ডিসেম্বর ১৩, ২০২২ ০৭:৩২ Asia/Dhaka

মহান আল্লাহর আসমাউল হুসনার তালিকাভুক্ত আরও দুই নাম দ্বার্‌রু বা জার্‌রু «ضارّ» ও ন'ফিউ (বা ন'ফিয়ু) «نافع» । দ্বার্‌রু বা জার্‌রু নামের অর্থ ক্ষতি-সাধনকারী ও ন'ফিউ অর্থ কল্যাণ বা উপকারকারী।

আমরা বিগত দিনগুলোর আলোচনায় মহান আল্লাহর জালালি ও জামালি নামগুলোর তাৎপর্য সম্পর্কে জেনেছি যে মহান আল্লাহর জালালি নামগুলো বলতে বোঝায় তাঁর শক্তিমত্তা ও পরাক্রমের ঔজ্জ্বল্যে ভরপুর নামগুলোকে যেমন, ক্বাহ্‌হার তথা মহাপরাক্রান্ত বিজয়ী, ধরনের আরেকটি নাম হল মুন্তাক্বিম বা প্রতিশোধ গ্রহণকারী কিংবা আযিয বা পরাক্রান্ত। অন্যদিকে মহান আল্লাহর জামালি নামগুলো বলতে বোঝায় তাঁর দয়া, প্রেম ও করুণার মত প্রশান্ত-সৌন্দর্য-জ্ঞাপক নামগুলো যেমন, রাহমান, রাহিম ও গাফ্‌ফার বা সাত্তার ইত্যাদি। অবশ্য বাবার ক্রোধ বা রাগের মধ্যেও যেমন সন্তানের প্রতি ভালাবাসা ও স্নেহ লুকিয়ে আছে তেমনি মহান আল্লাহর জালালি নামগুলোর মধ্যেও দয়া ও করুণার সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে। তাই এই নামগুলোকে বাহ্যিক দৃষ্টিতে পরস্পর বিরোধী বা সাংঘর্ষিক বলে মনে হলেও বাস্তবে এসব নাম পরস্পরের পরিপূরক মাত্র। যেমন, মহান আল্লাহর নাম আউয়াল ও আখির একই বাস্তবতার প্রকাশ। মহান আল্লাহর নাম দ্বার্‌রু বা জার্‌রু ও ন'ফিউ বা ন'ফিয়ু সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। 
 
দ্বার্‌রু বা জার্‌রু হিসেবে মহান আল্লাহ মানুষের সব ধরনের ক্ষতি করতে পারেন। ক্ষতি কখনও হতে পারে  আর্থিক বা বস্তুগত, দৈহিক মানসিক ও আধ্যাত্মিক এবং চিন্তাগত ও বিশ্বাসগত। সন্তান-সন্ততির অসুখ বা অকাল মৃত্যুও মানুষের জন্য ক্ষতির অন্যতম দৃষ্টান্ত। মহান আল্লাহ মানুষের ক্ষতি করতে পারেন বা কল্যাণ লাভকে ঠেকিয়ে দিতে পারেন মানুষেরই কল্যাণের জন্য কিংবা তাদের পরীক্ষা করার জন্য বা শাস্তি দেয়ার জন্য। আবার কখনও নেয়ামত কমিয়ে দিয়েও আল্লাহ মানুষের ক্ষতি করতে পারেন। সুরা বাকারার ১৫৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, এবং অবশ্যই আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে হে নবী! সুসংবাদ দাও সবরকারীদের।– এই আয়াত ও এ জাতীয় অন্যান্য আয়াত থেকে বোঝা যায় সমস্ত ক্ষতি  মহান আল্লাহর প্রজ্ঞা বা কৌশল ও নিয়ম-নীতির আলোকে ঘটে থাকে। হযরত খিজির ও মুসা নবীর ঘটনায় খোদায়ি হিকমাতের কিছু দিক প্রকাশ পেয়েছে। যেমন, হযরত খিজির-আ একটি নৌকা ছিদ্র করে ডুবিয়ে দেন এ কারণে যে নৌকাটি ছিল কয়েকজন দরিদ্র ব্যক্তির জীবিকা অর্জনের মাধ্যম। আর সেটিকে ছিদ্র করা না হলে স্থানীয় জালিম বাদশাহ বলপ্রয়োগে ওই নৌকা ছিনিয়ে নিত। 

মহান আল্লাহর দ্বার্‌রু বা জার্‌রু নামের প্রকাশ অন্য সব কিছুর চেয়ে বেশি ঘটে জালিম ও আগ্রাসীদের মোকাবিলায়। এ জন্যই কোনো কোনো বর্ণনায় মহান আল্লাহকে ডাকা হয়েছে : হে আগ্রাসীদের ক্ষতিকারী – এই বাক্যের মাধ্যমে! আবার কখনও এমনও দেখা যায় যে মহান আল্লাহ বার বার পাপ ও জুলুমে লিপ্ত খোদাদ্রোহীদের কোনো শাস্তি না দিয়ে তাদেরকে পার্থিব নেয়ামত দিচ্ছেন বর্ধিত মাত্রায়! এর কারণ মহান আল্লাহ বিচার-দিবসেই তাদের মোকাবেলায় জার্‌রু নামের প্রকাশ ঘটাবেন পুরো মাত্রায়। মহান আল্লাহ ষড়যন্ত্রকারী বা ধোঁকাবাজদের মোকাবেলায় কৌশল ব্যবহারের কথা জানিয়ে সুরা আনফালের ৩০ নম্বর আয়াতে বলেছেন: আর কাফেররা যখন প্রতারণা করত আপনাকে বন্দী অথবা হত্যা করার উদ্দেশ্যে কিংবা আপনাকে বের করে দেয়ার জন্য তখন তারা যেমন ছলনা করত তেমনি, আল্লাহও ছলনা করতেন। বস্তুতঃ আল্লাহর ছলনা সবচেয়ে উত্তম।-  একত্ববাদে বিশ্বাসীরা এটা বোঝেন যে আল্লাহ ছাড়া আর কেউই মানুষের অনিষ্ট থেকে তাদের রক্ষা করতে সক্ষম নয় এবং আল্লাহ কাউকে কল্যাণ দান করতে চাইলে মহান আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ কেউই ঠেকাতে পারবে না।

