জুলাই ০৫, ২০১৭ ২০:৪৯ Asia/Dhaka
  • মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি-৬

পাঠক! গত আসরে আমরা বলেছিলাম পয়গাম্বর (সা) মদিনায় ইসলামী শাসন ব্যবস্থা পরিচালনায় কীভাবে প্রশাসনিক, সামরিক, বিচারিক প্রভৃতি বিভাগ চালু করেছেন এবং ধীরে ধীরে ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতি কীভাবে বিকাশ লাভ করে। আজকের আসরে আমরা তারই ধারাবাহিকতায় আরো কিছু কথা বলার চেষ্টা করবো।

জ্ঞান এবং প্রজ্ঞা এমন একটি অনুষঙ্গ যা ইসলামী শিক্ষা-দীক্ষার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একথা বলাটা বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না যে ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্মেই জ্ঞানার্জনের ব্যাপারে এতো বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি। কোরআন এবং হাদিসের প্রতি দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এবং ধর্মীয় ব্যক্তিত্ববর্গ বা অলি-আওলিয়াগণ কেবল মুসলমানদেরকেই নন বরং অন্যান্য ধর্মের অনুসারীসহ সকল মানুষকেই জ্ঞান ও প্রজ্ঞা অর্জনের দিকে আহ্বান জানিয়েছেন। অন্ধবিশ্বাসী ঈমান অর্থাৎ জ্ঞান-প্রজ্ঞাবিহীন ঈমান আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য নয়। জ্ঞান-বুদ্ধি এমন এক উপাদান যা আমাদেরকে আল্লাহকে চেনার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে। আসলে আল্লাহকে চেনার এবং আল্লাহর একত্বকে উপলব্ধি করার গুরুত্বপূর্ণ উপায়গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো জ্ঞান এবং প্রজ্ঞা। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সূরা আম্বিয়ার ৬৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো খোদার প্রতি বিশ্বাস রাখা জ্ঞান ও প্রজ্ঞা থেকে দূরে সরে যাবার লক্ষণ বলে ইঙ্গিত করে বলেছেন, "তোমাদের এবং তোমরা আল্লাহ ব্যতিত যাদের উপাসনা করো তাদের ওপর ধিক্কার! আচ্ছা,তোমরা কি চিন্তা করো না! ( অর্থাৎ তোমাদের কি জ্ঞান-বুদ্ধি নেই?)"

ইসলাম মূর্খ লোকদেরকে ভৎর্সনা করে। মূর্খতা মানে কেবল অশিক্ষা নয়। আমরা এমন অনেক জ্ঞানী-গুণী লোককেও দেখতে পাই যারা সত্যের ব্যাপারে অন্ধ এবং অজ্ঞ। তারা আসলে শিক্ষিত বটে কিন্তু এ অর্থে যে,তারা বাইরের জগত সম্পর্কেই বেশি জানে,তাদের স্মৃতিটা জ্ঞাত বিষয়সমূহের একটি ভাণ্ডার ছাড়া আর কিছুই নয়। জীবনের মৌলিক বিষয়-আশয় সম্পর্কে তারা চিন্তা-ভাবনা করে না বলে সঠিক পথের সন্ধান পায় না। মানবেতিহাস পরিক্রমায় দেখা গেছে দ্বীন এবং জ্ঞানকে যারা সাংঘর্ষিক দৃষ্টিতে দেখেছেন পরবর্তীকালে ইসলামে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সু-উচ্চ অবস্থান দেখে তারা হতবাক হয়ে গেছেন। ঐশী এই ধর্মের ইতিহাসে তো নয়ই এমনকি ইসলামী চিন্তা-চেতনা বা কর্মতৎপরতায়ও জ্ঞান এবং আধ্যাত্মিকতার মাঝে কোনোরকম দ্বন্দ্ব পরিলক্ষিত হয় না। জাবের ইবনে হাইয়্যান, মুহাম্মাদ্ইবনে মূসা খাওয়ারেযমি, মুহাম্মাদ ইবনে যাকারিয়া রাযি, ফারাবি, ইবনে হিশাম, ইবনে সিনা, ইবনে রুশদ প্রমুখের মতো আরো বহু মুসলিম মনীষীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা লাভই প্রমাণ করে যে ইসলাম জ্ঞান এবং প্রজ্ঞার মাঝে গভীর সমন্বয়ের পক্ষপাতী।

ইসলামে সবসময়ই জ্ঞান-প্রজ্ঞা এবং আধ্যাত্মিকতার সমন্বিত কল্যাণের প্রতি মনযোগ আকর্ষণ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনের সর্বপ্রথম যে সূরাটি নাযিল হয়েছে তার প্রাথমিক আয়াতগুলোতেও জ্ঞানার্জনের প্রতি ব্যাপক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছেঃ "পড়ো তোমার প্রভুর নামে যিনি এই বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জমাট রক্ত থেকে। পড়ো সেই প্রভুর নামে যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ ও মহাদয়ালু। যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন সেইসব-যা সে জানতো না। "

