হিজরত পাপ-বর্জনের অন্যতম উপায়
রমজান: খোদাপ্রেমের অনন্য উৎসব (পর্ব-১৯)
মহানবীর হাদিসের আলোকে রমজানের শ্রেষ্ঠ আমল হল পাপ-বর্জন। পাপ-বর্জনের কয়েকটি উপায় নিয়ে আমরা গত পর্বে কথা বলেছি।
এসব উপায়ের মধ্যে রয়েছে তাকওয়া বা খোদা-সচেতনতা অর্জন, আল্লাহ সম্পর্কে সুধারণা রাখা, পাপের পরিবেশ বর্জন, মহান আল্লাহর অত্যধিক জিকির বা স্মরণ, আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন এবং রাত জেগে ইস্তিগফার বা তওবা করাও পাপ-বর্জনের অন্যতম বড় মাধ্যম। পাপ বর্জনের জন্য মহান আল্লাহর কাছে বেশি বেশি দোয়াও করতে হবে। অনেক হালাল কাজ বর্জনও পাপ মোকাবেলায় দৃঢ়তা এনে দেয়। যেমন, ভুরি-ভোজন, ঘন ঘন সুস্বাদু খাবার খাওয়া –এসব বর্জন করা।
পাপের পরিবেশ প্রশস্ত হয় এমন কাজ বা অবস্থা থেকে দূরে থাকাটাও পাপ বর্জনের এক উত্তম উপায়। যেমন, বেশি কথা বলা পাপের পথ প্রশস্ত করে। কারো কারো ক্ষেত্রে বেশি অর্থ ও সম্পদ আলস্য, বিলাসিতা এবং পাপ বয়ে আনে। আবার কারো কারো জন্য অতিরিক্ত দারিদ্র বা অতি-অভাবও পাপ বয়ে আনে। যে ব্যক্তি মদ জাতীয় পানীয় দেখলে তা পান করাটা এড়াতে পারে না তার জন্য এমন কিছু থেকে বহুদূরে থাকতে হবে। যে ব্যক্তি নিষিদ্ধ দৃশ্য বা ছবি এড়াতে পারে না তাকেও এসব বস্তুর সহজলভ্যতা থেকে অনেক দূরে থাকতে হবে।
এক ব্যক্তি জন্ম থেকেই অন্ধ ছিলেন। ইমাম বাক্বির আ. মোজেজার মাধ্যমে তাকে দৃষ্টিশক্তি দান করে বলেন, তুমি কি এটা পছন্দ কর যে এখন এ অবস্থায় সব কিছু দেখার ক্ষমতা থাকবে, কিন্তু বিচার-দিবসে পাপ-পুণ্যের হিসেবের আলোকে আল্লাহ তোমাকে বেহেশত দান করবেন, অথবা আগের মত অন্ধ থাকলে আল্লাহ তোমাকে বিনা হিসেবে বেহেশত দান করবেন? আবু বাসির নামের ওই ব্যক্তি বললেন, আমি আগের মতই অন্ধ থাকতে চাই। ইমাম তখন তাকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনেন।
পেশা পরিবর্তন করে ও বাসস্থান পরিবর্তন করে যদি পাপ এড়ানো যায় তবে তা-ই করা উচিত। ইসলামের প্রাথমিক যুগে মক্কার মুসলমানদের অনেকেই আবিসিনিয়ায় হিজরত করার কারণে মক্কার কাফের মুশরিকদের পাপপূর্ণ পরিবেশের প্রভাব ও বিপদ থেকে নিজেদের মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
কেউ যদি মনে করেন ইরানের মত ইসলামী দেশে থাকার কারণে অনেক পাপ থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব তাহলে তার উচিত নয় একান্তই বাধ্য না হলে এমন কোনো অঞ্চলে বসবাস করা যেখানে সেইসব পাপ এড়ানো তার পক্ষে সম্ভব নয়।
জনগণ যাতে পাপে জড়িয়ে না পড়ে সেজন্য পাপের মাধ্যম বা উপকরণগুলো সমাজ থেকে দূর করা মুসলিম সরকারগুলোর দায়িত্ব। তবে শুধু আইন করে বা সরকারি প্রচেষ্টায় পাপ দূর করা সম্ভব নয়। এ জন্য জনগণের মধ্যেও আত্মশুদ্ধির সদিচ্ছা থাকতে হবে। যেসব বিষয় বা মাধ্যম পাপের পথ খুলে দেয় সেসবের অন্যতম হল নেশা উদ্রেককর পানীয় পান, জুয়া খেলা, অসার কথা-বার্তা বলা ও অনুপযোগী হাসি-ঠাট্রা করা, অন্যদের দোষ-ত্রুটি প্রকাশ করা ও পাপীদের সঙ্গে চলাফেরা করা ইত্যাদি।
সমাজ থেকে পাপ দূর করার জন্য শাস্তির বিধান বাস্তবায়নও জরুরি। তবে তার আগে দরকার ইসলামী শিক্ষা ও নৈতিক শিক্ষার ব্যাপক প্রচার এবং প্রসার। বর্তমান যুগে ইসলামী শিক্ষা ও নৈতিক শিক্ষার অভাবে মুসলিম দেশগুলোতেও ব্যাভিচার, অশালীনতা, ধর্ষণ, পরকিয়া ইত্যাদি পাপ বেড়ে গেছে। ব্যাভিচার, চুরি-ডাকাতি, হত্যাকাণ্ড, অর্থ আত্মসাৎ এসব অপরাধ মোকাবেলার জন্য যদি ইসলামের শাস্তির-বিধান বাস্তবায়নের ব্যবস্থা থাকতো তাহলে এই অপরাধগুলো খুবই কমে যেত।
