বাংলাদেশের নির্বাচন
''আগামী নির্বাচন দেশকে গভীর সংকটে ফেলবে''
শ্রোতা/পাঠকবন্ধুরা! আপনারা জানেন, বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি। সেই নির্বাচন নিয়ে নানা আলোচনা ও সমালোচনা চলছে সর্বত্র। সরকারি দলসহ তাদের জোট এবং সম্প্রতি আলোচিত কিংস পার্টির সদস্যরা মনোনয়ন পত্র জমা দিয়েছেন-বহু মনোনয়ন বাতিল হয়েছে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে অবরোধ ও হরতালসহ নানা কর্মসূচি পালন করছে।
তো আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে যেসব রাজনৈতিক কথাবার্তা হচ্ছে সেসব বিষয়ে রেডিও তেহরানের সঙ্গে কথা বলেছেন 'আমার বাংলাদেশ পার্টি' বা এবি পার্টির সদস্য সচিব মুজিবুর রহমান মঞ্জু।
জনাব মুজিবুর রহমান মঞ্জু রেডিও তেহরানের আলাপন অনুষ্ঠানে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।
রেডিও তেহরান: জনাব মুজিবুর রহমান মঞ্জু, বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় পার হয়েছে, বাছাই প্রক্রিয়াও শেষ। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, নির্বাচনি ট্রেন চলতে শুরু করেছে- গন্তব্যে পৌঁছাবেই। কী বলবেন আপনি?
মুজিবুর রহমান মঞ্জু: ধন্যবাদ আপনাকে। ওবায়দুল কাদের সাহেব যে কথা বলেছেন, যে নির্বাচনি ট্রেন চলতে শুরু করেছে-গন্তব্যে পৌঁছাবেই। এ ট্রেন থামানো যাবে না। তো জোর করে যদি কেউ খালি ট্রেন চালিয়ে নিয়ে কোথাও গিয়ে থামে এবং বলে যে ট্রেন থামানো যাবে না! দেখুন, গায়ের জোরে তো এরকম বলাই যায়। অতীতেও অনেকে বলেছেন এবং করেছেন। গায়ের জোরে অতীতে বাংলাদেশে নির্বাচনও হয়েছে। ৮৬,৮৮, ১৫ ই ফ্রেব্রয়ারি, ২০১৪, ২০২১৮ এগুলোর সবই তো কলঙ্কিত ট্রেন। কলঙ্কিত ও যাত্রীবিহীন ট্রেন জোর করে চালিয়ে গেছেন। আর অতীত ইতিহাস বলে তারা দুর্ঘটনায় কবলিত হয়েছেন। আর যে দুর্ঘটনা তাদেরকে চিরতরে গাড়ির চালকের আসন থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। সেটা আমরা ইতিহাস থেকে জানি। সুতরাং ওবায়দুল কাদের সাহেব যে নির্বাচনি ট্রেন নিয়ে যাচ্ছেন; এরইমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে সেই ট্রেনে কোনো বিবেকবান ও সত্যিকার রাজনীতিকরা ঐ ট্রেনে উঠছেন না। কিছু ছাইপাস, কিছু দালালদের সেখানে নিয়েছেন। আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি দালালরাও এখন সেখানে খুব কষ্টে আছেন। তারা এখন সই ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করবেন নাকি সেই ট্রেনের ভেতরে আত্ম চিৎকার করে আত্মহত্যা করবেন-এরকম একটা অবস্থার মধ্যে আছেন। সুতরাং ওবায়দুল কাদের সাহেব যদি খালি ট্রেন নিয়ে যেতে চান সেটি আমি মনে করি তারা পতনের দিকে যাবেন। এটি তাদেরকে চিরস্থায়ী কলঙ্কের মধ্যে নিপতিত করবে। আর সেই কলঙ্কের মধ্য দিয়ে তাদের একসময় পতন হবে।
রেডিও তেহরান: জনাব মঞ্জু অনেকেরই প্রশ্ন, হয়ত বিরোধী অনেক নেতা-কর্মীর মধ্যেও এই প্রশ্ন আছে যে- ৭ জানুয়ারি নির্বাচন তো হয়ে যাবে। তারপর কী হবে?
