এপ্রিল ১৫, ২০২২ ১৫:১৮ Asia/Dhaka

রক্তের ক্যান্সার লিম্ফোমা কি? আসুন জেনে নেই। শ্রোতা/পাঠকবন্ধুরা! রেডিও তেহরানের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ক সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান 'স্বাস্থ্য কথার' আসরে স্বাগত জানাচ্ছি আমি গাজী আবদুর রশীদ। আশা করছি আপনারা সবাই ভালো ও সুস্থ আছেন।

ক্যান্সার বর্তমান বিশ্বে একটি ভয়াবহ  রোগ। বহু রকমের ক্যান্সার রয়েছে। প্রত্যেক ক্যান্সারই আলাদা আলাদা এবং চিকিৎসা পদ্ধতিও আলাদা। এ রোগে মৃত্যু হারও অনেক বেশি।

ক্যান্সার নিয়ে ধারাবাহিকভাবে কয়েক পর্বের আলোচনার তৃতীয় পর্বে আজও আমাদের সঙ্গে অতিথি হিসেবে আছেন রক্ত ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডা. মো. কামরুল হাসান। তিনি মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।

জনাব, ডা. মো. কামরুল হাসান, রেডিও তেহরানে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।

ডা.কামরুল হাসান: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।

রেডিও তেহরান: ডা.কামরুল হাসান, দ্বিতীয় পর্বের আলোচনার শেষ দিকে আপনি ব্লাড ক্যান্সারের লক্ষণ নিয়ে কথা বলছিলেন। তো আর কি কি লক্ষণ দেখা যায়?

ব্লাড ক্যান্সার লিম্ফোমা

ডা.কামরুল হাসান: ব্লাড ক্যান্সারের অনেক লক্ষণের কথা গতপর্বে আলোচনা করেছি। আজ শুরুতে রক্তের ক্যান্সার লিম্ফোমা নিয়ে কথা বলব। লিম্ফোমায় আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে যে লক্ষণগুলো দেখা দেয় তা হচ্ছে,বুকে গোল গোল ছোট টিউমারের মতো দেখা যায়। চামড়ার নিচে হাত দিয়ে বোঝা যায় এটি। ঘাড়, কুচকি বা বগলের লসিকা গ্রন্থি ফুলে যাওয়া। অতিরিক্ত ক্লান্তি। অনিয়মিত ও বারবার জ্বর হওয়া। রাতে ঘাম হওয়া।

শ্রোতা/পাঠকবন্ধুরা! বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক গতপর্বে লিম্ফোমা কি তা আলোচনা করেছিলেন। আপনাদের বোঝার সুবিদার জন্য এখানে তা তুলে ধরছি।

লিম্ফোমা হলো রক্তের বিশেষ এক প্রকারের ক্যান্সার যা মূলত লিম্ফনোড বা লসিকা গ্রন্থিগুলোকে আক্রান্ত করে। রক্তের প্রধান উপাদান দুটি। রক্তরস ও রক্তকোষ। রক্তের বিভিন্ন কোষীয় উপাদানের একটি হলো লিম্ফোসাইট, যা মূলত এক প্রকার শ্বেতরক্তকণিকা।

এর প্রধান কাজ হচ্ছে রোগ প্রতিরোধ করা। বিভিন্ন কারণে এই লিম্ফোসাইটের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হলে দেখা দেয় লিম্ফোমা নামক ক্যান্সার। লিম্ফোসাইট যেসব অঙ্গে তৈরি ও বৃদ্ধি হয় এসব অঙ্গের মধ্যে রয়েছে লিম্ফনোড, স্প্লিন (প্লিহা), টনসিল ইত্যাদি। লিম্ফনোড শরীরের বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে। সুস্থ অবস্থায় এদের তেমন বোঝা যায় না। কিন্তু কোনো কারণে আকার বড় হলে তা বোঝা যায়। শরীরের বিভিন্ন অংশে লিম্ফনোডগুলো ছড়িয়ে আছে। তবে গলার দুই দিকে, ফুসফুসের দুই পাশে ও পেটের অভ্যন্তরে এর উপস্থিতি বেশি বোঝা যায়।

লক্ষণের যে কথা বলছিলেন তা হলো, শরীরের কোনো এলাকায় লিম্ফনোড বা অন্য কোনো লিম্ফেটিক অঙ্গ অস্বাভাবিক বড় হতে থাকে। ফুলে যাওয়া লিম্ফনোডগুলো রাবারের মতো নরম ও ব্যথাহীন হয়। এর সঙ্গে দীর্ঘদিনের জ্বর, ওজন কমে যাওয়া ও রাতের বেলায় প্রচুর ঘাম হয়। লিম্ফোমার জ্বর হয় সাধারণত অনিয়মিত ধরনের। মানে আসে আবার চলে যায়। জ্বরের মাত্রা কখনো খুব বেশি হয়, কখনো সামান্য। এই লক্ষণগুলোর অধিকাংশই যক্ষ্মার সঙ্গে মিলে যায় যা বিশেষ পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হতে হয়।

