আদর্শ জীবনযাপন: ধর্মের সাথে দূরত্ব মানসিক অস্থিরতার ওপর প্রভাব ফেলে
মানসিক চাপ কিংবা অস্থিরতা অনেক সময় ব্যক্তির ভেতরে আপনা আপনিই জন্ম নেয় এবং ধীরে ধীরে বাসা বাঁধে। অনেক সময় এই মানসকি অশান্তি এমনভাবে মানব মনে শেকড় গেড়ে বসে যে তার নিরাময় অবশ্যম্ভাবি হয়ে ওঠে। ডাক্তারের কাছে গিয়ে চিকিৎসা নেয়া ছাড়া কোনো বিকল্প থাকে না।
এই মানসিক অশান্তি সৃষ্টি হওয়া এবং তার বিস্তারের নেপথ্য কারণ সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক অনেক ব্যাখ্যা রয়েছে। তারপরও ধর্মীয় একটি বিষয়কে কোনোভাবেই অস্বীকার করার জো নেই। বলা হয়ে থাকে যে ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হওয়া এই মানসিক অস্থিরতা সৃষ্টি ও বৃদ্ধির অনস্বীকার্য একটি নেপথ্য বাস্তবতা। ধর্মের সাথে দূরত্বের বিষয়টি মানসিক অস্থিরতার ওপর প্রভাব ফেলার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বলে মনে করা হচ্ছে।

বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষায় দেখা গেছে মানসিক চাপ ও অস্থিরতায় আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে যারা প্রচলিত ওষুধ সেবন করার পাশাপাশি নামাজ পড়ে, দোয়া করে অর্থাৎ ধর্মীয় ইবাদাতে সময় দেয় তাদের নিরাময় ও সুস্থতার পরিমাণ অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি। যেসব ইমানদার নামাজি এক আল্লাহর অনন্ত শক্তি ও সর্বময় ক্ষমতার পাশাপাশি তাঁর অসীম দয়ার ওপর বিশ্বাস করে এবং মনে করে আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান এবং সর্বজ্ঞ সত্তা ও বিশ্বজাহানের একমাত্র প্রতিপালক তারা আল্লাহর ইবাদাত করার মাধ্যমে মূলত সকল অস্থিরতা ও বিপদাপদের উৎসগুলোর সঙ্গে লড়বার শক্তি অর্জন করে। দৈনিক পাঁচবার নামাজ পড়ার মধ্য দিয়ে সেই নামাজি তার মনের ভেতর এই অশান্তির আক্রমণ থেকে সার্বিক নিরাপত্তা লাভ করে। ফলে সে এক ধরনের প্রশান্তি ও সুস্থিরতা অনুভব করে।
নামাজের মাধ্যমে আমাদের স্রষ্টা ও প্রতিপালক মহান আল্লাহর সাথে সম্পর্কের এক অদৃশ্য সেতু রচিত হবার কথা বলছিলাম। সূরা আ’রাফের ২০৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: “হে নবী! তোমার রবকে সকাল-সাঁঝে মনে মনে কান্নাজড়িত স্বরে ও ভীতি বিহ্বল চিত্তে, অনুচ্চ কণ্ঠে স্মারণ করো! তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না যারা গাফলতির মধ্যে ডুবে আছে।“নামাজ আদায়কারী ব্যক্তিসহ ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত আলেমগণ নামাজ পড়ার জন্য আল্লাহর দেওয়া আদেশকে তাঁর পক্ষ থেকে এক ধরনের করুণা ও রহমত বা দয়া বলে মনে করে থাকেন। মানুষকে তার অভীষ্ট্য লক্ষ্যে পৌঁছার উপায় এবং পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠার অন্যতম সোপান বলে মনে করা হয় এই নামাজকে। তাকবির দিয়ে যখন নামাজ শুরু হয় তখন নামাজ আদায়কারীর অন্তরাত্মা পার্থিব জগতের মোহ ও ব্যস্ততার উর্ধ্বে উঠে গিয়ে এমন এক মহান সত্তার সঙ্গে যোগাযোগ ও সম্পর্ক রচিত হয় যার মর্যাদা পৃথিবীর অন্য সকল শক্তির তুলনায় একেবারেই তুচ্ছ।

