এবং উন্নত অস্ত্র, বিশেষ করে ক্ষেপণাস্ত্রের উন্নয়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আচরণ পরিবর্তন করতে ইরানকে বাধ্য করা।
ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞাগুলোর প্রধান কয়েকটি লক্ষ্য:
সশস্ত্র বাহিনী ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং সশস্ত্র বাহিনীর জন্য সহায়তা ও পুলিশ বাহিনীসহ সামরিক ও নিরাপত্তা কর্মসূচির তহবিল সরবরাহের ক্ষেত্রে ইরান সরকারের আর্থিক ক্ষমতা সীমিত করার লক্ষ্যে ইরানের তেল রাজস্ব হ্রাস করা। এ ছাড়াও
ইরানের তেল বিক্রয় নেটওয়ার্কের ব্যাঘাত ঘটানো, নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে যাওয়ার ইরানি প্রচেষ্টাগুলোকে প্রতিরোধ করা, ইরানের জ্বালানী কূটনীতিকে দুর্বল করা এবং পরমাণু আলোচনায় ফিরে আসতে ইরানকে বাধ্য করার লক্ষ্যে চাপ জোরদার এইসব নতুন নিষেধাজ্ঞার কয়েকটি বড় লক্ষ্য।
তেল রপ্তানির উপর নতুন মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রতি ইরানের প্রতিক্রিয়া
ইরানের প্রতিক্রিয়া সাধারণত রাজনৈতিক অবস্থান, কূটনৈতিক পদক্ষেপ এবং নিষেধাজ্ঞার অর্থনৈতিক প্রভাব প্রশমিত করার প্রচেষ্টার সমন্বয়ে তৈরি। সাম্প্রতিক তেল নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রে, ইরান বহুমুখী প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে:
সরকারি অবস্থান: নিষেধাজ্ঞার নিন্দা:
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সহ ইরানি কর্মকর্তারা নতুন নিষেধাজ্ঞাগুলিকে "অবৈধ" এবং "আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন" বলে অভিহিত করেছেন এবং জোর দিয়ে বলেছেন যে এই পদক্ষেপগুলি ইরানের ইচ্ছাকে প্রভাবিত করবে না।
প্রতিরোধের পথ অব্যাহত রাখা: ইরান ঘোষণা করেছে যে তারা তেল রপ্তানি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের নীতি অব্যাহত রাখবে এবং এই নিষেধাজ্ঞাগুলোকে একটি গুরুতর বাধা বলে মনে করে না।
বাস্তবিক পদক্ষেপ
এশীয় অংশীদারদের সাথে সহযোগিতা বৃদ্ধি: এই ক্ষেত্রে, ইরান নিষেধাজ্ঞার চাপ কিছুটা নিরপেক্ষ করার জন্য চীন, ভারত এবং রাশিয়ার মতো দেশগুলির সাথে তার অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার চেষ্টা করেছে।
তেল বিক্রির বিকল্প পদ্ধতি ব্যবহার করা, যার মধ্যে রয়েছে মধ্যস্থতাকারী কোম্পানি ব্যবহার করা, পরিবহন রুট পরিবর্তন করা এবং বিনিময় বা বার্টার পদ্ধতি বা ডলার-বহির্ভূত মুদ্রায় তেল বিক্রি করা।
প্রতিবেশী দেশ ও নিষেধাজ্ঞা বিরোধী ব্লকগুলির সাথে সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি: ইরান মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নীতির বিরোধিতাকারী দেশগুলির সাথে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সহযোগিতা সম্প্রসারণের চেষ্টা করছে, যেমন কিছু ব্রিকস সদস্য।
এছাড়াও, কিছু ক্ষেত্রে, ইরান নিষেধাজ্ঞার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার জন্য আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের মতো প্রতিষ্ঠানে অভিযোগ দায়ের করেছে। #
পার্সটুডে/এামএইচ/০৩
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।