 মহান আল্লাহই সব কল্যাণ এবং ক্ষতির মূল নিয়ন্ত্রক-এই বিশ্বাসের কারণে মুমিনরা কোনো জালিমের হুমকি ও ভীতি প্রদর্শনকে পরোয়া করেন না। অন্যদিকে সুরা ফুরক্বান-এর ৫৫ আয়াতে মহান আল্লাহ মুশরিকদের খোদা সম্পর্কে বলেছেন: তারা ইবাদত করে আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর, যা তাদের উপকার করতে পারে না এবং ক্ষতিও করতে পারে না। কাফের তো তার পালনকর্তার প্রতি পৃষ্ঠপ্রদর্শনকারী।–


মহান আল্লাহর  নাম ন'ফিয়ু'র অর্থ হল কল্যাণ দাতা বা উপকারকারী, লাভ আনয়নকারী ইত্যাদি। সব ধরনের কল্যাণ বা ভালো সব কিছু রয়েছে মহান আল্লাহর হাতে। আল্লাহর হাত থেকে এসব কেড়ে নেয়ার বা কমিয়ে দেয়ার বা বাড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতা কারো নেই। আল্লাহ কারো কোনো কল্যাণ করলে তাতে আল্লাহর কিছু কমে যায় না। তবে আল্লাহ কাউকে কতটুকু কল্যাণ বা ফায়দা দান করবেন তা নির্ভর করে মহান আল্লাহর কৌশল, রহমত ও অনুগ্রহের নীতির ওপর। প্রত্যেক সৃষ্টির জন্য মহান আল্লাহর এ সংক্রান্ত বরাদ্দ নির্দিষ্ট এবং কে কত ধরনের ফায়দা বা কল্যাণ পাবে তাও নির্দিষ্ট করে রেখেছেন মহান আল্লাহ। মানুষের পূর্ণতা অর্জনের জন্য তথা সৃষ্টিকুলের মধ্যে মহান আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের মর্যাদা অর্জনে যতটা বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক সুযোগ সুবিধা দরকার মহান আল্লাহ তার সবটুকুরই ব্যবস্থা করে রেখেছেন এবং বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক মাধ্যমে তা তাদের কাছে পৌঁছে দেয়ারও ব্যবস্থা করেন। 

একবার হযরত মুসা-আ. দাঁতের তীব্র ব্যথা উপশমের জন্য মহান আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করেন। মহান আল্লাহ একটি বিশেষ উদ্ভিদকে দাঁতে লাগাতে বলেন ওহির মাধ্যমে। ওই উদ্ভিদ ব্যবহার করার কিছুক্ষণের মধ্যেই দাঁতের ব্যথা সেরে যায়।  এর কিছুকাল পর আবারও হযরত মুসার দাঁতে ব্যথা শুরু হলে উনি ওই গাছটি দাঁতে লাগান। এবার হযরত মুসার দাঁতের ব্যথা না কমে বরং বেড়ে গেল! তখন তিনি আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করলে (করে বললেন: হে পারওয়ারদেগার! আপনিই কি আমাকে দাঁতের ব্যথা নিরাময়ে এ গাছ ব্যবহারের পরামর্শ দেননি?) মহান আল্লাহ বললেন: হে মুসা! আরোগ্য দানের এবং ক্ষতি দুর করার ও কল্যাণ পৌঁছে দেয়ার বিষয়টি কেবল আমার সিদ্ধান্তের ব্যাপার। প্রথমবারে তুমি আমাকে স্মরণ করে আমার আশ্রয় নিয়েছিলে বলে তোমার ব্যথার উপশম ঘটাই, কিন্তু এবার তুমি আমার এইসব ক্ষমতার কথা না ভেবেই ওই গাছ ব্যবহার করেছ ও আমাকে ডাকোনি বলে ব্যথা কমেনি বরং বেড়েছে!   

পবিত্র কুরআনের সাত নম্বর সুরা তথা সুরা আরাফ-এর ১৮৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন: হে নবী! আপনি বলে দিন, আমি নিজের কল্যাণ ও অকল্যাণ সাধনের মালিক নই, যদি না আল্লাহ চান। - মুমিন ব্যক্তি অবৈধ পথে স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করেন না, বরং প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করে ও মহান আল্লাহর ওপর ভরসা করে তাঁরই আশ্রয় নেন এবং সব কাজের ফলাফল আল্লাহর ওপরই ছেড়ে দেন। এ ধরনের ব্যক্তি অন্যদের কল্যাণ ও সুবিধা অর্জনের পথে বাধা হন না বরং আল্লাহর দেয়া নেয়ামত হতে অন্যদেরও উপকার করেন। এ ছাড়াও মুমিন যত কম সুবিধা বা কল্যাণের অধিকারীই হন না কেন আল্লাহর দেয়া বরাদ্দে সন্তুষ্ট ও আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকেন এবং এর ফলে আল্লাহ তাকে আরও নেয়ামত দান করেন।   #

পার্সটুডে/ এমএএইচ/২

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।