লাতিন আমেরিকায় উত্তেজনা বাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্র আসলে কী চায়?
https://parstoday.ir/bn/news/world-i153224-লাতিন_আমেরিকায়_উত্তেজনা_বাড়িয়ে_যুক্তরাষ্ট্র_আসলে_কী_চায়
পার্সটুডে: ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, লাতিন আমেরিকায় এমন এক নতুন নীতি গ্রহণ করেছে, যা এই অঞ্চলে রাজনৈতিক ও সামরিক উত্তেজনা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করেছে।
(last modified 2025-10-20T09:08:05+00:00 )
অক্টোবর ২০, ২০২৫ ১৫:০৪ Asia/Dhaka
  • নিকোলাস মাদুরো ও ডোনাল্ড ট্রাম্প
    নিকোলাস মাদুরো ও ডোনাল্ড ট্রাম্প

পার্সটুডে: ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, লাতিন আমেরিকায় এমন এক নতুন নীতি গ্রহণ করেছে, যা এই অঞ্চলে রাজনৈতিক ও সামরিক উত্তেজনা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করেছে।

পার্সটুড জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার ওপর সামরিক চাপ বাড়ানোর পাশাপাশি আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট ‘হাভিয়ের মিলি’ সরকারের জন্য ২০ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তা ঘোষণা করেছেন এবং পানামা খালে চীনের প্রভাব কমাতে সক্রিয়ভাবে পদক্ষেপ নিচ্ছেন। এসব কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য হলো— যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক প্রভাব বজায় রাখা, চীন ও রাশিয়ার মতো প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির মোকাবিলা করা এবং অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাগত স্বার্থ নিশ্চিত করা।

এই নীতির অন্যতম প্রধান দিক হলো- বামপন্থি সরকারগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করা—বিশেষ করে ভেনেজুয়েলার ওপর। দেশটিকে আবারও ‘শক্তি প্রদর্শনের মঞ্চ’ বানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

ট্রাম্প প্রশাসন নিকোলাস মাদুরো সরকারের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং দেশটির উপকূলবর্তী ক্যারিবিয় সাগরে যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছে, যার উদ্দেশ্য সরকারকে দুর্বল করা ও বিরোধীদের সহায়তা দেওয়া।

‘মাদকবিরোধী অভিযান’-এর অজুহাতে ট্রাম্প যুদ্ধজাহাজ, ক্ষেপণাস্ত্র-সজ্জিত ডেস্ট্রয়ার, এফ–৩৫ যুদ্ধবিমান, একটি পারমাণবিক সাবমেরিন এবং প্রায় ৬,৫০০ সেনা পাঠিয়েছেন ভেনেজুয়েলার উপকূলে। মার্কিন হামলায় ক্যারিবিয় সাগরে এখন পর্যন্ত অন্তত ৩২ জন নিহত হয়েছে।

তবে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, লাতিন আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপ সচরাচর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনে না।

অন্যদিকে ট্রাম্প প্রশাসনের প্ররোচনামূলক পদক্ষেপের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও কলম্বিয়ার সম্পর্কও অবনতি ঘটছে।

ট্রাম্প তার কলম্বিয় সমকক্ষ গুস্তাভো পেত্রোকে ‘মাদক ব্যবসায়ী’ বলে আখ্যা দিয়েছেন, আর পেত্রো ট্রাম্পকে বলেছেন ‘অভদ্র ও অহংকারী

ট্রাম্প তার সামাজিক মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যাল–এ পেত্রোকে ‘অত্যন্ত অজনপ্রিয় রাজনীতিক’ বলে বর্ণনা করেছেন, যিনি ‘মাদক উৎপাদনকে উৎসাহ দিচ্ছেন’। তিনি ঘোষণা দেন—‘আজ থেকেই কলম্বিয়ার প্রতি সব ধরনের আর্থিক সহায়তা বন্ধ।‘

এর জবাবে কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট লিখেছেন—“আমি কোনো ব্যবসায়ী নই, মাদক ব্যবসায়ী তো নয়ই। ট্রাম্প আমাদের দেশের প্রতি উদ্ধত আচরণ করেছেন এবং তার উপদেষ্টারা তাকে বিভ্রান্ত করেছে।”

এর আগে যুক্তরাষ্ট্র কলম্বিয়াকে ‘মাদকবিরোধী যুদ্ধে সহযোগিতা না করা দেশ’-এর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে— এটি গত ৩০ বছরে প্রথম এমন পদক্ষেপ। এর জেরে কলম্বিয়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র কেনা বন্ধ ঘোষণা করেছে।

