মে ১৭, ২০২৩ ২২:৩৯ Asia/Dhaka

গত দুই পর্বে আমরা পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত আদর্শ নারীদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিক সম্পর্কিত আলোচনার অংশ হিসেবে হযরত মুসার মাতা ও হযরত ঈসার মাতার জীবন নিয়ে আলোচনা করেছি।

আজ আমরা কুরআনে উল্লেখিত আরেক মহান নারী সবার রাণী বিলকিস সম্পর্কে কথা বলব। সবার রাণী বিলকিস সম্পর্কে বক্তব্য রয়েছে সুরা নাম্‌ল্‌-এ। তিনি ছিলেন  ইয়েমেন অঞ্চলের একটি শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ দেশের রাণী। ইহুদি ও খ্রিস্টানদের ধর্মীয় গ্রন্থেও বিলকিসের নাম এসেছে। বিলকিস নয় বছর ধরে শাসন কাজ চালিয়ে গেছেন। প্রথমদিকে তিনি ছিলেন সূর্য-পূজারি। এরপর হযরত সুলায়মান নবীর সঙ্গে পরিচয়ের সুবাদে তিনি একত্ববাদী বা এক আল্লাহর ওপর ঈমান আনেন। পবিত্র কুরআনে সাবা শব্দটি দুই বার এসেছে। পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত একমাত্র নারী শাসক তথা রাণী হলেন বিলকিস। তার নেতৃত্ব বা পরিচালনা সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে কোনো তিরস্কার দেখা যায় না। বরং ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে তাঁকে। তাই বোঝা যায় যে সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে নারীর উপস্থিতি বা ভূমিকা রাখা বৈধ। সুরা নাম্‌ল্‌-এ সাবার রাণীর চিন্তাধারার প্রশংসা রয়েছে।

পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত একমাত্র নারী শাসক তথা রাণী হলেন বিলকিস

 

পবিত্র কুরআনে সবার রাণী সম্পর্কিত ঘটনার বর্ণনা এসেছে তার প্রতি সুলায়মান নবীর পক্ষ থেকে একত্ববাদের দাওয়াত প্রসঙ্গে।  একদিন হযরত সুলায়মান (আ) তাঁর সেনাদলের সবাইকে তাঁর সঙ্গে আল্লাহর ঘর জিয়ারত করতে যাওয়ার নির্দেশ দেন। মক্কায় যাওয়ার পথে তিনি অনুভব করেন যে তাঁর বিশেষ  বাহক হুদহুদ পাখিকে দেখা যাচ্ছে না। অবশ্য কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল যে হুদহুদ ফিরে এসেছে। হুদহুদ জানায় আমি এ অঞ্চলে উড্ডয়নে মশগুল থেকে সাবা নামক রাষ্ট্রে পৌঁছোই।  সেখানকার শাসক হলেন বিলকিস নামের এক নারী। এই রাষ্ট্রের জনগণ সূর্যের পূজা করে ও সূর্যের উদ্দেশে  সিজদা দেয়। সুরা নাম্‌ল-এর ২৩ ও ২৪ নম্বর আয়াতে হুদহুদ পাখির উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে:  আমি এক নারীকে সাবাবাসীদের উপর রাজত্ব করতে দেখেছি। তাকে সবকিছুই দেয়া হয়েছে এবং তার একটা বিরাট সিংহাসন আছে। আমি তাকে ও তার সম্প্রদায়কে দেখলাম তারা আল্লাহর পরিবর্তে সূর্যকে সেজদা করছে। শয়তান তাদের দৃষ্টিতে তাদের কার্যাবলী সুশোভিত করে দিয়েছে। অতঃপর তাদেরকে সৎপথ থেকে নিবৃত্ত করেছে। অতএব তারা সৎপথ পায় না।

হযরত সুলায়মান হুদহুদের কথা শুনে হুদহুদের মাধ্যমে সাবার রাণীর কাছে চিঠি পাঠিয়ে তাঁকে একত্ববাদের দাওয়াত দেন। বিলকিস বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি হযরত সুলায়মানের চিঠি পেয়ে ওই চিঠিকে বেশ সম্মানজনক বলে উল্লেখ করেন। সুরা নামল্‌-এর ২৯ ও ৩০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: বিলকীস বলল, হে পরিষদবর্গ, আমাকে একটি সম্মানিত পত্র দেয়া হয়েছে।–অর্থাৎ চিঠি পড়েই বিলকিস সুলায়মান নবীর মর্যাদা, শক্তিমত্তা ও তাঁর বিশাল রাষ্ট্র সম্পর্কে ধারণা করতে সক্ষম হন। চিঠি পাওয়ার পর তিনি এ বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে তার জাতির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ডেকে তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করেন। তারা জানান যে রাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে তাঁদের রাষ্ট্র বেশ শক্তিশালী তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়টি তাঁরা রাণীর ওপরই ছেড়ে দেন। রাণী বেশ দূরদর্শী সিদ্ধান্তই নেন। তিনি সুলায়মানের কাছে পুরস্কার ও উপঢৌকন পাঠান তাকে পরীক্ষা করার জন্য। তিনি যদি ওইসব উপহার নিয়ে সন্তুষ্ট থাকেন তাহলে বোঝা যাবে যে একত্ববাদী ও নবী হওয়ার যে দাবি সুলায়মান করেন তা সত্য নয়। বরং তিনি একজন সম্পদলোভী রাজা মাত্র। 

