নোবেল: শান্তির পুরস্কার নাকি মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের হাতিয়ার?
https://parstoday.ir/bn/news/world-i152906-নোবেল_শান্তির_পুরস্কার_নাকি_মনস্তাত্ত্বিক_যুদ্ধের_হাতিয়ার
পার্সটুডে: ভেনেজুয়েলার বিরোধীদলের নেতা 'মারিয়া কোরিনা মাচাদো'-কে ২০২৫ সালের শান্তির নোবেল পুরস্কার প্রদানের সিদ্ধান্তটি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, একাডেমিক অঙ্গন এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি করেছে।
(last modified 2025-11-28T10:09:50+00:00 )
অক্টোবর ১২, ২০২৫ ১৬:৫১ Asia/Dhaka
  • 'নোবেল শান্তি পুরস্কার' নামেই শান্তির প্রতীক, বাস্তবে এটির রাজনৈতিক রঙ দিন দিন গাঢ় হচ্ছে
    'নোবেল শান্তি পুরস্কার' নামেই শান্তির প্রতীক, বাস্তবে এটির রাজনৈতিক রঙ দিন দিন গাঢ় হচ্ছে

পার্সটুডে: ভেনেজুয়েলার বিরোধীদলের নেতা 'মারিয়া কোরিনা মাচাদো'-কে ২০২৫ সালের শান্তির নোবেল পুরস্কার প্রদানের সিদ্ধান্তটি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, একাডেমিক অঙ্গন এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি করেছে।

'শান্তির নোবেল পুরস্কার' মানুষের আদর্শ ও বিশ্বশান্তি প্রচারের প্রতীক হওয়া উচিত, কিন্তু এবারও এটি আগের বছরের মতোই একটি রাজনৈতিক রূপ নিয়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞ এই পুরস্কারকে শান্তির প্রতীক না বলে পশ্চিমাদের ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট 'নিকোলাস মাদুরো'-র সরকারের বিরুদ্ধে নরম যুদ্ধ (Soft War) বা মনস্তাত্ত্বিক চাপ প্রয়োগের কৌশলের অংশ হিসেবে দেখছেন।

পার্স টুডের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের শান্তির নোবেল পুরস্কার এমন এক সময়ে মাচাদোকে দেওয়া হয়েছে, যখন কারাকাস ও ওয়াশিংটনের সম্পর্ক ২০১৯ সালের পর থেকে সর্বোচ্চ উত্তেজনাপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে মার্কিন বাহিনী ক্যারিবীয় সাগরে “মাদকবিরোধী অভিযান”-এর নামে সামরিক মহড়া ও হামলা চালিয়েছে। মাদুরো সরকার সম্ভাব্য মার্কিন আগ্রাসনের আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। এর পাশাপাশি, পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো আবারও ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচার শুরু করেছে।

এমন পরিস্থিতিতে মাচাদোর মতো একজন ব্যক্তিত্ব, যিনি প্রকাশ্যে ওয়াশিংটনের হস্তক্ষেপকে সমর্থন করেছেন এবং বারবার 'মাদুরো সরকারের উৎখাতের প্রয়োজনীয়তা'-র কথা বলেছেন— তাঁকে শান্তির নোবেল পুরস্কার প্রদানকে 'কেবল মানবতাবাদী পদক্ষেপ' হিসেবে বিবেচনা করা কঠিন।

২০২৪ সালের জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আঞ্চলিক পর্যবেক্ষকরা অংশ নেওয়া সত্ত্বেও মাচাদো ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে তার সমর্থকদের রাস্তায় নামার আহ্বান জানান। পরবর্তীতে সেই বিক্ষোভ সহিংসতায় রূপ নেয়। এখন এ ধরনের ব্যক্তিত্বকে শান্তির পুরস্কার প্রদান এই প্রশ্ন উঠছে যে, 'নোবেল কমিটি কি এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে একটি স্বাধীন দেশের বৈধ রাজনৈতিক কাঠামো দুর্বল করার পথ প্রশস্ত করছে না?'

মার্কিন ভাষাবিদ, চিন্তাবিদ ও দার্শনিক নোয়াম চমস্কি উল্লেখ করেছেন, “সমকালীন যুগে নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রায়ই এমন বিরোধী শক্তিগুলোর বৈধতা বাড়াতে ব্যবহৃত হচ্ছে, যারা ওয়াশিংটনের নীতি অনুসরণ করে না।”

ভেনেজুয়েলার সরকারি গণমাধ্যম এই পুরস্কারকে আখ্যা দিয়েছে “ইতিহাসের সবচেয়ে রাজনৈতিক নোবেল” হিসেবে

এবারই প্রথম নয় যে, নোবেল শান্তি পুরস্কারকে রাজনৈতিক পক্ষপাতের অভিযোগের মুখে পড়তে হচ্ছে।

২০০৯ সালে, মাত্র কয়েক মাসের প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত বারাক ওবামাকে “আন্তর্জাতিক কূটনীতি জোরদারের প্রচেষ্টার” জন্য পুরস্কৃত করা হয়—যখন যুক্তরাষ্ট্র একসাথে ইরাক ও আফগানিস্তানে যুদ্ধ পরিচালনা করছিল।