মুজিবুর রহমান মঞ্জু: দেখুন, নির্বাচন হয়ে গেলেই যে এই সরকার মানুষের কাছে বৈধতা পাবে বিষয়টা তো এমন না! তারা তো ২০১৪ ও ২০২১৮ সালেও নির্বাচন করেছেন। একটি অবৈধ সরকার হিসেবে দিনদিন তারা অজনপ্রিয় হয়েছেন। আপনি দেখুন, গত ১০ থেকে ১৫ বছর ধরে এমন অনেক আছেন যারা নিজের ভোট নিজে দিতে পারেননি। এবারও দেখা যাবে দেশের প্রায় ৯০ ভাগ মানুষই তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে না বা দিতে ইচ্ছুক হবে না। ফলে এ ধরনের নির্বাচন করার পর দেখা যাবে সরকার অবৈধই থেকে যাবে এবং সরকারের যে অজনপ্রিয়তা ও সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের যে ক্ষোভ সেটা বাড়তে থাকবে। সরকারের ব্যর্থতার কারণে দেশের অর্থনীতির যে ভঙ্গুর অবস্থা, দ্রব্যমূল্যের যে উর্ধ্বগতি , ডলার সংকট, রিজার্ভ শূন্যতা এসব বিষয় সরকারের বর্তমান যে স্টাটাস সেই স্টাটাসেই রেখে দিচ্ছে। সুতরাং আমি মনে করি নির্বাচনের পর সরকার বাড়তি কিছু ঝামেলায় পড়বে এবং বর্তমান অবস্থার চেয়েও খারাপ অবস্থায় গিয়ে পৌঁছাবে। তার একটা কারণ হচ্ছে আন্তর্জাতিকভাবে বড় একটা নিষেধাজ্ঞায় পড়বে সরকার। গার্মেন্টের ওপর একটা নিষেধাজ্ঞার কথা আমরা শুনতে পাচ্ছি। এরইমধ্যে বাংলাদেশের একটি বিশেষায়িত বাহিনী 'সোয়াতের' উপর নিষেধাজ্ঞা এসে গেছে। সুতরাং আমি বলতে চাইছি, সরকার যদি এই নির্বাচন বন্ধ না করে আবারও ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে সেক্ষেত্রে তারা আরও গভীর সংকটে পড়বে। আর সেই সংকট থেকে তাদেরকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।
শ্রোতাবন্ধুরা! বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে এবি পার্টির সদস্য সচিব মুজিবুর রহমান মঞ্জুর সাক্ষাকৎকার শুনছেন। ফিরছি শিগগিরি আমাদের সাথেই থাকুন।
রেডিও তেহরান: আবারও ফিরে এলাম সাক্ষাৎকারে। জনাব মঞ্জু, আপনারা যে নির্বাচন বয়কট করলেন, আপনারা লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে কতটা স্বস্তিদায়ক অবস্থানে এখন? আপনি কী মনে করেন- তত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় এবং শিগগিরি নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে পারবে বিরোধী দলগুলো?
মুজিবুর রহমান মঞ্জু: দেখুন, ন্যায্য এবং যৌক্তিক আন্দোলন আদায় করে নিতে অনেক পথ পরিক্রমা পেরোতে হয়। অতীতে আমরা এসব ইতিহাস দেখেছি। ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পেতে আমাদেরকে সংগ্রাম করতে হয়েছে। ভাষার অধিকারের জন্য লড়াই সংগ্রাম করতে হয়েছে। সুতরাং আজকে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে লড়াই চলছে সেটি আমাদের পুরনো লড়াই। এ লড়াইয়ে জিতে বিষয়টিকে আমরা স্টাবলিশ করেছিলাম। কিন্তু সেটাকে আবার ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। অতীতে আমরা যেভাবে বিজয়ী হয়েছে এবারের লড়াইয়েও আমরা বিজয়ী হব বলে আশাবাদী। তবে এবারের স্বৈরাচার অনেক বেশি শক্তিশালী হিংস্র। সেজন্য হয়তো আমাদের সময় লাগছে। আর আমাদের বড় অর্জন এখন পর্যন্ত হচ্ছে- যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে সেটাকে প্রহসনের নির্বাচন হিসেবে চিহ্নিত করতে পেরেছি এবং একটা গ্রেটার অ্যালায়েন্স এরইমধ্যে তৈরি হয়েছে। আমরা মনে করছি আজকে পুলিশ, অস্ত্র, সাউন্ড গ্রেনেড মেরে আমাদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের অধিকারকে যে ছিনিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু একটি প্রবাদ আছে, চোরের দশদিন আর গৃহস্থের একদিন। সেরকম একটা সময় খুব শিগগিরি আসবে। সুদিন আসবে এবং গণতন্ত্র ফিরে আসবে। আমরা আমাদের অধিকার ফিরে পাব।
রেডিও তেহরান: জনাব মুজিবুর রহমান মঞ্জু-আমরা একেবারে শেষের দিকে চলে এসেছি। সবশেষে যে বিষয়টি জানতে চাইব-সেটি হচ্ছে, এবারের নির্বাচনে বিশেষ করে ক্রিকেটার শাকিব আল হাসান এবং নায়ক ফেরদৌসের মনোনয়ন নিয়ে এক রকমের সমালোচনা শুরু হয়েছে। আবার চিত্র নায়িকা মাহিয়া মাহি ও হিরো আলমের মতো ব্যক্তিরাও প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন? এই যে রাজনৈতিক ও নির্বাচনী ট্রেন্ড….কীভাবে দেখছেন বিষয়গুলোকে?
