জুলাই ০২, ২০১৭ ১৮:৩৯ Asia/Dhaka
  • মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি-৩

গত আসরে আমরা ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে সভ্যতার পতনের নানা কারণ এবং বর্তমান পশ্চিমা সভ্যতার অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করেছি। এছাড়া, মুসলিম সভ্যতা নানা প্রতিকূলতার মাঝেও কীভাবে টিকে থাকলো সে বিষয়টিও আমরা তুলে ধরেছি। আমরা বলেছি, বর্তমান পশ্চিমা সভ্যতা হিউম্যানিজম, লিবারেলিজম ও সেক্যুলারিজম এই তিন মতবাদের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে এবং এসব মতবাদে ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতাকে গুরুত্ব দেয়া হয়না।

যাইহোক, আজকের আসরে আমরা মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতি গঠনে নবী-রাসূলদের ভূমিকা বিশেষকরে বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)'র ভূমিকা নিয়ে খানিকটা আলোচনা করবো।

মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতি গঠনে নবী-রাসূলরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। নবী-রাসূলগণ যুগে যুগে মানব জাতিকে সৎ পথের দিকে আহ্বানের গুরু দায়িত্ব পালন করেছেন। আল্লাহতায়ালা সূরা নাহ্‌লের ৩৬ নম্বর আয়াতে সমাজে নবী-রাসূল পাঠানোর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছেন, "আমি প্রত্যেক জাতির মধ্যে রাসূল পাঠিয়েছি। তোমরা আল্লাহর উপাসনা করো এবং শয়তানকে বর্জন করো।" বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)'র আগেও আল্লাহতায়ালা পবিত্র মক্কা শহরে কয়েক জন নবী পাঠিয়েছেন। ইব্রাহিম (আ:) তাদের মধ্যে অন্যতম। ইব্রাহিম (আ:)'র আর্বিভাবের পর আরবদের কেউ কেউ একত্ববাদের ধর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য ইব্রাহিম (আ:)'র ইন্তেকালের পর অধিকাংশ আরব এই একত্ববাদী ধর্মের সাথে মূর্তিপূজার কুসংস্কার ও বিশ্বাসের মিশ্রন ঘটায়। অধিকাংশ ঐতিহাসিক মনে করেন, ইব্রাহিম (আ:)'র সময় থেকে শুরু করে ইসলাম ধর্মের আর্বিভাবের আগ পর্যন্ত বেশিরভাগ আরবই ইব্রাহিম (আ:)'র ধর্মের কিছু রীতি নীতি মেনে চলার পাশাপাশি মূর্তি পুজাও করতো। তবে আরবদের মধ্যে এমন কিছু মানুষও ছিলেন যারা মূর্তিপুজা করতেন না এবং মানুষকে মূর্তি পুজা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাতেন। যারা মূর্তিপুজা না করে ইব্রাহিম (আ:)'র ধর্মের প্রতি অটল ছিলেন,তাদের মধ্যে আব্দুল মোত্তালেব অন্যতম।

বিষয়টি আরো স্পষ্ট করার জন্য আরব ভূখন্ডের ইতিহাস নিয়ে খানিকটা আলোচনা করা যাক। ঐতিহাসিকরা আরব ইতিহাসকে তিন ভাগে বিভক্ত করে থাকেন। প্রথমত: জাহিলিয়াতপূর্ব প্রাচীন যুগ, দ্বিতীয়ত: জাহিলিয়াত যুগ এবং জাহিলিয়াত পরবর্তী যুগ। ইসলাম আর্বিভাবের পর জাহিলিয়াত বা অজ্ঞতা যুগের পরিসমাপ্তি ঘটে। শুরু হয় ইসলামি যুগ এবং এখনো তা অব্যাহত রয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য জাতির মতো আরবরাও ইসলামপূর্ব যুগে কবিতা ও সাহিত্যের মতো কোন কোন ক্ষেত্রে পান্ডিত্যের অধিকারী ছিলো। শুধু বিশেষ মহলেই নয় কবিতা ও সাহিত্যের প্রতি সাধারণ মানুষজনেরও ব্যাপক ঝোঁক ছিলো। বেদুঈন আরবরা নতুন নতুন কবিতা শুনতে কবিদের কাছে আসতেন এবং একসঙ্গে বসে কবিতা আবৃত্তি শুনতেন।