বাদশাহ সুলায়মান ও সাবার রাণী 

 

হযরত সুলায়মান সাবার রাণীর উপহার প্রত্যাখ্যান করেন ও সামরিক হামলার হুমকি দেন এবং তাদেরকে ওই দেশ থেকে অপমানজনকভাবে বের করে দেয়ার কথা বলেন।  সুরা নামল্‌-এর ৩৬ ও ৩৭ নম্বর আয়াতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে: অতঃপর যখন রাণীর দূত সুলায়মানের কাছে আগমন করল, তখন সুলায়মান বললেন, তোমরা কি ধনসম্পদ দ্বারা আমাকে সাহায্য করতে চাও? আল্লাহ আমাকে যা দিয়েছেন, তা তোমাদেরকে প্রদত্ত বস্তু থেকে উত্তম। বরং তোমরাই তোমাদের উপঢৌকন নিয়ে সুখে থাকো।

সুলায়মানের কাছ থেকে কঠোর হামলার হুমকি পাওয়ার পর সাবার রাণী তাঁর জাতির নেতৃস্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তিকে নিয়ে সুলায়মানের সঙ্গে আলোচনা করতে রওনা হন। মহান নবী সুলায়মান তা জানতে পেরে রাণীর পৌঁছার আগেই তাঁর সিংহাসনকে নিজের দরবারে নিয়ে আসার নির্দেশ দেন। তাঁর দরবারের এক ব্যক্তি জানান যে নবী সুলায়মান চোখের পলক ফেলা মাত্রই ওই সিংহাসন তিনি এখানে নিয়ে আসবেন। 

রাণী বিলকিস যখন সুলায়মানের প্রাসাদে আসেন তখন সেখানে নিজের সিংহাসন দেখতে পেয়ে বিস্মিত হন। এরপর রাণী বিলকিসকে কাঁচের প্রাসাদে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই প্রাসাদ ছিল এতই উন্নত মানের যে বিলকিসের মনে হয়েছিল যে তিনি জলাশয়ের পানির ওপর দিয়ে হাঁটতে যাচ্ছেন, আর তাই তিনি পায়জামা বা ঘাঘরা কিছুটা গুটিয়ে নেন যাতে তাতে পানি না লাগে! অবশ্য পরে বুঝতে পরেন যে সেটা পানির পথ নয় বরং কাঁচের মত স্ফটিকের স্বচ্ছ পথ! সুলায়মানের এতসব জাঁকজমক, ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি দেখে বিলকিস আত্মসমর্পণ করে এক আল্লাহর ওপর ঈমান আনেন ও বিচ্যুতি থেকে মুক্তি পান। এ প্রসঙ্গে সুরা নাম্‌ল্‌-এর ৪৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: তাকে বলা হল, এই প্রাসাদে প্রবেশ কর। যখন সে তার প্রতি দৃষ্টিপাত করল সে ধারণা করল যে, এটা স্বচ্ছ গভীর জলাশয়। সে তার পায়ের গোছা খুলে ফেলল। সুলায়মান বলল, এটা তো স্বচ্ছ স্ফটিক নির্মিত প্রাসাদ। বিলকীস বলল, হে আমার পালনকর্তা, আমি তো নিজের প্রতি জুলুম করেছি। আমি সুলায়মানের সাথে বিশ্ব জাহানের পালনকর্তা আল্লাহর নির্দেশ ও বিধানের কাছে আত্মসমর্পন করলাম। 

পবিত্র কুরআনের বর্ণনা থেকে বোঝা যায় সাবার রাণী ছিলেন ইয়েমেনের  বিশাল দেশের শাসক ও বিশ্বের বিচক্ষণ শাসকদের অন্যতম। সত্যের মোকাবেলায় বিদ্রোহ নয় বরং আত্মসমর্পণ করাই যে সাহসিকতা তা তিনি জানতেন। রাণী বিলকিস বিদ্রোহের পরিবর্তে মহান আল্লাহর নবী সুলায়মানের সঙ্গে সংলাপে বসার নীতি গ্রহণ করেছিলেন। সুলায়মান সত্যিই মহান আল্লাহর নবী ও একত্ববাদী  নাকি একজন লোভী রাজা মাত্র তাও বিলকিস পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়েছেন। তিনি যখন বুঝতে পারেন যে সুলায়মান আ. প্রকৃত নবী এবং তাঁর বক্তব্য সত্য তখন তিনি আত্মসমর্পণ করে জনগণকে রক্তপাত থেকে দূরে রেখে তাদের রক্ষা করেন। কেবল তাই নয় তিনি ঈমান এনে বিচ্যুতি থেকে মুক্তি লাভ করেন।#

পার্সটুডে/এমএএইচ/১৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। 

ট্যাগ