ইউক্রেনে টমাহক পাঠানোর হুমকি ট্রাম্পের- কূটনৈতিক চাল নাকি সামরিক উসকানি?
-
রাশিয়া বলছে: টমাহক পাঠালে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে জড়াবে
পার্সটুডে: রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যদি ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধ না করেন, তবে কিয়েভকে দূরপাল্লার টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র দেওয়ার প্রস্তাব বিবেচনা করবেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। গতকাল (সোমবার) ইসরায়েলের উদ্দেশে রওনা দেওয়ার আগে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন তিনি।
পার্সটুডে জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য টমাহক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেনে পাঠানোর ঘোষণা মস্কোর উপর ওয়াশিংটনের চাপের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে হুমকিপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে, ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও তার পরিচিত 'চাপ, হুমকি এবং আলোচনা'র কৌশলে ফিরে গেছেন, যা শুধু ইউক্রেন যুদ্ধ নয়, বরং বৈশ্বিক ক্ষমতার ভারসাম্যকেও নতুন দিকে ঠেলে দিতে পারে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, "ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে তিনি টমাহক ক্ষেপণাস্ত্রসহ যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে আলোচনা করেছেন।"
বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের এই অবস্থান রাশিয়ার সাথে আলোচনার দরজা খোলার জন্য মস্কোর উপর মার্কিন চাপের একটি নতুন পর্যায়ের সূচনা করে।
ট্রাম্প বলেছেন, "আমার হয়ত পুতিনের সাথে টমাহক নিয়ে কথা বলতে হবে। তিনি কি সত্যিই চান- সেই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো তার দিকে উড়ে আসুক? আমি তা মনে করি না।"
ট্রাম্পের এই বক্তব্য দ্রুত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়ে ওঠে। মার্কিনভিত্তিক 'অ্যাক্সিওস'-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্প গত কয়েকদিনে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সাথে দুইবার ফোনালাপ করেছেন এবং দেশটির অস্ত্রের চাহিদা নিয়ে আলোচনা করেছেন। জেলেনস্কিও এক্স সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে লিখেছেন যে, ট্রাম্পের সাথে তার আলোচনা 'অত্যন্ত গঠনমূলক' ছিল এবং উভয়পক্ষই ইউক্রেনের দূরপাল্লার আক্রমণ ও প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়ে একমত হয়েছেন।
টমাহক একটি উন্নত ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, যার পাল্লা ১,৬০০ থেকে ২,৫০০ কিলোমিটার এবং এটি প্রায় ৪৫০ কিলোগ্রাম ওজনের ওয়ারহেড বহন করতে পারে। এটি সেই একই অস্ত্র যা ইরাক ও সিরিয়ার যুদ্ধে সুনির্দিষ্ট টার্গেটে হামলার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যবহার করেছিল। যদি ইউক্রেন এই অস্ত্র পায়, তবে তারা রাশিয়ার অভ্যন্তর — এমনকি মস্কো পর্যন্তও আঘাত হানতে পারবে। রাশিয়ার দৃষ্টিতে এটি 'অগ্রহণযোগ্য' এবং অনেক আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকের মতে, এটি হবে রাশিয়ার কৌশলগত ‘রেড লাইন’ অতিক্রম।
রুশ নিরাপত্তা পরিষদের উপপ্রধান দিমিত্রি মেদভেদেভ সতর্ক করে বলেছেন, " যদি যুক্তরাষ্ট্র এই সিদ্ধান্ত নেয়, এর নেতিবাচক প্রভাব সবার ওপর পড়বে।" তিনি উল্লেখ করেন- আকাশে উড়ে চলা টমাহক ক্ষেপণাস্ত্রের পারমাণবিক ও অ-পরমাণবিক সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য করা অসম্ভব, যা ভয়াবহ ভুল সিদ্ধান্ত ও বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।"
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভও বলেছেন, "এই ক্ষেপণাস্ত্র পাঠানো সরাসরি মার্কিন বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণের প্রয়োজন হবে, যা কার্যত যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলবে।”
