নভেম্বর ২৪, ২০২০ ২১:২২ Asia/Dhaka
  • আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যার ছবি
    আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যার ছবি

ড. সোহেল আহম্মেদ: ক'দিন আগে আমাদের অফিসের মসজিদের পাশ দিয়ে হাঁটছিলাম। হঠাৎ নেমপ্লেটের দিকে তাকিয়ে হজরত বিলাল (রা.)’র কথা মনে পড়ল। হজরত বিলাল মসজিদটি আমাদের ওয়ার্ল্ড সার্ভিস ভবনের পাশেই। ওই পথ দিয়ে যাতায়াত নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হলেও হজরত বিলাল (রা.) যে আফ্রিকান বংশোদ্ভূত কৃষ্ণাঙ্গ সাহাবি তা কখনো গভীরভাবে বিবেচনায় নেইনি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কোকোয়া শহরে পুলিশের গুলিতে আরও দুই কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ এ.জে. ক্রুমস ও সিনসিয়ার পিয়ের্সের মৃত্যুর খবরটি জানার পরপরই সে পথ দিয়ে যাওয়ার কারণে হয়তো সেদিন হজরত বিলাল (রা.)-কে আলাদাকে অনুভব করেছি। এরপরই হজরত বিলাল (রা.) সম্পর্কে আরও বেশি জানার চেষ্টা করি। তাঁকে নিয়ে নতুন একটি তথ্য পেলাম যা আমি আগে কখনো শুনিনি।

ফার্সি ভাষার আধ্যাত্মিক কবি মাওলানা রুমীর এক কবিতায় হজরত বিলাল (রা.) সম্পর্কে কিছু চমৎকার তথ্য এসেছে। মহনবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) যে তাঁকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন সে বিষয়টিও ফুটে উঠেছে রুমীর মনসবীতে। ঘটনাটি এরকম- হজরত বিলাল (রা.) 'হাই' শব্দটি আরবদের মতো করে উচ্চারণ করতে পারতেন না। আজানের সময় 'হাইয়্যালা' শব্দটি বলতে গেলেই বুঝা যেত উচ্চারণে কিছুটা সমস্যা রয়ে গেছে। এ কারণে হজরত বিলালের আজানের বিষয়ে কয়েক জন সাহাবি মহানবীর কাছে গিয়ে অভিযোগ করে বললেন, হে রাসূলে খোদা (সা.) আপনি ইসলামের সূচনালগ্নেই বিলালকে মুয়াজ্জিনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছেন, কিন্তু তার উচ্চারণে সমস্যা রয়েছে। সে 'হাই' শব্দটি সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে পারে না। তারা হজরত বিলালকে এই দায়িত্ব থেকে সরানোর বিনীত অনুরোধ জানালেন।

মাওলানা রুমী তার কবিতায় লিখেছেন, হজরত বিলালের বিষয়ে এ ধরণের কথা শুনে রাসূল (সা.) খুবই ক্ষুব্ধ হন। মহানবী তাদেরকে বলেন, আপনারা কি জানেন আল্লাহর কাছে বিলালের মর্যাদা কত উপরে? আপনারা কি চান আমি আপনাদের অন্তরের খবর প্রকাশ করে দেই? আপনারা কি অপমানিত হতে চান? এমন প্রতিক্রিয়ায় সবাই বুঝতে পারেন রাসূলে খোদা এই কৃষ্ণাঙ্গ মুসলমানকে কতটা ভালোবাসেন! কিছু দিন আগেও যিনি দাস ছিলেন তিনি এখন কতটা মর্যাদাবান! এরপর মহানবীর নির্দেশে হজরত বিলাল (রা.) আজান দেওয়া অব্যাহত রাখেন।

ইসলামের প্রাথমিক যুগে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, হজরত বিলাল (রা.) তাদেরই একজন। ইসলাম-বিরোধীদের অসহনীয় নির্যাতনের শিকার হওয়ার পরও তিনি সত্যের পথ থেকে সরে দাঁড়াননি। বেহেশতে হজরত বিলাল (রা.)’র জুতার আওয়াজ শোনার হাদিসটিও পেলাম ফার্সি মাধ্যমে। ফার্সি মাধ্যমে হাদিসটি এসেছে এভাবে- মেরাজ বা ঊর্ধ্বাকাশে গমন করার পর বেহেশতে জুতা পায়ে হজরত বেলাল (রা.)’র হেটে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেলেন মহানবী (সা.)। তিনি এই শব্দ শুনে ফেরেশতা জিবরাইলকে প্রশ্ন করলেন, এটা কি বিলালের পায়ের শব্দ? জিবরাইল বললেন-হে রাসূলে খোদা আপনি ঠিকই শুনেছেন। বেহেশতে বিলালের জুতার শব্দই শুনতে পেয়েছেন আপনি। মেরাজের ঘটনার পর রাসূল (সা.) হজরত বিলালকে কাছে ডেকে নিয়ে জান্নাতের সুসংবাদ দেন। বিভিন্ন মাজহাবের এ সংক্রান্ত বর্ণনায় সামান্য পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু মূল ঘটনা সব মাজহাবেই স্বীকৃত। হজরত বিলাল (রা.) ঈমানের পরীক্ষায় এতটাই উচ্চতর অবস্থানে পৌঁছেছিলেন যে, আল্লাহতায়ালা রাসূল (সা.)-কে ঊর্ধ্বাকাশে নিয়ে তার এই মহান উম্মতের বেহেশতে অবস্থানের শব্দ শুনিয়েছিলেন। পরকালে বিশ্বাসী যেকোনো মানুষের জন্য জান্নাতের সুসংবাদের চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কিছু হতে পারে না।