একই সময়ে ট্রাম্প প্রশাসন পানামা খাল–সংলগ্ন বন্দর ও বাণিজ্যিক রুটে চীনা কোম্পানির উপস্থিতি বন্ধে নতুন এক চুক্তি বিবেচনা করছে।

এই পদক্ষেপে চীনের প্রভাব কিছুটা সীমিত হলেও বিশেষজ্ঞদের মতে, বেইজিং তখন বিনিয়োগের দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেবে ইকুয়েডর, পেরু কিংবা চিলির মতো দেশগুলোর দিকে।

এর ফলে পশ্চিম গোলার্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে এক নতুন ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে— যা তাইওয়ান ইস্যু ও বাণিজ্যযুদ্ধের সঙ্গে মিলিত হয়ে নতুন এক শীতল যুদ্ধের রূপ নিতে পারে।

লাতিন আমেরিকা তার কৌশলগত অবস্থান, প্রাকৃতিক সম্পদ ও ভৌগোলিক নৈকট্যের কারণে সবসময়ই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির অগ্রাধিকারভুক্ত অঞ্চল ছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের অবকাঠামোগত বিনিয়োগ ও প্রভাব বৃদ্ধির ফলে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে এই প্রবণতা ঠেকাতে সচেষ্ট।

নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে যুক্তরাষ্ট্র আশঙ্কা করছে— লাতিন আমেরিকা হয়তো চীনের সামরিক ও গোয়েন্দা প্রভাবের ঘাঁটিতে পরিণত হতে পারে। তাই দেশটি এখানে সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়ে এবং নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষর করে নিজের নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী করতে চায়।

এদিকে ট্রাম্প সরকার আর্জেন্টিনার দক্ষিণপন্থি প্রেসিডেন্ট ‘হাভিয়ের মিলি’র সরকারকে ২০ বিলিয়ন ডলারের ঋণ দিয়েছে— যা সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোর সবচেয়ে আলোচিত সিদ্ধান্তগুলোর একটি।

এই সহায়তা কেবল অর্থনৈতিক নয়; বরং যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত লক্ষ্য হলো অঞ্চলে ওয়াশিংটন–সমর্থিত দক্ষিণপন্থি সরকারগুলোর একটি জোট গড়ে তোলা, যা চীন–রাশিয়ার প্রভাবের ভারসাম্য রক্ষা করবে।

বিশ্লেষকদের মতে, এটি ট্রাম্পের একটি রাজনৈতিক চাল— যার উদ্দেশ্য লাতিন আমেরিকায় ‘জনপ্রিয়তাবাদী দক্ষিণপন্থিদের একত্রীকরণ’ এবং মতাদর্শগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সখ্য দৃঢ় করা।

দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্পের লাতিন আমেরিকা নীতিকে সংক্ষেপে বলা যায়—সামরিক চাপ, অর্থনৈতিক প্রভাব, ও মতাদর্শগত জোটের মিশ্রণ। এই কৌশল ঠান্ডা যুদ্ধ–যুগের ভূরাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার পুনরাবৃত্তি মনে করিয়ে দেয়, তবে এবার তা ‘গানবোট ডিপ্লোমেসি’র প্রকাশ্য রূপে ফিরে এসেছে।

এখন আর গণতন্ত্র কোনো লক্ষ্য নয়, বরং মার্কিন স্বার্থ রক্ষার হাতিয়ার মাত্র। সব মিলিয়ে, যুক্তরাষ্ট্রের লাতিন আমেরিকা নীতির লক্ষ্য হলো— নিজস্ব আঞ্চলিক আধিপত্য বজায় রাখা,ভেনেজুয়েলা’র মতো অসহযোগী সরকারকে উৎখাত করা,চীন ও রাশিয়ার প্রভাব বিস্তার ঠেকানো,মিত্র সরকারগুলোকে শক্তিশালী করা এবং দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাগত স্বার্থ সুরক্ষা করা।

এই সব পদক্ষেপ বাহ্যত গণতন্ত্র ও উন্নয়নের নামে হলেও, বাস্তবে এগুলো ওয়াশিংটনের ঐতিহ্যগত ‘মনরো মতবাদেরই পুনর্জাগরণ, যার উদ্দেশ্য লাতিন আমেরিকাকে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন ‘নিজস্ব উঠোন’ হিসেবে ধরে রাখা।#

পার্সটুডে/এমএআর/২০