রাশিয়ার দৃষ্টিতে, ইউক্রেন যুদ্ধে টমাহকের প্রবেশের অর্থ হলো- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরোক্ষ সমর্থনের নীতি থেকে সরে এসে সরাসরি যুদ্ধরত পক্ষে পরিণত হচ্ছে। পুতিনও আগেই সতর্ক করেছিলেন যে, এমন পদক্ষেপ দুই দেশের সম্পর্ক 'গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত' করবে এবং ওয়াশিংটন ও মস্কোর মধ্যে সাম্প্রতিক আলোচনায় যেকোনো ইতিবাচক গতিবিধি নষ্ট করে দেবে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেই এই বিষয়ে ভিন্নমত রয়েছে। ট্রাম্প একদিকে দেখাতে চান যে. তিনি এখনও সংকট নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন এবং এবং প্রয়োজনে রাশিয়াকে সরাসরি হুমকি দিতেও প্রস্তুত; অন্যদিকে তার নিরাপত্তা উপদেষ্টারা অপ্রত্যাশিত সংঘাতের আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন।
রাশিয়া ও ইউক্রেন বিষয়ে প্রেসিডেন্টের বিশেষ প্রতিনিধি কিট কেলগ বলেছেন, "টমাহক পাঠানো সম্পর্কে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি এবং সবকিছু নির্ভর করছে প্রেসিডেন্টের ওপর।"
সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (সিএসআইএস) এবং লন্ডনের চ্যাথাম হাউসের মতো থিংক ট্যাংক তাদের বিশ্লেষণে উল্লেখ করেছে, ট্রাম্পের লক্ষ্য সম্ভবত সামরিকের চেয়ে বেশি রাজনৈতিক। তিনি এই বিষয়টি উত্থাপন করে আলোচনার পরিবেশ নিজের অনুকূলে পরিবর্তন করতে এবং মস্কোকে একটি প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। কিছু পশ্চিমা বিশ্লেষকের দৃষ্টিতে, এমন হুমকির ঘোষণা 'জবরদস্তিমূলক কূটনীতি' কৌশলের একটি অংশ; অর্থাৎ ভয় সৃষ্টি করে আলোচনায় সুবিধা আদায়।
তবে সামরিক বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, এমন হুমকির পুনরাবৃত্তি নিজেই উত্তেজনা বৃদ্ধির কারণ হয়ে উঠতে পারে। ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের মাইকেল ও'হ্যানলন বলেছেন, “কেবল দূরপাল্লার অস্ত্র নিয়ে আলোচনাও বিপজ্জনক হতে পারে। প্রতিপক্ষ একে আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ হিসেবে ব্যাখ্যা করতে পারে। তখন এক মুহূর্তের ভুল হিসাবই বড় যুদ্ধের সূচনা ঘটাতে পারে।”
ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ব্রাসেলসের কূটনৈতিক সূত্র জানায়, ইউক্রেনের ভূমি থেকে রাশিয়ার গভীরে যেকোনো হামলা ন্যাটোকে সরাসরি সংঘর্ষের দিকে নিয়ে যেতে পারে। ফরাসি ও জার্মান কর্মকর্তারা চান- ওয়াশিংটন যেকোনো সামরিক পদক্ষেপের আগে রাজনৈতিক সমাধানের দিকে ফিরে আসুক।
অবশ্য কিয়েভের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। জেলেনস্কির বিশ্বাস, যদি ইউক্রেন কখনও টমাহক ব্যবহার না করে, তবুও কেবল এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর মালিকানা পুতিনকে হামলা বন্ধ করতে বা বাস্তব আলোচনা শুরু করতে বাধ্য করতে পারে। বস্তুত, তার দৃষ্টিতে, টমাহক যুদ্ধের হাতিয়ার নয়, বরং একটি রাজনৈতিক চাপের হাতিয়ার।
প্রধান প্রশ্ন হলো, টমাহক কি সত্যিই যুদ্ধের সমীকরণ বদলে দিতে পারে? রয়টার্সের সাথে কথা বলতে গিয়ে সামরিক বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন, যদিও এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর উচ্চ নির্ভুলতা এবং ধ্বংসক্ষমতা রয়েছে, তবে সেগুলো ইউক্রেনে মোতায়েন করতে লজিস্টিক এবং নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে এবং রাশিয়া নিঃসন্দেহে তাদের লঞ্চ প্যাড শনাক্ত ও ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে।
তাদের মতে, টমাহক পাঠানোর সিদ্ধান্ত শুধু সামরিক নয়, এটি কৌশলগত ও রাজনৈতিক পদক্ষেপ যা ইউক্রেন যুদ্ধের ভবিষ্যৎ দিক নির্ধারণ করতে পারে— এমনকি বিশ্বশক্তির ভারসাম্যেও পরিবর্তন আনতে পারে।
যদি ওয়াশিংটন সত্যিই এই ক্ষেপণাস্ত্র পাঠায়, তবে মস্কোর পাল্টা প্রতিক্রিয়ার জন্যও প্রস্তুত থাকতে হবে। আর যদি উদ্দেশ্য হয় কেবল রাশিয়াকে আলোচনার টেবিলে ফেরাতে ভয় দেখানো, তবে সেই হুমকি যেন নিজেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায়, সেই সতর্কতাও জরুরি।
আজকের এই ভঙ্গুর বিশ্বে, যেখানে কূটনৈতিক চাপ আর যুদ্ধের সূচনা—দুইয়ের মধ্যবর্তী রেখা খুবই সূক্ষ্ম, সেখানে টমাহক এক নতুন ও বিপজ্জনক পর্বের সূচনা করতে পারে।#
পার্সটুডে/এমএআর/১৪