লেখার শুরুতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় যে দুই কৃষ্ণাঙ্গ তরুণকে হত্যার প্রসঙ্গ টেনেছিলাম তা নিয়ে তদন্ত চলছে। বিচার কী হবে জানিনা। তবে চরম বাস্তবতা হচ্ছে দুই তরুণকে আর ফিরে পাবে না তাদের পরিবার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গত কয়েক মাসে জর্জ ফ্লয়েডসহ বেশ কয়েক জন কৃষ্ণাঙ্গকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। সাম্প্রতিক নানা ঘটনা থেকে এটা স্পষ্ট, শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনও বেরিয়ে আসতে পারেনি। ভোটাধিকার পেলেও মার্কিন নির্বাচন কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে এখনও ইতস্তত করেন অনেক কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন নাগরিক। এবারের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থীর পক্ষে পোস্টাল ব্যালটের পাল্লা বেশি হওয়ার একটি কারণ হলো, কৃষ্ণাঙ্গদের অনেকেই ট্রাম্পের বর্ণবাদী আচরণের বিরুদ্ধে পোস্টের মাধ্যমে বাইডেনকে ভোট দিয়েছেন। কেন্দ্রে এসে নানা কটু কথা বা বিড়ম্বনা সহ্য করতে হতে পারে এই আশঙ্কায় এই পথকেই নিরাপদ মনে করেছেন তারা।

কলম্বাস যাদেরকে রেড ইন্ডিয়ান বলে নামকরণ করেছিলেন সেই আদিবাসীদের একটা বড় অংশকে নিশ্চিহ্ন করার পর ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গরা নিজেদের বিলাসী জীবন নিশ্চিত করতে একদল সেবকের প্রয়োজন বোধ করে। তারা আফ্রিকা মহাদেশে গিয়ে মানুষ ধরে আনতে শুরু করে। এভাবেই আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের আগমন। তারা স্বেচ্ছায় আমেরিকায় আসেননি, তাদেরকে জোর করে ধরে আনা হয়েছে। কিন্তু আজও তাদেরকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে মর্যাদা দিতে প্রস্তুত নন শ্বেতাঙ্গরা।

১৮৬৩ সালে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের মাধ্যমে কৃষ্ণাঙ্গরা মুক্তির আইনি স্বীকৃতি পেলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্বেতাঙ্গরা এখনও তাদেরকে মেনে নিতে পারেনি। দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করার দুই বছর পর আব্রাহাম লিঙ্কনকে হত্যা করা হয়। দাসপ্রথা নিষিদ্ধের একশ' বছর পরও অধিকার বাস্তবায়ন না হওয়ায় ১৯৬০'র দশকে কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আন্দোলন আবারও জোরদার হয়। আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে থাকেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র। বেশি দূর এগোতে পারেননি। ১৯৬৮ সালে উগ্রপন্থী শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীরা তাকেও গুলি করে হত্যা করে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত কৃষ্ণাঙ্গ লেখক অ্যালেক্স হেলি আমেরিকায় তার নিজের প্রথম পূর্বপুরুষের অনুসন্ধানে নেমে কৃষ্ণাঙ্গদের জোর করে ধরে নিয়ে আসার প্রামাণ্য চিত্র তুলে ধরেছেন তার লেখা ‘রুট্‌স: দ্য সাগা অফ এন অ্যামেরিকান ফ্যামিলি’ বইয়ে। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন তার পূর্বপুরুষেরা ছিল মুসলমান। কিন্তু এই লেখক ছিলেন খ্রিষ্টান। এ থেকে বুঝা যায় কৃষ্ণাঙ্গদের ধরে আমেরিকায় নিয়ে আসার পর তাদেরকে নিজের ধর্মটুকুও রক্ষা করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। বেশিরভাগ কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ খ্রিষ্টান সমাজের সঙ্গে পুরোপুরি মিশে যাওয়ার পরও হত্যা-নির্যাতন ও বৈষম্য থেকে মুক্তি পায়নি। 

কিন্তু বর্তমানে ইউরোপ ও আমেরিকায় যে ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত অপপ্রচার চলছে সেই ধর্মে বর্ণবাদের কোনো স্থান নেই। সাদা-কালোতে ভেদাভেদ নেই। মানুষের চিন্তা-বিশ্বাস ও আচরণই এই ধর্মে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম ধর্ম বাহ্যিক রূপ দেখে কাউকে বিবেচনা করতে নিষেধ করেছে।

এই জগতের মাপকাঠিতে যাদের জন্মগত অর্জন কম তাদের হিসাব-নিকাশ হয়তো সহজ হবে। অনন্তকালীন জীবনের সাফল্য অর্জনে তারাই হয়তো এগিয়ে থাকবে। আমাদের সমাজেও রঙ নিয়ে বড়াই কম হয় না। মুসলিম-অমুসলিম উভয় শ্রেণীর মানুষের মধ্যেই এমন বড়াই ও অহংকার লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু এটা অনুচিত। জন্মসূত্রে পাওয়া কোনো কিছু নিয়েই বড়াই করার অধিকার কারো নেই। একইভাবে জন্মসূত্রে পাওয়া কোনো দুর্বলতার কারণেও আফসোস করা ঠিক নয়। জন্মের সময় যে যতটুকু নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে তার পরীক্ষার মূল্যায়ন হবে সেটুকুর ভিত্তিতেই। মনে রাখতে হবে আমরা সবাই এখন ইহজগৎ নামের পরীক্ষার হলে। প্রতি মুহূর্তেই চলছে পরীক্ষা।#

লেখক: রেডিও তেহরানের সিনিয়র সাংবাদিক।

[email protected]

ট্যাগ