প্রকার : মূলত দুই প্রকার। হজকিনস লিম্ফোমা ও নন হজকিনস লিম্ফোমা। এর মধ্যেও অনেক সুক্ষ্ম রকমফের আছে। এদের চিকিৎসাও পার্থক্য আছ। আর অন্যান্য ক্যান্সারের মতো লিম্ফোমার কারণও নানাবিধ। অনেকটাই অজ্ঞাত। তবে কিছু কিছু কারণ জানা যায়।

আর আগেও বলেছিলাম দ্রুত বর্ধনশীল বা দ্রুত অবনতিশীল লিউকোমিয়ার কথা যদি বলা হয় হয়, তাহলে দেখা একেবারে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আক্রান্ত রোগীর শারিরীক অবস্থার অবনতি হয়। দেখা গেল দুসপ্তাহ আগে ভালো ছিল। হঠাৎ করে দুর্বল হয়ে গেছেন, তার শরীরে জ্বর আসছে। তো এই যে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে রোগী এরমানে হলো শরীরে রক্তশূন্যতা। আরো সিমটম হিসেবে দেখা যায় কোনো কোনো রোগীর দাঁতের গোড়া দিয়ে রক্ত আসছে। কারও কারও পায়খানার সাথে বা মলদ্বারের সাথে রক্ত পড়ে। তো আসলে রক্তশূন্যতার কারণে ঐসব লক্ষণগুলো দেখা দেয়। জ্বর, রক্তক্ষরণ, দুর্বলতা এবং চামড়ায় ছোট ছোট মশার কামড়ের মতো দাগ দেখা যেতে পারে।

আমি আগেও বলেছি শ্বেতকণিকার যে ক্যান্সার সেটি ভয়াবহ, এটি শরীরের জন্য একটি বোঝা। ঐ রোগী তার স্বাভাবিক কাজ কর্ম করতে পারেন না। স্বাভাবিক শ্বেতকণিকার যে সংখ্যা তা কমে যায় একইসাথে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমতে থাকে। এরফলে আবার কি হতে পারে- রোগীর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ইনফেকশন হতে পারে। যেমন রোগীর ফুসফুসে জীবাণু আক্রমণ করতে পারে। তার কাশি হবে, শ্বাসকষ্ট হবে। আবার অনেকের দেখা যায় কিডনিতে সংক্রমণ হয়ে যায়। সবচেয়ে বেশি যে লক্ষণ থাকে সেটি হচ্ছে- জ্বর এবং রক্তে ইনফেকশন। আর এ অবস্থায় কোনো ওষুধে কাজ হয় না। এ অবস্থায় আমরা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বুঝতে পারি এই রোগীর ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে।

রেডিও তেহরান: ডা.কামরুল হাসান আপনার আলোচনা থেকে আমাদের শ্রোতা/পাঠকবন্ধুরা রক্ত বা ব্লাড ক্যান্সারের লক্ষণগুলো জানতে পারলেন। লক্ষণ জানা গেল এবার কিভাবে এবং কোথায় পরীক্ষা নিরীক্ষা করাবেন। রোগটা কিভাবে নির্ণয় হবে। কোন ডাক্তারের কাছে যাবেন। বিষয়টি যদি একটু বুঝিয়ে বলেন?

ডা.কামরুল হাসান: খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন করেছেন আপনি। এই মুহূর্তে আমাদের দেশের জন্য এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা খুবই জরুরি। আমাদের দেশে বর্তমানে ব্লাড ক্যান্সারের রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। প্লাজমা, হেমাটোলজির রোগীগুলো কিভাবে তাদের রোগ নির্ণয় করবেন, কোথায় যাবেন?

ক্যান্সার

দেখুন, হেমাটোলজির রোগ কিন্তু অনেক। আমরা শুধু ক্যান্সারের বিষয় নিয়ে কথা বলছি। এর আগে ক্যান্সারের যে লক্ষণগুলোর কথা বললাম, যেমন ধরুণ- শরীর দুর্বল, জ্বর, দাঁতের গোড়া দিয়ে রক্তক্ষরণ, মলদ্বার দিয়ে রক্তক্ষরণ- এগুলো কিন্তু শুধু ব্লাড ক্যান্সার না আরো অনেক রোগের পূর্ব লক্ষণ। তো এধরণের লক্ষণ দেখা দিলে রোগীরা- তার হাতের কাছে যে কোনো একজন চিকিৎসকের কাছে গিয়ে থাকেন। তখন সেখানে সেই চিকিৎসক রোগীর পরীক্ষা নিরীক্ষা করে থাকেন। তো ল্যাবরেটরি টেস্টের মধ্যে যেমন রোগীর রক্তের ‘সিবিসি পরীক্ষা করান। এটি একেবারে প্রাথমিক একটি পরীক্ষা। আর এই পরীক্ষাতে যদি ব্লাড ক্যান্সার হয়ে থাকে তাহলে অনেক অস্বাভাবিকতা চলে আসে। স্থানীয় ডাক্তাররা যদি একটু মনোযোগ সহকারে রোগী দেখেন এবং রিপোর্টগুলো দেখেন তাহলে তাদের কাছে একটি ধারণা বা একটা সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক যে রোগীর রোগটা হয়তো আরো অনেক গভীরে। যদি তাদের মধ্যে সন্দেহ হয় যে তার ব্লাড ক্যান্সার তখন চিকিৎসকদের উচিত হবে সরাসরি হেমাটোলজিস্টের কাছে রেফার করা।

একটা সময় ছিল বাংলাদেশে হেমাটোলজিস্টের সংখ্যা খুবই কম ছিল। কিন্তু সুখের বিষয় এখন অনেক হেমাটোলজিস্ট হয়েছে বাংলাদেশে। ফলে তাদের কাছে রোগী গেলে সুর্নিষ্টভাবে নির্ধারণ করতে পারবেন রোগীর আসেলে কি হয়েছে!

