ডিসেম্বর ০২, ২০২৩ ২০:১৪ Asia/Dhaka
  • ঘটনার নেপথ্যে (পর্ব-৯)

গত আসরে আমরা ইরানের নিরাপত্তা নিয়ে পাশ্চাত্যের প্রচারণা সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আজ আমরা ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরনের সর্বোচ্চ নেতার অনন্য সাধারণ নেতৃত্ব সম্পর্কে খানিকটা কথা বলার চেষ্টা করব। আশা করছি শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাবো।

ইরানের সংবিধানের পঞ্চম অধ্যায়ে বেলায়েতে ফকিহ বা যোগ্য আলেমের শাসনের কথা বলা হয়েছে। বিষয়টি শিয়া মাজহাবের ফিকাহ গ্রন্থগুলোতে বহুকাল ধরে বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও ইরানের ইসলামি বিপ্লবের আগে কাউকে এটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। নিঃসন্দেহে ইসলামি বিপ্লবের রূপকার ইমাম খোমেনী (রহ.) ছিলেন সেই সব মুষ্টিমেয় আলেমদের একজন যারা ধর্মের ভিত্তিতে শাসনব্যবস্থা পরিচালনার কথা বলে আসছিলেন। ইমাম এ দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়নের জন্য শাসকশ্রেণির রক্তচুক্তসহ নানা ধরনের প্রতিকূলতা উপেক্ষা করেছেন। যে সময়ে বিশ্বের কোনো দেশের রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যবস্থায় ধর্মের কোনো ভূমিকা ছিল না সেই সময়ে বেলায়েতে ফকিহ নামক ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার মতাদর্শ উপস্থাপন করে ইমাম খোমেনী অসামান্য সাহসিকতার পরিচয় দেন।

অনেকে মনে করেন, বেলায়েতে ফকিহ হচ্ছেন এমন একজন শাসক যিনি নিজের অসংখ্য ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও একটি দেশের রাষ্ট্রক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করেন এবং যেকোনো বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি নিয়ে থাকেন। কিন্তু ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধানে যে বেলায়েতে ফকিহর কথা বলা হয়েছে সে সম্পর্কে এই ধারনাটি অসম্পূর্ণ।  কারণ, ইরানের সংবিধানের পঞ্চম অধ্যায়ে সর্বোচ্চ নেতার যে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে সেই নেতাকে ন্যায়পরায়ণ, ধার্মিক, যোগ্য ব্যবস্থাপক, দক্ষ, সাহসী এবং সময় সচেতন হতে হবে। তিনি মানুষকে এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহ্বান জানাবেন, মানুষের অন্তরাত্ম পরিশুদ্ধ রাখতে এবং সর্বোপরি আত্মিক দিক দিয়ে মানুষকে পূর্ণতায় পৌঁছাতে সাহায্য করবেন। গত ৩৪ বছর ধরে ইরানের এই মহান দায়িত্ব যথাযথ যোগ্যতার প্রমাণ রেখেই পালন করে আসছেন আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী।

ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে এখন পর্যন্ত ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের শাসনব্যবস্থা শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন বেলায়েতে ফকিহ বা সর্বোচ্চ নেতা। এ কারণে শত্রুরা এ পর্যন্ত ইরানের যত সমলোচনা করেছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় শিকার হয়েছেন ব্যক্তি আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী। আমেরিকার থিংক ট্যাংক ফরেন রিলেশন্স কাউন্সিলের সদস্য ‘রেই টাকিয়ে’ ইরানের সর্বোচ্চ নেতা সম্পর্কে এক নিবন্ধে লিখেছেন: “ইরানের প্রায় সকল সফলতার পেছনে রয়েছে প্রচারবিমুখ একজন ধর্মীয় নেতার অবদান। বিগত দশকগুলোতে যে অঞ্চলের বহু শাসকের পতন হয়েছে সে অঞ্চলের দেশ হয়েও ইরানের শাসনব্যবস্থার পতন হয়নি বরং অতীতের চেয়েও শক্তিশালী হয়েছে। পারস্য উপসাগর থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী।”

ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতার জীবনে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর প্রতি গভীর আস্থা, বিশ্বাস ও নির্ভরতা কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছে।  লেবাননের ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হিজবুল্লাহর মহাসচিব সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ ১৯৯০-এর দশকে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার সঙ্গে নিজের সাক্ষাতের স্মৃতিচারণ করে বলেন: ১৯৯৭ ও ১৯৯৮ সালে ইহুদিবাদী ইসরাইলের পক্ষ থেকে ব্যাপক চ্যালেঞ্জ ও সমূহ বিপদ মোকাবিলা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে উঠেছিলাম।  সে সময় আমি ছিলাম তরতাজা যুবক, আমার একটি দাড়িও পাকেনি এবং যে দায়িত্ব আমার ঘাড়ে ছিল তা আমার সহ্যসীমাকে অতিক্রম করে গিয়েছিল।  সে সময় আমি এক সফরে ইরানে গিয়ে সর্বোচ্চ নেতাকে বললাম: হে সাইয়্যেদ! আমি এখন কী করব? পরামর্শ দিন।