আরবের বাজারগুলোতেই কবি ও শ্রোতাদের বেশি সমাগম ঘটতো। সে সময় যে গোত্রে শক্তিমান ও সৃষ্টিশীল কবির জন্ম হতো সে গোত্রের মানুষ ওই কবিকে নিয়ে গর্ব করতো এবং তার জন্য সম্মানসূচক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো। জাহেলি যুগে একজন কবি ইচ্ছে করলেই একজন সাধারণ মানুষকেও প্রশংসার মাধ্যমে সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বে রূপান্তরিত করতে পারতেন এবং একজন সম্মানী ব্যক্তিকে ব্যঙ্গ করে অথবা তার বিষয়ে দূর্নাম রটিয়ে তাকে অপমান করতে পারতেন। কবির ইশারায় একজন সম্মানী ব্যক্তিও সমাজে তুচ্ছ ব্যক্তিতে পরিণত হতেন। জাহেলি পরিবেশ কবিদের ওপরও প্রভাব ফেলেছিল। সে সময়কার বেশিরভাগ আরব কবিতায় তৎকালীন সমাজের মানুষের জীবনপ্রণালীর চিত্র অংকিত হয়েছে। কবিতাগুলোতে আরব মরুপ্রান্তর, তাবু, তলোয়ার, নানা ধরনের খেলা, মানুষের চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য, নীতি-নৈতিকতা এবং আচার-আচরণ চিত্রায়িত হয়েছে। ইসলামপূর্ব যুগকে জাহেলি যুগ বলা হয়, কারণ সে সময় সমাজে অজ্ঞতা ও বর্বরতা প্রাধান্য বিস্তার করেছিলো। আরব উপদ্বীপে কোন আইন-কানুন ও রীতি-নীতি ছিলো না। এছাড়া, আরবে তখন কোন নবী-রাসূলও ছিলেন না যারা আল্লাহর নির্দেশে মানুষকে সৎ পথে পরিচালিত করতে পারেন। কারণ বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)'র আবির্ভাবের আগে দীর্ঘ দিন পর্যন্ত আরবে কোন নবী-রাসূল আসেননি। এছাড়া, আরব উপদ্বীপের উত্তরের বেশিরভাগ অঞ্চল বিশেষকরে হিজায অঞ্চলটি ছিলো শুষ্ক ও রুক্ষ এবং ইসলামপূর্ব যুগে বেশিরভাগ আরবের বাস ছিলো মরু এলাকায়। মরু অঞ্চলের মানুষজন পানির সন্ধানে একেক সময় একেক দিকে ছুটে যেতেন। এ অবস্থা তাদের মধ্যে বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্ম দিয়েছিলো। কঠিন ও রুক্ষ পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণে অনেকেই তাদের মানবিক বৈশিষ্ট্যগুলো ভুলে গিয়েছিল।

এ কারণে সে সময়ের ইতিহাস যুদ্ধের নানা ঘটনায় ভরপুর। বিভিন্ন গোত্র ও গোষ্ঠীর মধ্যে পশু ও চারণভূমির আধিপত্য নিয়ে যুদ্ধ হতো এবং একে অপরের এলাকায় লুটতরাজ চালাতো। গোত্রপ্রীতি ও কুসংস্কার ছিলো সে সময়ের আরবদের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। তারা সামান্য কারণে বড় বড় যুদ্ধের জন্ম দিতো,যা কখনো কখনো বছরের পর বছর ধরে চলতো। জাহেলি যুগের আরবরা নারীদের কোন গুরুত্বই দিতো না। নারীরা মানুষ হিসেবেই গণ্য হতো না। তারা কন্যা সন্তানকে অপমানের বোঝা বলে মনে করতো। কখনো কখনো এই অপমান থেকে রক্ষা পেতে কন্যা শিশুদের জীবন্ত কবর দিতো। উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারীদের অধিকারকে তারা অস্বীকার করতো। এমনকি স্বয়ং নারীদেরকেই উত্তরাধিকার সম্পত্তি ও পণ্য বলে গণ্য করতো।

পবিত্র কোরআনের সূরা নাহলের ৫৮ ও ৫৯ নম্বর আয়াতে সে সময়কার নারীদের অবস্থা সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ওদের কাউকে যখন কন্যা-সন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয়, তখন তার মুখমন্ডল কালো হয়ে যায় এবং ব্যাপক ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। তাকে যে সুসংবাদ দেয়া হয়েছে,তার কারণে সে নিজ গোত্র অথবা সম্প্রদায়ের কাছ থেকে আত্মগোপন করে এবং সে এটা ভাবতে থাকে যে, এই অপমানের পর নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবে না কি নিজেকে মাটিতে পুঁতে ফেলবে? বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এমন এক সময় জন্মগ্রহণ করেন,যখন আরবের মানুষ অজ্ঞতা ও কুসংস্কারে পুরোপুরি নিমজ্জিত। তিনি এ ধরনের একটি সমাজ থেকে সারা বিশ্বের মানুষের কাছে কল্যাণের বার্তা পৌছেঁ দেয়ার দায়িত্ব পান। এখানে উল্লেখ্য, সে সময়কার বিশ্ব রাজনীতিতে আরবদের কোন গুরুত্বই ছিলো না, কোন অবস্থানই ছিলোনা। কিন্তু বিশ্বনবী, তাঁর মিশন এবং তার শিক্ষা দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে আরব ভূখন্ডে ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা করেন।

নবীজীর পথনির্দেশনায় মানুষের চিন্তা-চেতনা, বিশ্বাস, সংস্কৃতি ও সভ্যতায় এক বিপ্লব সংঘটিত হয়। রাসূল (সা.) নব্যুওয়ত লাভের পর ১৩ বছর মক্কায় ইসলামের মূল নীতি ও শিক্ষা প্রচার করেন। কিন্তু রাসূল(সা.) মক্কায় অবস্থানকালে নানা কারণে ইসলামি রাষ্ট্র ও সভ্যতা প্রতিষ্ঠার পরিবেশ তৈরী করা সম্ভব হয়নি। হয়তো এর বড় কারণ ছিলো, মক্কার গোত্র ও গোষ্ঠি ভিত্তিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা। গোত্রভিত্তিক রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে ব্যাপক বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শেষ পর্যন্ত বিশ্বনবী (সাঃ) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন। মক্কার রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পদমর্যাদা ও সম্মান কখনোই যোগ্যতা ও সাহসিকতার ভিত্তিতে ছিল না বরং কে কোন গোত্রের ও কোন বংশের তার ভিত্তিতেই ব্যক্তির মর্যাদা নির্ধারিত হতো। এছাড়া, মক্কার ভৌগলিক অবস্থানও বিশ্বে প্রথম ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য উপযোগী ছিলো না। কিন্তু মদিনায় হিজরতের পর রাসূল (সা.) সেই উপযুক্ত পরিবেশ পান।