নিজেকে নিজে শাস্তি দেয়ার ব্যবস্থা রাখাও পাপ বর্জনের এক ভালো উপায়। যেমন, আপনি এ প্রতিজ্ঞা করতে পারেন যে আপনি যদি রাগ দমন করতে ব্যর্থ হয়ে অন্যদের সঙ্গে কর্কশ আচরণ করেন তাহলে এক মাস রোজা রাখবেন।
কারো মধ্যে পাপ কাজের নিয়ত বা ইচ্ছা থাকলে তা তাড়াতাড়ি বর্জন করা উচিত। আর এই বর্জনের জন্যও রয়েছে সাওয়াব। ইসলাম-পূর্ব যুগে এই বিধান ছিল না। অর্থাৎ মহানবীর উম্মতের জন্যই কেবল এই বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছে। অতীতের নবী-রাসুলদের যুগে কেউ পাপ করার ইচ্ছা করলে তা না করা পর্যন্ত গোনাহ হিসেবে রেকর্ড করা হত না। কিন্তু ওই পাপ বর্জনের কারণে কোনো সাওয়াবও লেখা হত না।
ইসলামী বিধান অনুযায়ী দু'জন মুসলমান যদি একে অপরকে হত্যা করার জন্য মারামারিতে লিপ্ত হয় ও তাদের একজন যদি এতে মারা যায় তাহলে যে হত্যা করেছে এবং যে নিহত হয়েছে উভয়ই জাহান্নামে যাবে। মহানবী (সা) এ বিধানটি বর্ণনা করলে সাহাবিদের একজন প্রশ্ন করেন, যে নিহত হয়েছে সে কেন জাহান্নামে যাবে? রাসুল তখন বলেন, কারণ যে নিহত হয়েছে তারও হত্যা করার নিয়ত বা ইচ্ছা ছিল। নবী-রাসুলরা কখনও গোনাহ বা পাপে জড়িত হওয়ার চিন্তাও করেন না। পাপের চিন্তাও না করাটা হচ্ছে সর্বোচ্চ পর্যায়ের খোদা-সচেতনতা বা তাকওয়া।
মহানবীর আহলে বাইতের অনুসরণ মানুষকে পাপ কাজ থেকে দূরে রাখে। কারণ মহানবীর আহলে বাইত পবিত্র কুরআনের নির্দেশনা বাস্তবায়নের আদর্শ দৃষ্টান্ত। মহানবীর আহলে বাইতের প্রতি গভীর ভালবাসাও মানুষকে পাপ থেকে দূরে রাখে। পবিত্র কুরআনে সুরা শুরার ২৩ নম্বর আয়াতে মহানবীর আহলে বাইতের প্রতি ভালবাসা প্রসঙ্গে এসেছে: হে রাসুল আপনি বলুন, আমি আমার দাওয়াতের জন্যে তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান চাই না, কেবল আমার নিকটাত্মীয় তথা আহলে বাইতের প্রতি ভালবাসা ব্যতীত। মহানবীর আহলে বাইত ও পবিত্র কুরআন কখনও বিচ্ছিন্ন হবে না বলে মহানবী উল্লেখ করেছেন। মহানবীর রিসালাতের প্রতিদান হিসেবে আহলে বাইতের প্রতি ভালবাসার যে কথা বলা হয়েছে তা অবশ্যই সাধারণ মানের ভালবাসা হতে পারে না। কারণ মহানবী ইসলাম প্রচারের জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। তাই তাঁর আহলে বাইতের প্রতি শুধু মৌখিক ভালবাসা এর যথাযোগ্য প্রতিদান হতে পারে না।
এখানে ভালবাসা বলতে তাঁদের অর্থাৎ আহলে বাইতকে অনুরসরণ করারই ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। আর আহলে বাইতকে অনুসরণ মানে সব সময় সঠিক পথে থাকা তথা পাপ থেকে দূরে থাকা। মহানবীর আহলে বাইত পাপকে ঘৃণা করেন বলে পাপ কাজ বজায় রেখে তাঁদেরকে ভালবাসার দাবি করা যেতে পারে না। কেউ যদি এমন হয় যে তিনি মুখে বলেন যে আমি হযরত আলী, হযরত ফাতিমা এবং হাসান ও হুসাইন-কে ভালবাসি অথচ বাস্তবে পাপও করে থাকেন তা হবে তাঁদের প্রতি পরিহাস করা বা অপমানের শামিল। মহানবীর আহলে বাইতকে ভালবাসা মানে মহানবীকেই ভালোবাসা আর মহানবীকে ভালোবাসা মানে আল্লাহকেই ভালোবাসা। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, তোমরা যদি আমার ভালবাসা পেতে চাও তাহলে আমার রাসুলকে ভালোবাস তথা তাঁর অনুসরণ কর।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে মহানবী (সা) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের অনুরাগী ও অনুসারী হওয়ার তৌফিক দান করুন।#
পার্সটুডে/এমএএইচ/মো.আবুসাঈদ/১৯
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।