নামাজ পড়ার জন্য যখন দাঁড়ানো হয় তখন একজন নামাজির সামনে পার্থিব এই জগতের সকল সম্পদকে নিরর্থক ও তুচ্ছ বলে প্রতীয়মান হয়। শুধুমাত্র অবিনশ্বর এক আল্লাহর কথাই তার অন্তর চক্ষুর সামনে ভাসতে থাকে। কারণ নামাজ আদায়কারী যার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছেন তিনি এমন এক স্রষ্টা ও প্রতিপালক যিনি সবচেয়ে দয়ালু এবং বিজ্ঞ। তিনিই মানুষের সৃষ্টিকারী এবং সাহায্যকারী। এ কারণেই কুরআন মানুষকে আহ্বান জানায় সবসময় যেন সেই খোদাকে স্মরণে রাখে যে খোদাকে স্মরণ করার অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপায় হলো আল্লাহর জিকির বা নামাজ। কেননা এই নামাজ হলো মানুষের অন্তরে প্রশান্তির যথাযথ উৎস। সূরা ত্বাহা’র ১৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: “আমিই আল্লাহ, আমি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, কাজেই তুমি আমার ইবাদত করো এবং আমাকে স্মরণ করার জন্য নামায কায়েম করো”।
সামগ্রিকভাবে বলা যায় নামাজ হচ্ছে ক্লান্ত হৃদয়ের জন্য প্রশান্তির আধার এবং এক আল্লাহর সঙ্গে বান্দার স্থায়ী বা নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ রাখার উপায়। নামাজ পড়ার মধ্য দিয়ে একজন নামাজি মানুষ আল্লাহর প্রশংসায় লিপ্ত হয়। তাঁর বিশ্ব প্রতিপালনের মহত্ব এবং বিশালত্বসহ বিচিত্র সৌন্দর্যের সাক্ষ্য দেয়। অসম্ভব ভদ্রতা, নম্রতা ও বিনয়ের সঙ্গে সর্বশক্তিমান আল্লাহর সকল গুণের কথা ফুটিয়ে তোলা হয়। আল্লাহর এই প্রশংসা ও বিনয়ী প্রার্থনার মধ্য দিয়ে বান্দা তার মানসিক নিরাপত্তা ও আস্থাশীলতা অর্জন করে। প্রার্থনার মাধুর্য তাকে সকল প্রকার ভয় ভীতি, মানসিক অস্থিরতা, বিষন্নতা ইত্যাদি সকল প্রকার অশান্তি থেকে মুক্তি দেয়। অবশ্য যেসব বান্দা আল্লাহর এই মহত্ব, দয়া ও তাঁর সকল সৌন্দর্যের বিষয়টি মনেপ্রাণে উপলব্ধি করেন তাঁরাই মুনাজাতে তাদের সকল বিনয়ী ভাষণ পেশ করতে পারেন। এজন্য অন্তর দিয়ে আল্লাহকে উপলব্ধি করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।

এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের সূরা মুমিনুনের প্রথম দুই আয়াতে বলেছেন: “নিশ্চিতভাবে সফলকাম হয়েছে সেইসব মু’মিনরা, যারা নিজেদের নামাযে বিনয়াবনত হয়”।
যারা ধর্ম কর্ম করেন নামাজ কালাম করেন তাদের অন্তর প্রশান্ত এবং মানসিক চাপ থেকে তারা অনেকটাই মুক্ত। এই বিষয়টি পশ্চিমা গবেষকদের মনে নতুন চিন্তার উদ্রেক ঘটায়। তারা এই ধর্মীয় অনুশীলনগুলোকে মানুষের দুশ্চিন্তা ও মানসিক অশান্তি দূর করার উপায় হিসেবে কাজে লাগানোর চিন্তা করে এবং গবেষণার মধ্য দিয়ে বহু আইডিয়ার প্রকাশ ঘটায়। আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে তারা যেগুলো পেয়েছে সেইসব অর্জন প্রমাণ করে যে বিভিন্ন ধর্মের মাঝে মুসলমানদের মধ্যেই মানসিক প্রশান্তির উপাদান বেশি। আর মুসলমানদের ধর্মীয় ইবাদাতগুলোর মাঝে সবচেয়ে বেশি কার্যকরী ও মানসিক প্রশান্তিদায়ক ইবাদাত হলো নামাজ। এই আইডিয়াটিকে কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞানীরা এখন মানসিক অস্থিরতা দূর করার জন্য ওষুধ দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ব্যায়ামের পরামর্শ দিচ্ছেন।
