মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে ২৩ চা বাগানে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি
দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আগামীকাল (শনিবার) থেকে দেশের সকল চা বাগানে অনির্দিষ্টকালের জন্য কাজ বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন। সেই সঙ্গে নিজ নিজ বাগান এলাকার শহর ও বাজারে অবস্থান নিয়ে কঠোর আন্দোলন করতেও শ্রমিক ও নেতৃবৃন্দদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সংগঠনটির পক্ষ থেকে।
আজ (শুক্রবার) সকালে ৪র্থ দিনের মতো দুই ঘণ্টা চা শ্রমিকরা কর্মবিরতি পালন করেও মজুরি বৃদ্ধির কোন সিদ্ধান্ত না পেয়ে এ কর্মসূচি গ্রহণ করে চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটি।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নির্বাহী উপদেষ্টা রামভজন কৈরী বলেন, মজুরি বোর্ডের কাছে তাদের প্রস্তাব হলো দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকা করতে হবে। শুক্রবার পর্যন্ত দ্বিপাক্ষিক শ্রমচুক্তি বিলম্বিত হবার প্রতিবাদে ২ ঘণ্টার কর্মবিরতির পরও কোন সমাধান আসেনি। তাই শনিবার থেকে দেশের সকল চা বাগান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
চা শ্রমিকদের দাবির বিষয়ে বাংলাদেশীয় চা সংসদের চেয়ারম্যান মো. শাহ আলম সাংবাদিকদের জানান, আমাদের ক্যাপাসিটি অনুযায়ী, মজুরি ১৪ টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছিলাম। অনেক বাগান লসে আছে। চায়ের বাজার ভালো নয়। এখন জ্বালানি তেলের দামও বেড়ে গেছে। শ্রমিকদের রেশনের আটা দেওয়া হয়। প্রতি কেজি গমের দাম ১৪ টাকা থেকে বেড়ে ২৮ টাকা হয়েছে।
আজ (শুক্রবার) সকালে সারা দেশের ন্যায় মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে চা শ্রমিক ইউনিয়নের মনু-দলই ভ্যালির অন্তর্গত ২৩টি চা-বাগানে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেন চা শ্রমিকরা। এ সময় মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে তারা বিভিন্ন স্লোগানও দেন।
চা শ্রমিক ইউনিয়নের মনু-দইল ভ্যালি কমিটির সভাপতি ধনা বাউরী জানান, তাদের আওতাধীন কমলগঞ্জের ২২টি ও কুলাউড়ার ১টি চা বাগানে কর্মবিরতি পালিত হয়েছে। সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শনিবার থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সকল চা বাগানের শ্রমিকরা কাজ বন্ধ রেখে আন্দোলন করবে। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম দিন দিন বেড়েই চলেছে। বেড়েছে অন্যান্য খরচও। কিন্তু চা শ্রমিকদের মজুরি বাড়েনি।
শ্রমিকদের সূত্রে জানা গেছে, চা শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে চা-বাগানের মালিকপক্ষের সংগঠন বাংলাদেশীয় চা-সংসদের করা চুক্তি অনুযায়ী, চা শ্রমিকদের মজুরিসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নির্ধারণ হয়। প্রতি দুই বছর পর পর এ চুক্তি সম্পাদনের কথা। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি দ্বি-পাক্ষিক চুক্তি সম্পাদন হয়। ওই চুক্তিতে শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে আর নতুন করে চুক্তি হয়নি। সম্প্রতি চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে বাংলাদেশীয় চা-সংসদ মজুরি ১৪ টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব দেয়। কিন্তু, নেতারা এ প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। শ্রমিকদের মজুরি ৩০০ টাকা নির্ধারণসহ অন্যান্য দাবি-দাওয়া পূরণের বিষয়ে ১ আগস্ট চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে বাংলাদেশীয় চা-সংসদের কাছে চিঠি দেওয়া হয়। চিঠিতে দাবি মেনে নিতে ৭ দিনের সময়সূচি বেঁধে দেওয়া হলেও এ সময়ের মধ্যে দাবি না মানায় সংগঠনের পক্ষ থেকে কর্মবিরতির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মঙ্গলবার থেকে আজ শুক্রবার পর্যন্ত দেশের সকল চা বাগানে প্রতিদিন দুই ঘণ্টা করে কর্মবিরতি চলছিল।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ হচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ চা উৎপাদনকারী দেশ। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৮৪০ সালে চট্টগ্রামে চা ব্যবসা শুরু করে। বর্তমানে, বাংলাদেশে ১৬৭টি বাণিজ্যিক চা এস্টেট রয়েছে, যার মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় উৎপাদনক্ষম চা বাগান। এখানকার এই শিল্প বিশ্বের ৩% চা উৎপাদন করে থাকে, এবং ৪০ লক্ষ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছ। যার ৭৫% নারী।] অনেক শ্রমিকই উপজাতি বাসিন্দা যাদের ব্রিটিশ শাসনামলে মধ্য ভারত থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল।
চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালিনীছড়া চা-বাগানের মাধ্যমে প্রথম বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চা চাষ শুরু হয়। বর্তমানে চা বোর্ডের নিবন্ধিত ১৬৬টি চা–বাগান রয়েছে। এর মধ্যে মৌলভীবাজারে ৯১টি, হবিগঞ্জে ২৫টি, সিলেটে ১৯টি, চট্টগ্রামে ২২ টি, পঞ্চগড়ে ৭টি, রাঙামাটিতে ২টি ও ঠাকুরগাঁওয়ে ১টি চা–বাগান রয়েছে। এসব বাগানে মোট জমির পরিমাণ ২ লাখ ৭৯ হাজার ৪৩৯ একর।
লন্ডনভিত্তিক ‘ইন্টারন্যাশনাল টি কমিটি’ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, চা উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে নবম। একটানা কয়েক বছর ধরেই দশম অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। গত শতাব্দীর শেষে চা উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১তম, ১৯৮৯ সালে ছিল ১২তম।
সংস্থাটির হিসাবে চা উৎপাদনে এখন শীর্ষে রয়েছে চীন। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ভারত। উৎপাদনে বাংলাদেশের ওপরে রয়েছে কেনিয়া, শ্রীলঙ্কা, তুরস্ক, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও আর্জেন্টিনা। বাংলাদেশের নিচে আছে জাপান, উগান্ডা, নেপাল, ইরান, মিয়ানমারের মতো দেশগুলো।
২০১৬ সালে চা চাষে পুরোপুরি অনুকূল আবহাওয়ার মধ্যে রেকর্ড হয়েছিল। সে বছর সাড়ে ৮ কোটি কেজি চা উৎপাদন হয়। গড়ে বছরে চা উৎপাদন হয় ৮ কোটি কেজি।#
পার্সটুডে/আবদুর রহমান খান/আশরাফুর রহমান/১২
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।