শ্রোতাবন্ধুরা! আপনারা ক্যান্সার নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা শুনছেন। শিগগিরিই ফিরছি। আমাদের সাথেই থাকুন।

রেডিও তেহরান: বিরতির আগে ডা. কামরুল হাসান আপনি রক্তের প্রাথমিক পরীক্ষা সিবিসি'র কথা বলছিলেন এরপর কী পরীক্ষা করাতে হবে?

ডা.কামরুল হাসান: জ্বি, সিবিসি পরীক্ষার পর রক্তের সিবিএস পরীক্ষা করাই। এই পরীক্ষা দিয়েই কিন্তু মোটামুটি নির্ধারণ হয়ে যায় রোগীর ব্লাড ক্যান্সার কি না ? অনেক সময় এই পরীক্ষায় যদি নির্ধারণ করা সম্ভব না হয় তখন ভিন্নরকমের পরীক্ষা করা হয়। আর যদি দেখা যায় ব্লাড ক্যান্সার নির্ধারণ হয়েছে তারপরও বোনম্যারো পরীক্ষা করানো হয়।

রেডিও তেহরান: আচ্ছা এই বোনম্যারো পরীক্ষাটা আসলে কী?

ডা.কামরুল হাসান: বোনম্যারো পরীক্ষাটা হচ্ছে, মানুষের যে রক্ত তৈরি হয় সেটি হাঁড়ের মধ্যে হয়। শরীরের যেসব জায়গায় নরম হাঁড় আছে সেখানে রক্তকোষগুলো তৈরি হয়ে থাকে। ঐ হাঁড়ের ভেতর থেকে রক্ত নিয়ে যে পরীক্ষা করা হয় সেটাকে বোনম্যারো পরীক্ষা বলা হয়। এই পরীক্ষার মাধ্যমে কোন ধরণের ব্লাড ক্যান্সার কিংবা আদৌ ব্লাড ক্যান্সার কি না নিশ্চিত হওয়া যায়।

বোনম্যারো

আমরা ব্লাড ক্যান্সারের যে চিকিৎসা করি বা ব্লাড ক্যান্সার নির্ণয় করি তা সাধারণত ধাপে ধাপে করে থাকি। ধাপগুলো হচ্ছে- প্রথমে জানতে চেষ্টা করি ব্লাড ক্যান্সার কি না। দ্বিতীয় ধাপটি হচ্ছে কোন ধরণের ব্লাড ক্যান্সার। এটি মাইলয়েড না লিম্ফয়েড। নাকি এটি অ্যাকিউট না ক্রণিক। এরপর আরও সাবটাইটেল করা হয়। যেমন- লিম্ফয়েডের মধ্যে  টি- সেল নাকি বি- সেল কিংবা মাইলয়েডের মধ্যে কোনটি। আর এগুলো নির্ধারণের জন্য পরবর্তী ধাপে আরেকটি যে পরীক্ষা করি তাকে বলে 'ফ্লো সাইটোমেট্রি'। একসময় আমাদের দেশে ফ্লো সাইটোমেট্রি সহজসাধ্য  ছিল না। এখন বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি সেন্টারে ফ্লো সাইটোমেট্রি পরীক্ষা করা হচ্ছে এবং ব্লাড ক্যান্সারের রূপ নির্ধারণ করা এখন সম্ভব হচ্ছে।

ফ্লো সাইটোমেট্রি

জনাব, ডা. মো. কামরুল হাসান, ব্লাড ক্যান্সার নির্ণয়ের বিষয়ে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার জন্য আপনাকে আবারও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

ডা.মো.কামরুল হাসান: আপনাকেও ধন্যবাদ।

আর শ্রোতা/পাঠকবন্ধুরা, আগামী সপ্তায় ব্লাড ক্যান্সার নির্ণয়ের আরও কিছু পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হবে। সে আসরেও আমাদের সাথে থাকবেন বলে আশা করছি।

স্বাস্থ্যকথার আসর থেকে বিদায় নেয়ার আগে বলে রাখছি, আপনারা সবাই পুষ্টিকর খাবার খাবেন, বেশি বেশি বিশুদ্ধ পানি পান করবেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন এবং নিয়মিত ব্যয়াম করবেন। সবাই সু্স্থ ও নিরাপদ থাকুন।#

স্বাস্থ্যকথার আসরটি গ্রন্থণা, উপস্থাপনা ও প্রযোজনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/১৫