কোরআনের সর্বপ্রথম এই আয়াতগুলো নাযিল হবার সময়কালের প্রতি একটু মনোযোগী হলে আয়াতগুলোর গুরুত্ব উপলব্ধি করা যাবে। যখন এই আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয় সে সময় মক্কা এবং হেজাজে লিখতে পড়তে জানা লোকের সংখ্যা একর্থে ছিল না বললেই চলে। যৎসামান্য পড়তে জানা বা লিখতে জানা লোকের সংখ্যা সমগ্র মক্কায় ছিলো বিশ জনেরও কম। অথচ সে সময় মক্কা ছিলো হেজাজের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং ইবাদাত-উপাসনার মূল কেন্দ্র। এরকম পরিস্থিতিতে পড়ালেখার ব্যাপারে প্রত্যয় ঘোষণা করা থেকে উপলব্ধি করা যায় যে ইসলামের দৃষ্টিতে জ্ঞানার্জন এবং প্রজ্ঞা লাভের কতো বেশি গুরুত্ব রয়েছে।

তদুপরি রাসূলে খোদা (সা) জ্ঞানার্জনকে সবার জন্যে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন। মদিনায় তিনি চেষ্টা করেছেন জ্ঞান বা শিক্ষা বিস্তারের সুযোগ সুবিধাগুলোকে সবার জন্যে সমানভাবে উন্মুক্ত করে দিতে। যাতে সর্বশ্রেণীর মানুষই আল্লাহ প্রদত্ত মেধার বিকাশ ঘটিয়ে নিজেদের যোগ্যতা অনুযায়ী জ্ঞানী হয়ে উঠতে পারে। বদর যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় লাভের পর মুশরিকদের একটি দলকে বন্দী করে নিয়ে আসা হয়। বন্দীদের মাঝে কতিপয় শিক্ষিতও ছিলেন। নবীজী ঘোষণা করেছিলেন বন্দীগণ দশজন মুসলমানকে পড়ালেখা শেখানোর বিনিময়ে মুক্তি পেতে পারে। নবীজীর এই পদক্ষেপের ফলে বহু মুসলমান পড়ালেখা শেখার সুযোগ পায়। যায়েদ ইবনে সাবেত ছিলেন বন্দীদের মাধ্যমে শিক্ষা লাভকারীদের একজন। এভাবে তৎকালীন সমাজে জ্ঞানার্জনের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবও পড়েছিলো।

ইতিহাসের দিকে তাকালে লক্ষ্য করা যাবে, ইসলামী সভ্যতার যুগে মুসলিম বিশ্বে বিচিত্র জ্ঞানের প্রসার লাভ ঘটেছিলো। মুসলমানরা কেবল ইসলামী জ্ঞান বা আধ্যাত্মিক জ্ঞানই নয় বরং সাধারণ জ্ঞানের বিভিন্ন শাখারও গোড়াপত্তন করেন অর্থাৎ জ্ঞান ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় মুসলমানদের মাধ্যমেই সৃষ্ট এবং বিকশিত হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এসব বিষয়ে পাঠ দান করা হতো। ধর্মীয় এবং জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা কেন্দ্রগুলোতে বড়ো বড়ো গ্রন্থাগারও স্থাপিত হয়েছিলো। জ্ঞানের চর্চা এবং ধর্মীয় শিক্ষা-দীক্ষা তখন সমন্বিতভাবে অগ্রসর হয়েছিলো। অধ্যাপক আয়াতুল্লাহ মুর্তজা মোতাহহারি (রহ) জ্ঞান এবং বিশ্বাস সংক্রান্ত বিতর্কে খ্রিষ্টিয় দৃষ্টিভঙ্গির ভ্রান্তির প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন, খ্রিষ্টিয় এই ভুল চিন্তা বা দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ইউরোপীয় সভ্যতার ইতিহাসে ঈমান এবং জ্ঞান আলাদা হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু ইসলামের ইতিহাসে জ্ঞান এবং বিশ্বাস সবসময় পরস্পরের পরিপূরক ছিলো-চাই বিকাশের সময়ই হোক কিংবা অবক্ষয়ের যুগে। তাঁর মতে জ্ঞান এবং ঈমান সমন্বিতভাবে মানুষকে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এভাবে কোরআনের বিভিন্ন স্থানে জ্ঞানার্জনের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে আয়াত নাযিল হয়েছে। কোরআনে বিভিন্ন প্রসঙ্গে জ্ঞান শব্দটি অন্তত আশি বার এসেছে।

জ্ঞানের গুরুত্ব সম্পর্কে একটি হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে পরিসমাপ্তি টানবো আজকের আলোচনা। একদিন রাসূলের সাহাবিদেরই একজন নবীজীর কাছে জানতে চাইলেনঃ হে রাসূলে খোদা! মৃত ব্যক্তির লাশ দাফন অনুষ্ঠান আর জ্ঞানীর আসর-এ দুয়ের মধ্যে কোন্‌টি আপনার কাছে বেশি প্রিয়? নবীজী জবাবে বললেনঃ লাশ দাফন করার জন্যে যদি কেউ থাকে তাহলে একজন আলেমের মজলিসে উপস্থিত হওয়াটা এক হাজার লাশ দাফন, হাজার রোগী দেখতে যাওয়া, হাজার রাত্রি ইবাদাত করা, হাজার দিন রোযা রাখা, ফকির মিসকিনদেরকে হাজার দিরহাম সদকা দেওয়া, হাজার বার হজ্জ্ব করা এবং হাজার বার জান্এবং মাল দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করার চেয়ে উত্তম। তোমরা কি জানো না কেবল জ্ঞানের মাধ্যমেই আল্লাহর ইবাদাত বা আনুগত্য করা যায়? দুনিয়া এবং আখেরাতের কল্যাণ নিহিত রয়েছে জ্ঞানের মধ্যে আর দুনিয়া এবং আখেরাতের অমঙ্গল নিহিত রয়েছে মূর্খতার মধ্যে।#