মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি-৪
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) সর্বশেষ ঐশী ধর্ম তথা ইসলাম ধর্ম প্রচারের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। তিনি ১৩ বছর ধরে মক্কা অঞ্চলে ইসলামের বাণী জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য সব ধরনের প্রচেষ্টা চালান।
কিন্তু অল্প সংখ্যক মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। এ ছাড়াও শত্রু দের ব্যাপক বিদ্বেষী আচরণের কারণে তিনি সেখানে অনুকূল পরিবেশে ইসলাম ধর্ম প্রচার ও প্রসারের সুযোগ পাননি। ফলে (সাঃ) মক্কা থেকে মদীনায় মুসলমানদের হিজরত বা অভিবাসন শুরু হয়।
মদীনা বা ইয়াসরিব ছিল ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য নিরাপদ স্থান। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এ বিষয়টি বুঝতে পেরে মুসলমানদেরকে মদীনায় হিজরত করতে বলেন। নবী হিসেবে দায়িত্ব লাভের ১৪তম বছরের ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার অথবা এর সামান্য কিছু আগে বা পরে রাসূল (সাঃ) মদীনায় প্রবেশ করেন। মক্কা থেকে মদীনার উপকণ্ঠে ক্বুবা নামক স্থানে আসতে তাঁর সময় লেগেছিল নয় দিন। ক্বুবায় তিনি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য অবস্থান করেন। এ সময় সেখানে নির্মিত হয়েছিল ইসলামের ইতিহাসের প্রথম মসজিদ। কয়েকদিন পর মক্কা থেকে মহানবী (সাঃ)'র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য হযরত আলীও রাসূল (সাঃ)''র সাথে মিলিত হন। এরপর তাঁরা একইসাথে মদীনায় প্রবেশ করেন।
ইয়াসরেব বা মদীনা ছিল দুটি বড় ইহুদি গোত্রের সম্মিলন-স্থল। এ ছাড়াও কয়েকটি মোহাজির গোত্র এ অঞ্চলে বসবাস করত। আওস ও খাজরাজ ছিল এসব মোহাজির গোত্রের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গোত্র। এসব গোত্রের আবাসস্থল হবার কারণে মদীনার লোকজনের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ে এক ধরনের নির্লিপ্ত ভাব বা নিস্ক্রিয়তা দেখা যেত। ফলে এখানে নতুন ধর্ম বিকশিত হবার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। এ জন্যই মক্কার তুলনায় মদীনা বা ইয়াসরেব শহরে ইসলাম ধর্ম বিকশিত হবার পথ বেশী উন্মোচিত হয়েছিল। এখানকার অ-ইহুদি আরব গোত্রগুলো ইহুদিদের কাছ থেকে আল্লাহ, ওহী বা ঐশী প্রত্যাদেশ, বিচার বা পুনরুত্থান দিবস, বেহশত ও দোযখ প্রভৃতি বিষয়ে ধারণা পেয়েছিল। এ ছাড়াও পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত আওস ও খাজরাজ গোত্র ইসলাম ধর্ম গ্রহণের মাধ্যমে নতুন মিত্র শক্তির বলে পরস্পরের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের সূবর্ণ সুযোগকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে। তাই দেখা যায় এ দুটি গোত্র কেবল একে-অপরের আগে নয়, এমনকি ইহুদিদেরও আগে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্য এগিয়ে আসে।
মদীনায় বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)''র প্রবেশের দিনটি ছিল শুক্রবার। তাঁর ইমামতিতে সেদিনই প্রথম জুমার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। জুমার নামাজের খোতবায় মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসা জ্ঞাপনের পর তিনি জনগণকে খোদাভীতি বা তাক্বওয়া অর্জন, সৎ কর্ম ও আল্লাহর পথে জিহাদের আহ্বান জানান। জুমার নামাজ আদায়ের পর তিনি শহরের ভেতরে প্রবেশ করেন। মদীনার জনগণ তাঁকে বিপুল সম্বর্ধনা জানায়। এ সময় থেকে রাসূল (সাঃ)'র সাহাবায়ে কেরাম মুহাজির ও আনসার হিসেবে পরিচিত হন। যারা মক্কা থেকে হিজরত করে ইয়াসরেবে আসেন তাদের বলা হত মুহাজির। আর মদীনার স্থানীয় সাহাবীদের বলা হত আনসার বা সাহায্যকারী। ইয়াসরেবে মহানবী (সাঃ)'র আগমনের সুবাদে এই শহরের নাম রাখা হয় মদীনাতুননবী বা রাসূলের শহর ।
