রমজান: আত্মশুদ্ধির মহোৎসব (পর্ব-১১)
মাহে রমজানে গঠন করো তাক্বওয়াপূর্ণ জীবন, যে যেমন পার পাক-সাফ করো আপন দেহ ও মন। এই রমজানে আত্মার সাথে আত্মার হোক মিলন, ধনী-দরিদ্র অসহায় সবার সমান দিবস-যাপন।
মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে এবং মহানবীর আহলে বাইতকে (আ.) ভালভাবে না চেনাসহ নানা ধরনের অজ্ঞতার কারণে আমরা নানা পাপে জড়িত হচ্ছি। মহান ধর্মীয় নেতারা এ জন্যই সব পাপ এড়াতে একটি দোয়া খুব গুরুত্ব দিয়ে পাঠ করতেন। ওই দোয়ায় বলা হয়:
‘হে আল্লাহ! আপনিই আমাকে সুযোগ দিন আপনাকে চেনার। কারণ, আপনি যদি আপনার পরিচয় আমার কাছে না তুলে ধরেন তাহলে আপনার রাসুল বা প্রেরিত পুরুষকে চিনতে পারব না। হে আল্লাহ! আপনার রাসুলকে আমাদের কাছে পরিচিত করুন, যদি আপনি তা না করেন তাহলে আপনার নবীর প্রতিনিধি বা ইমামকে চিনতে পারব না। হে আল্লাহ! আপনার রাসুলের প্রতিনিধিকে চিনিয়ে দিন, কারণ আপনার রাসুলের প্রতিনিধিকে চিনতে না পারলে আমরা বিভ্রান্ত হয়ে যাব।’
আল্লাহতা’আলা সুরা আল-বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াতে পরিষ্কার বলে দিয়েছেন রমযানে একমাস ধরে রোযা থাকার উদ্দেশ্যই হোল বান্দাহ এর মাধ্যমে ‘তাকওয়া’ অর্জন করবে। এতে বোঝাই যাচ্ছে আল্লাহতা’আলার কাছে বান্দাহর ‘তাকওয়াই’ হচ্ছে সবচেয়ে মূল্যবান। তাকওয়া তথা খোদা-ভীতি ও খোদা-সচেতনতা বলতে কি বোঝায়?
১) তাকওয়া হচ্ছে প্রথমত আল্লাহতা’আলার কথা অন্তরে সবসময় ভক্তি ও ভালবাসার সাথে স্মরণ রাখা ও তাঁকে ঠিক যেমন ভয় করা দরকার ঠিক তেমন মাত্রায় ভয় করা। সাথে সাথে তাঁর বড়ত্ব, মহত্ত, ক্ষমতা, জ্ঞান ও কর্মকুশলতা অন্তরে অনুভব করা।
২) তাকওয়া হচ্ছে আল্লাহতা’আলার সন্তুষ্টি অর্জন করাকেই জীবনের সবচেয়ে বড় বা পরম লক্ষ্য হিসেবে গণ্য করা। সবসময় সেই মহান রবের তথা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য চেষ্টা করা এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের বড়ো বা ছোট কোন সুযোগই হাতছাড়া না করা।
৩) তাকওয়া হচ্ছে আল্লাহতা’আলার অসন্তুষ্টিকে জীবনে সবচেয়ে বেশি ভয় করা এবং এ ব্যপারে সবসময় সন্ত্রস্ত থাকা।
৪) তাকওয়া নেক আমল বা অভ্যাসকে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও মধুর করে তোলে। কোন নেক আমলের সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেলে অন্তরে খুব লজ্জা ও ব্যথা লাগে।
৫) তাকওয়া বদ আমল বা অভ্যাসকে মনের মধ্যে একান্ত কুৎসিত ও ঘৃণিত রূপে হাজির করে। অসাবধানতা বশত বা অন্য কোন কারণে কোন ভুল বা অন্যায় হয়ে গেলে বুঝতে পারার সাথে সাথে তাকওয়া আন্তরিক তওবা করতে বাধ্য করে এবং এমন ভুল যেন আর না হয় সে জন্য নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করতে উদ্বুদ্ধ করে।
৬) তাকওয়া ইমানদারকে খুব সতর্ক হয়ে জীবনের এই কণ্টকাকীর্ণ ও পিচ্ছিল পথে চলতে শেখায় এবং এভাবে চলা স্বভাবে পরিণত করে।
৭) তাকওয়া ইমানদারের অন্তরের চক্ষুকে খুলে দেয় এবং তার সামনে সত্য ও মিথ্যাকে একেবারে স্পষ্ট করে তুলে এই দুনিয়া ও জীবনের প্রকৃত স্বরূপকে চিনিয়ে দেয়।
'তাকওয়া' একটা বিশাল ও শক্তিশালী গাছের মতো। এর শিকড় বান্দাহর অন্তরে। এই শিকড় থেকে প্রাণ রসে সিঞ্চিত হয়ে তা জীবনের গাছে পরিণত হয় এবং চারিদিকে বিস্তৃত হয়। এর কাণ্ড হয়, ডালপালা গজায়, পাতা হয়, ফুল হয়, ফল হয়, ক্লান্ত পথিককে শীতল ছায়া দেয় ও পাখিরা বাসা বাধে এসে এতে।
অন্তরের এই পরম সম্পদ তাকওয়াবানের জীবনের সবকিছুকেই প্রভাবিত করে এবং তার জীবনের সবকিছুতেই প্রতিফলিত হয়। সে এক শান্তি ও মাধুর্য-মণ্ডিত জীবন লাভ করে। তাকওয়াবান যেভাবে আল্লাহতা'আলার বড়ত্ব, মহত্ব ও মর্যাদা অন্তরে উপলব্ধি করে তাঁকে জীবনের প্রতি মুহূর্তে স্মরণ রাখে, যেভাবে জীবনের সবকিছুতেই তাঁর সন্তুষ্টি হাসিল করতে তৎপর থাকে, যেভাবে তাঁকে ভয় করে তাঁর অসন্তুষ্টি থেকে নিজেকে হিফাজাত করার প্রাণপণ চেষ্টা করে তাতে তাকওয়াবানের সমস্ত জীবনটাই ইবাদাত হয়ে উঠে। একজন ইমানদারের জন্য এর চেয়ে সৌভাগ্যের আর কী হতে পারে?
ইসলামের দুটি জিনিষ দেয় ইমানদারকে। দেয় পথের দিশা ও সেই পথে চলার একান্ত প্রয়োজনীয় পাথেয়। 'তাকওয়া' হচ্ছে সেই পাথেয়। আল্লাহতা’আলা যেন এই রমযানকে আমাদের সবার জন্য জীবন পথের একমাত্র মূল্যবান পাথেয় ‘তাকওয়া’ হাসিলের মাধ্যম করে দেন।
একজন খোদা-সচেতন ও খোদাভীরু মানুষের দৃষ্টান্ত হচ্ছে তার মত যিনি পথ চলার সময় এত সতর্ক থাকেন যে কেউ যেন তাকে ভুল পথে নিয়ে যেতে না পারে এবং পথের নানা বাধা যেমন, গর্ত, ময়লা বা নোংরা পানি, কাঁটা বা শরীরের জন্য যে কোনো ক্ষতিকর সব কিছু তিনি এড়িয়ে চলেন। তাকওয়াবান মানুষ বস্তুগত বা পার্থিব, আধ্যাত্মিক, নৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত সব বিষয়ে হালাল ও হারাম বিষয়গুলো মেনে চলেন।

পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/ ১১
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।