মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি-৭
মুসলিম সভ্যতা বিকাশের প্রসঙ্গ এলেই ভাষা লিপিবদ্ধ করার ইতিহাস এবং লেখ্য রূপের সাথে মুসলমানদের পরিচিত হওয়ার বিষয়টিও সামনে চলে আসে। কাগজ আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে কোন কিছু লিখে রাখার বিষয়টি অনেক সহজসাধ্য হয়।
কোন কোন প্রাচ্যবিদের মতে, কাগজ আবিস্কৃত না হলে মুসলমানদের প্রাথমিক যুগের সংস্কৃতি এত বেশি বিস্তার ও সমৃদ্ধি লাভ করতে পারতো না। আজকের পর্বে আমরা ভাষার লেখ্য রূপের বিস্তার এবং ইসলামি সভ্যতায় এর প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করবো।
ইসলাম আবির্ভাবের পর এই ধর্মের সুস্পষ্ট বার্তা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বড় ধরনের পরিবর্তন আনে। ভাষার লেখ্য রূপ এই বার্তা ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আরবি ভাষার লেখ্য রূপের ইতিহাসের একটা বড় অংশই পবিত্র কোরানের সাথে সম্পর্কিত। মুসলমানদের সাংস্কৃতিক বন্ধন সুদৃঢ় রাখার ক্ষেত্রেও ভাষার লেখ্য রূপ এবং লেখার ধরণ অনস্বীকার্য ভূমিকা রেখেছে। এ কারণে মুসলমানরা যে দেশ, জাতি ও ভাষারই হোক না কেন, ঐশী গ্রন্থ কোরআনকে অভিন্ন ভাষা ও স্টাইলে তেলাওয়াত করে থাকে। মুসলমানদের মধ্যে যে সাংস্কৃতিক বন্ধন সুদৃঢ়, এটি তারই প্রমাণ।
ঐতিহাসিক তথ্য-প্রমাণ অনুযায়ী, জাহেলি যুগে খুব অল্প সংখ্যক আরব, ভাষার লেখ্য রূপ সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। কারণ সে সময় আরব অঞ্চলের মানুষের জীবন-ব্যবস্থাই এমন ছিলো যে, তারা কোন কিছু লিখে রাখার প্রয়োজনবোধ করতো না। ওই সময় আরব সমাজে মূলত ভাষার শ্রুতি রূপটিই চালু ছিলো। বিভিন্ন গোত্র ও গোষ্ঠীগুলোর গর্ব করার মতো বিষয়গুলো তা কবিতাই হোক আর গল্পই হোক,তা মৌখিক পরম্পরায় উত্তরসূরিদের কাছে পৌঁছে যেতো। তবে পুরনো যে সব কবিতা পাথরে খোদাই করা অবস্থায় ছিলো, সেসব থেকে লেখ্য রূপ ও লেখার সরঞ্জামগুলোর ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। বলা হয়, অতীতে ওই এলাকায় যে লিপি চালু ছিলো, তা ছিলো অনেকটাই নাবাতি লিপির মতো। মুসলিম গবেষক ও গ্রন্থ বিশেষজ্ঞ ইবনে নাদিম তার ‘আল ফেহরেস্ত' গ্রন্থে মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর দাদা আব্দুল মোত্তালিবের হস্তলিপির কথা উল্লেখ করেছেন। আব্বাসীয় খলিফা মামুনের কোষাগারে ওই লিপি সংরক্ষণ করা হতো।
ইসলাম আবির্ভাবের পরপরই কেরানের যে ক্ষুদ্র অংশ লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল, তা থেকেও প্রমাণিত হয়, ইসলামের প্রাথমিক যুগে লেখ্য রূপ বা লিপির সাথে আরবদের প্রাথমিক একটা পরিচিতি ছিলো। পবিত্র কোরানে মুসলমানদেরকে লেনদেনের বিষয়টি লিখে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহতায়ালা সূরা বাকারার ২৮২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ""হে বিশ্বাসিগণ, যখন একে অন্যের সাথে কোন নির্দিষ্টকালের জন্য ধারের আদান-প্রদান করবে, তখন তা লিখে রাখো এবং তোমাদের মধ্যে কোন লেখক যেন তা ন্যায়ভাবে লিখে দেয়"।" ওই আয়াত অনুযায়ী, মুসলমানদের দায়িত্ব হলো, আর্থ-বাণিজ্যিক সম্পর্ককে লিখিত ও দালিলিক রূপ দেয়া। রাসূলের হাদিসে বিভিন্ন বিষয় লিখে রাখতে বলা হয়েছে। রাসূল (সা.) বলেছেন, তোমার জ্ঞান ও শিক্ষা লিপিবদ্ধ করো। রাসূল (সা.)'