১৯৯১ সালে অং সান সু চি মিয়ানমারে গণতন্ত্র আন্দোলনের জন্য পুরস্কার পান, কিন্তু পরবর্তীতে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর গণহত্যা চলাকালে তার নীরবতা তার ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ করে।

এই উদাহরণগুলো দেখায়, নোবেল শান্তি পুরস্কার ক্রমেই এক ধরনের 'প্রতীকী রাজনীতির উপকরণে' পরিণত হচ্ছে। মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ' (CSIS)-এর বিশ্লেষণও এই প্রবণতার ইঙ্গিত দেয়। এই থিংক ট্যাঙ্কের তথ্য অনুসারে, গত দুই দশকে শান্তির নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের প্রায় ৭০% প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পশ্চিমা রাজনৈতিক ধারার সাথে যুক্ত ছিলেন। এই কাঠামোগত মিলের কারণে, কিছু পর্যবেক্ষক শান্তির নোবেল পুরস্কারকে বিশ্বব্যাপী আদর্শের প্রতীক না বলে বরং আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় ক্ষমতার একটি প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করেন।

 'ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশন'-এর বিশ্লেষণেও স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, "নোবেল কমিটি যদিও একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান, এটি পশ্চিমা রাজনৈতিক ও গণমাধ্যমের প্রভাবে কাজ করে এবং এর সিদ্ধান্তগুলো প্রায়ই পশ্চিমা ভূ-রাজনৈতিক অগ্রাধিকারের প্রতিফলন।"

ভেনেজুয়েলার ক্ষেত্রেও সেই ধারা অব্যাহত। পুরস্কার ঘোষণার পরপরই মাচাদো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। ট্রাম্প তাকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, “আপনি লাতিন আমেরিকায় স্বাধীনতার কণ্ঠস্বর।”

এই মন্তব্য ভেনেজুয়েলা সরকারের কাছে ছিল একেবারে স্পষ্ট বার্তা—এই পুরস্কার রাজনৈতিক পরিবর্তনের বৈধতা দেওয়ার প্রচেষ্টা।

স্পেনের 'এল পাইস' পত্রিকা বামপন্থী রাজনীতিবিদ 'পাবলো ইগলেসিয়াস'-এর বক্তব্য উদ্ধৃত করে লিখেছে: "যদি স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক বিরোধীদের শান্তির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়, তাহলে হিটলারকেও দেওয়া যেতে পারে!" এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাবেক পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান 'জোসেপ বোরেল'-ও সতর্ক ভাষায় বলেছেন: "আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো তখনই তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখতে পারে যখন তারা রাজনৈতিক খেলায় জড়ানো এড়িয়ে যায়।"

বাস্তবতা হলো, নোবেল শান্তি পুরস্কার আধুনিক 'নরম যুদ্ধ' কাঠামোর অংশ হিসেবে ব্যবহার করা যায়—যেখানে উদ্দেশ্য হলো কোনো সরকারের বিরোধীদের 'বৈধতা প্রদান, আন্তর্জাতিক সহানুভূতি অর্জন, ও কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি।' এই কাঠামোর মধ্যে, ওয়াশিংটনের জন্য শান্তির নোবেল পুরস্কার রাস্তার শেষ নয়, বরং কারাকাসের বিরুদ্ধে বহুমুখী চাপের নতুন ধাপের সূচনা।

ভেনেজুয়েলার সরকারি গণমাধ্যম এই পুরস্কারকে আখ্যা দিয়েছে “ইতিহাসের সবচেয়ে রাজনৈতিক নোবেল” এবং “মনস্তাত্ত্বিকভাবে সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা”-এর অংশ হিসেবে।

এখন প্রশ্ন হলো- এই পুরস্কার কি ভেনেজুয়েলায় সংলাপ ও রাজনৈতিক সহাবস্থান শক্তিশালী করবে, নাকি বিপরীতভাবে, অভ্যন্তরীণ বিভাজন তীব্রতর করে এবং সংঘাতের আশঙ্কা বাড়িয়ে দেবে? উত্তর যাই হোক না কেন, একটি সত্য স্পষ্ট: প্রকৃত শান্তি রাজনৈতিক পুরস্কার দিয়ে নয়, বরং জাতীয় সার্বভৌমত্ব, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং জাতিগুলোর মধ্যে সমতার সংলাপের প্রতি শ্রদ্ধার মাধ্যমে অর্জন করা যায়। শান্তির নোবেল পুরস্কার যদি এই নীতি থেকে দূরে সরে যায়, তবে তা আর শান্তির মুকুট হবে না, বরং শান্তির প্রকৃত অর্থে বিশ্বব্যাপী বিশ্বাসের গোড়ায় কুঠারাঘাত করবে।

যেমন নরওয়েজিয়ান শান্তি গবেষণা ইনস্টিটিউটের হেনরিক অর্দাল সতর্ক করেছেন, “যদি নোবেল শান্তি পুরস্কার রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে ব্যবহৃত হয়, তবে এটি আর শান্তির প্রতীক নয়—বরং বিশ্বজনীন আস্থার ভিত্তিকে নাড়িয়ে দেওয়া এক রাজনৈতিক অস্ত্র।”

পার্সটুডে/এমএআর/১২