সম্প্রতি হল্যান্ডের কিছু গবেষক জনগণকে এইসব ব্যায়াম শিক্ষা দেওয়ার জন্য ক্রীড়া সেন্টারে গিয়ে সেগুলো আয়ত্ব করতে অনুপ্রাণিত করেছেন। মজার ব্যাপার হলো ওইসব ক্রীড়া সেন্টারে যে ব্যায়ামগুলো অনুশীলন করানো হয়, প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় সেগুলোর সঙ্গে মুসলমানদের নামাজের মিল রয়েছে। হল্যান্ডের ওইসব ব্যায়ামাগারের প্রশিক্ষকরা বলছেন নামাজের মতো ওই ব্যায়ামগুলো মানুষের শরীরের জন্য খুবই উপকারী। তাঁরা ক্রীড়া সেন্টারগুলোতে সচিত্র ব্যায়ামের ব্যানার লাগিয়ে জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সুস্থ থাকার স্বার্থে তারা যেন নামাজে বসার মতো ওই ব্যায়াম দৈনিক অন্তত তিনবার করে এবং প্রতিবার কমপক্ষে দশ মিনিট ধরে করে। ব্যায়ামগুলো সুন্দর কথাবার্তা কিংবা কবিতা আবৃত্তি করতে করতে যেন করা হয় সে ব্যাপারে তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
দৈনিক অন্তত তিনবার দশ মিনিট করে আবৃত্তি শুনতে শুনতে যে ব্যায়ামগুলো করার জন্য হল্যান্ডের প্রশিক্ষকরা উদ্বুদ্ধ করেছেন সেই ব্যায়ামগুলো হুবহু মুসলমানদের নামাজের মতো। আর আল্লাহ পাক এই নামাজই মুসলমানদের ওপর ফরজ করে দিয়েছেন। এই নামাজ আদায় করা মানুষের আত্মিক ও শারীরিক সুস্থতার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষক হুজ্জাতুল ইসলাম আব্বাস আলি ভশিয়ন বলেছেন: আমাদের ইবাদাতগুলো যেহেতু কেবলমাত্র শারীরিক গুরুত্বের ওপরই সীমাবদ্ধ নয় কিংবা শারীরিক দৃষ্টিকোণ থেকে খুব একটা দেখাও হয় না ইবাদাতগুলোকে, তারপরও ইউরোপীয় গবেষকরা ব্যাপক গবেষণা চালিয়ে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, শারীরিক সুস্থতার ক্ষেত্রে নামাজের একটা ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে এবং নামাজের উপকারিতার দিকটি অনস্বীকার্য।
ইসলামপূর্ব ধর্মগুলো নিয়ে পর্যালোচনা করে দেখা গেছে সেইসব ধর্মের সঙ্গে ইসলামের একটা মিল হলো সিজদা করার মধ্যে। সিজদা করা একান্তই আল্লাহর বন্দেগি বা ইবাদাতের প্রমাণ। তবে তার একটা শারীরিক উপকারিতাও রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে একজন মানুষ যখন সিজদায় অবনত হয় তখন রক্ত চলাচল বেড়ে যাওয়াসহ শরীরের আরও বহু সিস্টেম ভালোভাবে কাজ করে। শরীরের ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদানগুলো নষ্ট হয়ে যায়।
হুজ্জাতুল ইসলাম আব্বাস আলি ভশিয়ন আরও বলেছেন: নামাজের ভেতর জিকির ও দোয়া পড়লে এক আল্লাহর সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করা হয়। আল্লাহর ওপর মানুষের নির্ভরতা বেড়ে যায়। মানসিক অস্থিরতা ও চাপ ন্যূনতম পর্যায়ে নেমে আসে। এমনকি কোনো নামাজি যদি নি:সঙ্গতায় ভোগে এবং নিজের পাশে কাউকে অনুভব করতে চায় রুকু অবস্থায় নিজেকে সে এমন এক মহান সত্ত্বার সামনে উপলব্ধি করে যার চেয়ে বড় আর কেউ নেই। সুতরাং অসম্ভব বিনয়, সম্মান ও আনুগত্যের সাথে একজন নামাজ আদায়কারী নামাজে দাঁড়ায় এমন ভঙ্গিতে যেন সেই মহান সত্তার সঙ্গে স্বতস্ফূর্তভাবে এমনসব কথা বলছে যেই আলাপ অন্য কারো করা হয় না।
সম্ভবত এ কারণেই নবী রাসুল কিংবা ইমামগণ সবসময়ই নামাজের ব্যাপারে ছিলেন অসম্ভব সচেতন এবং নিজেদের উন্নয়ন ও অগ্রগতির সোপান মনে করতেন নামাজকে। ইসলামের মহান রাসুল (সা) নামাজকে তাঁর চোখের নূর বলে অভিহিত করেছেন। হযরত আলি (আ) নামাজের মাধ্যমে তাঁর অন্তরকে আলোকিত করেছেন এবং নামাজরত অবস্থায় শাহাদাত বরণ করেছেন।#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/৬