র কয়েক জন বিশেষ কাতেব বা লিপিকার ছিলেন, যারা কোরানের আয়াত লিখে রাখতেন এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় চুক্তি ও চিঠিপত্র লিখতেন। পবিত্র কোরানের ওহী যারা লিখে রাখতেন,তাদের মধ্যে হযরত আলী (আ.)''র ছিলেন অন্যতম।
আরবে যেহেতু চামড়ার দাম ছিলো চড়া, সে কারণে কাতেব বা লিপিকাররা তা নিয়মিত ও ব্যাপক ভাবে ব্যবহার করতে পারতো না। ইতিহাসেও এসেছে, আব্দুল মোত্তালেবও সে সময় চামড়ায় লিখতেন। চামড়ার স্থায়ীত্ব যেহেতু বেশি, সে কারণে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি লিখে রাখার ক্ষেত্রে তা ব্যবহৃত হতো। চামড়ায় লেখার গুরুত্ব, বনী আব্বাসীয়দের শাসনামলের মাঝ সময় পর্যন্ত অব্যাহত ছিলো। বিভিন্ন চুক্তি, গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ ও চিঠিপত্র চামড়ায় লিখা হতো। রাসূলের সহধর্মিনী উম্মে সালমা বলেছেন, রাসূল (সা.) আমার কাছে চামড়া চেয়ে নিলেন । সে সময় আলী(আ:)ও সেখানে ছিলেন। রাসূল বলছিলেন আর আলী (আ.) লিখছিলেন। আলী (আ.) এমন ভাবে লিখলেন যে, চামড়ার দুই পাশ এবং কিনারাগুলোও পূর্ণ হয়ে গিয়েছিলো। আরবরা অন্যান্য জিনিস যেমন গৃহপালিত বিভিন্ন পশু যেমন উট ও ভেড়ার হাড়, খেজুড় গাছের শুষ্ক বাকল, এমনকি খেজুড়ের শুষ্ক পাতা এবং কাপড়, লেখার জন্য ব্যবহার করতো।
হিজরী প্রথম শতাব্দির প্রথমার্ধের বিভিন্ন ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সে সময় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে চিঠি আদান-প্রদান হতো। সে সময়কার চিঠির মধ্যে আলী (আ.)''র চিঠি-সমগ্র অন্যতম। বিখ্যাত নাহজুল বালাগার একটি অংশে আলী (আ.)''র চিঠি স্থান পেয়েছে। আশেপাশের সভ্যতাগুলোর সাথে মুসলমানদের পরিচিতিও লেখার উপকরণকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে কিছুটা ভূমিকা রেখেছে। মিশর ও সিরিয়া জয় করার পর মুসলমানরা প্যাপিরাসের সাথে পরিচিত হয় এবং এর পরই প্যাপিরাসে লেখা শুরু করে। উমাইয়াদের খেলাফতের পুরো সময়টায় এবং আব্বাসীয়দের খেলাফতের প্রথম দিকে ইরাক,মিশর ও সিরিয়ায় প্যাপিরাসে খেলার প্রচলন ছিলো। ইতিহাসে এসেছে, আব্বাসীয় খলিফা মনসুর তার এক প্রতিনিধিকে কোষাগারে মজুদকৃত প্যাপিরাস বিক্রি করে দেয়ার নির্দেশ দেন যাতে এর ফলে কোষাগারের স্থান সংকটের সমাধান হয় এবং সরকারি বাজেটে কিছু অর্থ যোগ হয়। কিন্তু এর অল্প সময় পরই তিনি ওই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন এবং প্রয়োজনের কারণে এর বিক্রি বন্ধের নির্দেশ দেন। হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দির প্রথমার্ধের শেষ দিকে কাগজ, প্যাপিরাস ও চামড়ার স্থান দখল করে