মুজিবুর রহমান মঞ্জু: দেখুন, অধিকারের প্রশ্নে যে কেউ কিন্তু রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পারে। তিনি শিল্পী হোন, নায়ক হোন কিংবা তিনি খেলোয়ড় হোন-রাজনীতি সবার অধিকারের জায়গা। যে কেউ সেখানে আসতে পারে। কিন্তু প্রশ্নটি হচ্ছে সাকিব আল হাসান আমাদের দেশের আইন প্রণয়নে কী ভূমিকা রাখবেন? নায়ক ফেরদৌস ভোটে দাঁড়িয়েছেন আমি যে এলাকায় বসবাস করি সেখান থেকে। সেদিন মসজিদে জুমার নামাজ পড়ছি তখন দেখলাম তিনি সেখানে বক্তব্য রাখছেন। ফেরদৌসকে এরআগে কখনও মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করতে দেখিনি। আমি এ এলাকায় প্রায় ৮ বছর বসবাস করছি। ওনাকে মসজিদে এসে কখনও দুচার কথা বলতে শুনিনি। উনি একজন সিনেমার নায়ক, ভালো অভিনেতা তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এখন কথা হচ্ছে হিরো আলম, মাহিয়া মাহি,ফেরদৌস এবং সাকিব আল হাসান এরা যারা নির্বাচনে কিংবা রাজনীতিতে আসছেন-তারা কি গণতান্ত্রিকভাবে এসেছেন? তারা কি দলের সঠিক নিয়ম মেনে সদস্য হয়েছেন? যথাযথ নিয়ম মেনে কি তারা প্রার্থী হয়েছেন? হননি। তাদেরকে কেউ না কেউ এনেছেন অথবা কোনো আকাঙ্খার বশবর্তী হয়ে এখানে এসেছেন। বিষয়টি পরিস্কার । আমরা যারা সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করি আমরা দেখতে পাচ্ছি সরকার কিছু নায়ক নায়িকা, গায়ক গায়িকা, শিল্পী-খেলোয়াড়দের নির্বাচনে এনে নির্বাচনটাকে একটু এন্টারটেইনবেজ করার চেষ্টা করছে। এটা আসলে পারতপক্ষে একটি ফাঁদ। এছাড়া রাজনীতিকে অপরাজনীতির দিকে ঠেলে দেয়ার একটা ব্যবস্থা। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি একজন সংসদ সদস্যের দায়িত্ব কি, আইন প্রণয়নে তার ভূমিক কি এই যে সারকামসটেনসিয়াল যে নর্মসগুলো আছে সেগুলো তারা জানেন না।
যাদেরকে নির্বাচনে প্রার্থী করা হয়েছে-ধরুন সাবিক আল হাসানকে যদি প্রশ্ন করা হয় আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার কয়জন। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র সম্পর্কে উনি কি জানেন? দেখবেন-তারা কিছুই বলতে পারবেন না। তাহলে দেখা যাচ্ছে একটি অশুভ প্রক্রিয়া বা হাইব্রিড প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এদেরকে রাজনীতিতে আনা হয়েছে। আমি আবারও বলছি, তাদের রাজনীতিতে আসার অধিকারের ব্যাপারে শ্রদ্ধাশীল। রাজনীতি করার অধিকার তাদের অবশ্যই আছে। কিন্তু একটি দলের নীতি নিয়ম এবং আমাদের দেশের জনপ্রতি হওয়ার জন্য যে ক্রমধারা সেটি তারা অবলম্বন করেননি বরং সাকিব আল হাসান, ফেরদৌস, হিরো আলম এবং মাহিয়া মাহি যদি মনোনয়ন পান তাহলেযোগ্য রাজনীবিদদের অধিকার ক্ষুণ্ণ করা হয়। বাইরে যাই দেখতে পাওয়া যাক না কেন ভেতরে ভেতরে দেখবেন অনেক প্রতিশ্রুতিশীল রাজনীতিবিদ এইসব সেলিব্রেটিদের আকষ্মিক আগমনের কারণে অনেকেই রাজনীতি থেকে ঝরে পড়বেন বা রাজনীতি থেকে আস্তে আস্তে দূরে সরে যাবেন। আর এটি দীর্ঘমেয়াদে আমাদের রাজনীতির জন্য খারাপ এবং আওয়ামী লীগের জন্য চরম খারাপ একটি দিক। আওয়ামী লীগ এভাবেই গণবিচ্ছিন্ন সেলিব্রেটিবেইজ রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। এটি আমাদের দেশের জন্য ভালো না; সুতরাং এতে রাজনৈতিক দলেরও ক্ষতি, সেলিব্রেটিদেরও ক্ষতি একইসাথে দেশের জন্য ক্ষতি।
রেডিও তেহরান: তো জনাব মুজিবুর রহমান মঞ্জু রেডিও তেহরানের আলাপন অনুষ্ঠানে আমাদেরকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে আবারও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
মুজিবুর রহমান মঞ্জু: আপনাকেও ধন্যবাদ।#
সাক্ষাৎকারটি উপস্থাপনা ও তৈরি করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।
পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/৯