এভাবে দেখা যায়, ইসলাম ধর্ম মক্কায় যাত্রা শুরু করলেও মদীনা হয়ে পড়ে এ ধর্ম বিকাশের উপযুক্ত ক্ষেত্র। মদীনায় জনগণ দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। মুসলমানদের সংখ্যা দর্শনীয়ভাবে বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বনবী (সাঃ) একটি ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। এই সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার তিনটি ভিত্তি ছিল। মসজিদ নির্মাণ, মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং মুসলমান ও অমুসলমানদের মধ্যে সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর।
এভাবে মহানবী (সাঃ) আরবদের মধ্যে শত শত বছর ধরে প্রচলিত জাহেলী যুগের গোত্রীয় বিদ্বেষের অবসান ঘটান। ইসলামী সমাজ বা উম্মাহ গঠনে তাঁর প্রচেষ্টার ফলে ধর্মই মানুষের মধ্যে সম্পর্ক ও বন্ধন বা যোগাযোগের প্রধান মাধ্যমে পরিণত হয়। গোত্রীয় বন্ধনের যে ধারা আরবদের মধ্যে জাহেলিয়াত বা কুসংস্কার ও গোত্রীয় নানা কূ-প্রথা সৃষ্টি করেছিল তা ইসলামী সমাজ গঠনের ফলে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এভাবে জাহেলী চিন্তা-চেতনার অবসান ঘটায় মদীনার মুসলমানরা ইসলাম প্রচারের জন্য প্রস্তুত হয়।
বিভিন্ন সাক্ষ্য-প্রমাণের আলোকে বলা যায়, হিজরতের প্রথম দিন থেকেই সভ্যতা গড়ে তোলার লক্ষণগুলো ইসলামে স্পষ্ট হয়ে উঠে। মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের মাধ্যমে মুসলমানদের একটি রাজনৈতিক সমাজ বা রাষ্ট্র গড়ে উঠে। এভাবে মহানবী (সাঃ)''র ওয়াদা বাস্তবে রূপ নেয়। মদীনায় মুসলমান ও অমুসলমানদের মধ্যে সহযোগিতার চুক্তি স্বাক্ষর ছিল তৎকালীন ইসলামী রাষ্ট্রের সংবিধানের অন্যতম ভিত্তি। এই সংবিধানের মাধ্যমে নাগরিকদের সামাজিক অধিকারগুলোকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এমনকি এতে ইহুদিদের নাগরিক ও সামজিক অধিকারকেও স্বীকৃতি দেয়া হয়। এই সংবিধান অনুযায়ী মুসলমানরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নীতি নির্ধারণের ক্ষমতা লাভ করে। এভাবে হিজরতের সুবাদে ইসলাম ধর্মের ভিত্তিতে সামাজিক ন্যায়বিচার ও জনমত বা জন সমর্থনের আলোকে একটি রাষ্ট্র গড়ে উঠে এবং ইসলামী চিন্তাধারা বাস্তবায়নের পথ সূচিত হয়। মক্কায় বিশ্বনবী (সাঃ) ছিলেন একজন সাধারণ নাগরিক, কিন্তু মদীনায় তিনিই হন প্রথম ইসলামী সরকারের প্রধান দায়িত্বশীল।
মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্রের ছিল ভৌগোলিক সীমানা ও অঞ্চল বা ভূখণ্ড, জনগণ, সার্বভৌমত্ব বা স্বাধীনতা ও প্রশাসন। এ ছাড়াও ছিল আইনের শাসন। অন্য কথায় সে রাষ্ট্রে আইনের দৃষ্টিতে ছিল সবাই সমান। কারো ব্যাপারে কোনো বৈষম্য ছিল না। সে যুগে এমন ব্যবস্থা ছিল নজিরবিহীন। তাই তা সব যুগের জন্য আদর্শে পরিণত হয়। দেখা গেছে সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে মুসলিম জাহানের খলিফা আমীরুল মুমিনিন হযরত আলী (আঃ) আদালতে তাঁর অধিকার ত্যাগ করেছেন। বিবাদী ইহুদি খলিফার মনোনীত কাজীর এ ধরনের অবিশ্বাস্য রায়ে ও রায়ের প্রতি খলিফার শ্রদ্ধায় বিমুগ্ধ হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন।
মদীনা সনদ প্রণয়ন ছিল বিশ্বনবী (সাঃ)''র ইসলামী রাষ্ট্রের আরেক মহান কীর্তি। এতে নাগরিকদের পারস্পরিক সম্পর্ক ও অধিকারের সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এরই আলোকে সব কিছু ত্যাগ করে কেবল ঈমান নিয়ে আসা মুহাজিরদের নিরাপত্তা বিধান ও সহায়-সম্পদের ক্ষেত্রে আনসারদের সহযোগীতা ছিল অকল্পনীয়। মদীনার স্থানীয় ও বহিরাগত মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন তৈরি করে দেয়া ছিল মহানবী (সাঃ)র এক বড় সাফল্য। এর আগে সম্পর্কের মাপকাঠি ছিল গোত্রীয় পরিচয়। ফলে ইসলামী রাষ্ট্রের মুমিনদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল সীসা ঢালা প্রাচীরের মত দৃঢ় ঐক্য।