তিনি উত্তর দিলেন: “মানুষ তার জীবন চলার পথে নানারকম চ্যালেঞ্জ, সমস্যা ও সংকট মোকাবিলা করবে এটাই স্বাভাবিক। এটা ঠিক যে, মানুষ কখনও কখনও আত্মিক দিকে দিয়ে এতটা ক্লান্ত হয়ে পড়ে যে, তার তখন উপযুক্ত দিকনির্দেশনার প্রয়োজন দেখা দেয়। সে এমন কারো পরামর্শের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে যে তাকে প্রশান্তি দান করবে। কখনও তার এমন কারো সাহায্যের প্রয়োজন হয় যে তার ক্ষমতাকে শক্তিশালী ও তার সম্মান বাড়িয়ে দেবে। আমাদের এ ধরনের যত প্রয়োজন আছে তার সবগুলো পূরণ করার জন্য আল্লাহ তায়ালা আছেন এবং তিনি ছাড়া আর কারো প্রয়োজন আমাদের নেই।”

সাইয়্যেদ নাসরুল্লাহকে আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী আরো বলেন: “কাজেই যখনই ক্লান্তি অনুভব করবে ও কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে তখন একটি নির্জন কক্ষে প্রবেশ করবে এবং মহান আল্লাহর কাছে নিজের সব কথা প্রাণখুলে বলবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, আল্লাহ তায়ালা সর্বত্র বিরাজমান, তিনি সবকিছু দেখেন, শোনেন, জানেন এবং তিনি সর্বশক্তিবান, ধনবান ও প্রজ্ঞাবান। আমাদের যা কিছু প্রয়োজন তার সবকিছু আল্লাহ তায়ালার কাছে আছে। কাজেই তাঁর সঙ্গে কথা বলবে। তোমার অন্তরে যা কিছু আছে তার সবকিছু মুখে উচ্চারণ করে তাঁর সামনে তুলে ধরবে। তুমি যদি তা করতে পারো তাহলে মহান আল্লাহ তোমার অশান্ত মনকে প্রশান্ত করে দেবেন এবং তোমাকে নিজ হাতে সঠিক পথের দিশা দেবেন এবং সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। আমি এসব কথা আমার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। তুমিও বাস্তবায়ন করে দেখো, সুফল পাবে।”

আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী বিশ্বাস করেন, একজন মানুষের কথা ও কাজে যদি ঈমানের পরিচয় পাওয়া যায় তাহলে তার সামনে পাহাড়সহ বাধা থাকলেও তা দূর হয়ে যায়। হযরত মূসা (আ.) ও তার জাতির সামনে থেকে ফেরাউনের মতো একটি অলঙ্ঘনীয় বাধা যেমনভাবে অপসারিত হয়েছে তেমনি ধৈর্য্য ও দৃঢ়চেতা ঈমানের মাধ্যমে বর্তমান যুগেও আল্লাহ তায়ালার একই রকম সাহায্য লাভ করা সম্ভব। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ঈমানদার মানুষদের এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, তারা সংখ্যায় যত কমই হোক না কেন শত্রুদের বিরুদ্ধে তাদের বিজয় অবশ্যম্ভাবী। যেমন হযরত মূসা (আ.) ও তাঁর ভাই হারুনকে যখন আল্লাহ তায়ালা ফেরাউনের দরবারে পাঠান তখন হযরত মূসা বলেন, হে আল্লাহ! আমাদের দুজনের পক্ষে কীভাবে এতবড় দরবারে যাওয়া সম্ভব? ওরা আমাদেরকে হত্যা করে ফেলতে পারে। তখন মহান আল্লাহ হযরত মূসাকে বলেন: আপনারা ভয় করবেন না, আমি তো আপনাদের সঙ্গে আছি, আমি শুনি ও আমি দেখি।  সূরা তোয়াহা, আয়াত ৪৬।

যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে এবং তাঁর ওপর ভরসা করে তাদেরকে সাহায্য করাকে আল্লাহ তায়ালা নিজের দায়িত্ব মনে করেন।  আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ীর নেতৃত্বে ইরানি জাতি মহান আল্লাহর ওপর এমন ভরসাই করেছে। ইরানের কসম খাওয়া শত্রুরা বিগত চার দশকের বেশি সময় ধরে ইরানের ক্ষতি করার সব রকম চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ীর ভাষায়: এটি হচ্ছে আল্লাহর সেই প্রতিশ্রুতির নিদর্শন যে, আমি দেখি এবং আমি শুনি। এই ইসলামি বিপ্লব সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোকে আরো বহু সমস্যার সম্মুখীন করবে।

তো শ্রোতাবন্ধুরা, এখানেই শেষ করতে হচ্ছে ঘটনার নেপথ্যের আজকের আয়োজন। যারা সঙ্গ দিলেন তাদের প্রত্যেককে অসংখ্য ধন্যবাদ।

পার্সটুডে/এমএমআই/ বাবুল আখতার/ ২

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

ট্যাগ