নেয়। কাগজ তৈরী এবং কাগজ শিল্পের বিস্তারে মুসলমানদের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। ইতিহাসে এসেছে, হিজরী প্রায় ১৩৪ সনের দিকে বর্তমান উজবেকিস্তানের উত্তরে মুসলিম সেনা কমান্ডার যিয়াদ বিন সালেহ'র নেতৃত্বে তুর্কি ও চীনা আমিরদের সাথে একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে যিয়াদ বিন সালেহ, চীন দেশীয় কয়েকজনকে বন্দি করেন। এসব বন্দী কাগজ তৈরির কৌশল সম্পর্কে জানতেন। তাদেরকে তিনি সমরখন্দে নিয়ে যান। ওই সব বন্দীদের মাধ্যমে কাগজ শিল্প সমৃদ্ধি লাভ করে এবং অন্যান্য মুসলিম এলাকাতেও তা ছড়িয়ে পড়ে। মান সম্পন্ন ও সস্তা হবার কারণে সমরখন্দের কাগজের সুনাম চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল।
এরপর মুসলমানরা ওই সব চীনা বন্দির কাছ থেকে কাগজ তৈরির কৌশল শিখে নেয় এবং এই শিল্পকে আরো সমৃদ্ধ করে। মুসলমানরা পরবর্তীতে তুলা এবং অন্যান্য উদ্ভিদ থেকে কাগজ তৈরি করতে সক্ষম হয়। এভাবে ক্রমান্বয়ে কয়েক ধরনের কাগজ বাজারে আসে। আল ফেহরেস্ত গ্রন্থে গবেষক ইবনে নাদিম কয়েক ধরনের কাগজের অস্তিত্বের কথা স্বীকার করেছেন। এসব কাগজ আবার বিভিন্ন ব্যক্তির নামে পরিচিতি লাভ করেছিল। এভাবে আস্তে আস্তে কাগজ শিল্প ইরাক, মিশর, সিরিয়া, মরক্কো, বর্তমান স্পেন ও ইরানের মতো মুসলিম ভূখন্ডগুলোতে বিস্তার লাভ করে এবং ঐসব এলাকাতেও কাগজ তৈরি হতে থাকে। খলিফা হারুনুর রশিদের ইরানি বংশোদ্ভুত মন্ত্রী ফজল বিন ইয়াহিয়া বারমেকি বাগদাদে কাগজ শিল্প প্রতিষ্ঠা করেন। বাগদাদের কয়েক কেন্দ্রে কাগজ তৈরি হতো। এরপর আস্তে আস্তে বাগদাদের কাগজের সুনাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং সবচেয়ে ভালো কাগজ হিসেবে সমাদৃত হতে থাকে।ঐতিহাসিকরা বলেছেন, বাগদাদের কাগজ এতটাই মানসম্পন্ন ছিলো যে, তা পবিত্র কোরআন লেখার কাজেও ব্যবহার হতো। হিজরী পঞ্চম শতাব্দিতে কাগজ শিল্প ইরাক থেকে সিরিয়ায় যায় এবং ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করে। দামেস্ক তথা সিরিয়ায় তৈরি কাগজও পরবর্তীতে সুনাম অর্জন করে এবং সিরিয়ার তৈরি কাগজ, পূর্ব ইউরোপে রপ্তানি করা হতো। মিশরে তুলনামূলক বিলম্বে কাগজ শিল্পের বিকাশ ঘটলেও সেখানকার কাগজও মানসম্পন্ন ছিলো বলে ঐতিহাসিক সনদে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। মুসলিম বিশ্বের পশ্চিমে অর্থাৎ উত্তর আফিকা, স্পেন ও সিলিলিতেও কাগজের মিল ছিলো এবং সেখান থেকে ইউরোপীয় দেশগুলোতে কাগজ রপ্তানি করা হতো। ইতিহাসে পাওয়া যায়, হিজরী সপ্তম শতকে ইরানে কাগজ তৈরি হতো।
এভাবেই মুসলমানরা লেখালেখি এবং সংস্কৃতি বিনিময়ের অন্যতম প্রধান উপাদান কাগজ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে এবং এর উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মিশর ও স্পেনের মাধ্যমে এই শিল্প ইউরোপে প্রবেশ করে এবং ১২৭৬ খ্রীষ্টাব্দে ইতালিতে, ১৩৪৮ সালে ফ্রান্সে, ১৩৯০ খ্রীষ্টাব্দে জার্মানিতে ও ১৪৯৫ সালে বৃটেনে কাগজ মিল প্রতিষ্ঠিত হয়।