জুলাই ১০, ২০১৭ ১৬:১৬ Asia/Dhaka
  • মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি-৮

ইসলামের প্রাথমিক যুগে প্রচলিত ভাষার শ্রুতি ও লেখ্য রূপ নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা বলেছি, মুসলমানরা কোরানের আয়াত লিখে রাখতে এবং নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গী ও চিন্তা-চেতনা অন্যের কাছে পৌঁছে দিতে ভাষার লেখ্য রূপকে গুরুত্ব দিতে শুরু করে ও একই লক্ষ্যে কাগজ শিল্পের উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধন করে।

আর কাগজ শিল্প তৎকালীন মুসলিম ভূখন্ড স্পেন ও মিশরের মাধ্যমে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে এবং ইউরোপে প্রথম কাগজ মিল প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসলিম বিশ্বে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি এবং বিজ্ঞানীদের গুরুত্ব নিয়েই আজকের আসরে আমরা আলোচনা করা হবে।

এ কথা সবাই জানে যে, বিশ্ব সভ্যতার বিকাশে মুসলমানদের ব্যাপক অবদান রয়েছে। পাশাপাশি মুসলিম সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করতে অন্যান্য সভ্যতার ভূমিকাকেও অস্বীকার করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে গ্রীক, ভারতীয় ও পারস্য সভ্যতার কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ্যযোগ্য। যেমন দর্শন ও যুক্তিবিদ্যাকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে গ্রীক সভ্যতার ভূমিকা রয়েছে। মুসলমানরা সাধারণত প্রাচীন সিরিয়ো ও ল্যাটিন ভাষায় অনুদিত বই-পুস্তকের মাধ্যমে গ্রিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে পরিচিত হয়েছেন। আর গ্রিক ভাষা থেকে বিভিন্ন বই অনুবাদের কাজটি করতেন ইরাক ও সিরিয়ার বেশ কয়েক জন খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বী। এদের কেউ কেউ অবশ্য পরবর্তীতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। কেউ কেউ আবার বই অনুবাদ করতেন মুসলিম খলিফাদের কাছ থেকে আর্থিক পুরস্কারের আশায়। গ্রিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের একটা অংশ আলেকজান্দ্রিয়া শিক্ষা কেন্দ্রের মাধ্যমে মুসলমানদের কাছে পৌঁছেছে।

মুসলমানরা গণিত, জ্যোতিষ শাস্ত্র, চিকিৎসা ও প্রকৃতি বিজ্ঞানকে বিকশিত করার ক্ষেত্রেও গ্রিক বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়েছে। তারা টলেমীয় গণিতের সাথে পরিচিত হয় এবং জ্যোতিষ শাস্ত্রের সংস্পর্শে আসে। এছাড়াও টলেমিয় জিওগ্রাফির সহযোগিতায় মুসলমানরা ভৌগলিক ম্যাপ তৈরি করতে সক্ষম হয়। মুসলমানরা গ্রিক চিকিৎসাশাস্ত্র থেকেও উপকৃত হয়েছে। বিশেষকরে গ্রিক মনিষী গ্যালেনাস ও হিপোক্রেটিসের বইগুলো থেকে মুসলমানরা অনেক তথ্য নিয়েছেন। জাবের ইবনে হাইয়ানের বইয়ে ওই সব মনীষীর বিভিন্ন গ্রন্থ ও লেখা থেকে উপকৃত হবার কথা উল্লেখ রয়েছে। তবে মুসলমানরা ভিন্ন ভাষা থেকে অনুদিত বইয়ের চেয়ে গ্রিক চিকিৎসা শাস্ত্রবিদদের সঙ্গে সরাসরি সংস্পর্শের মাধ্যমে এই শাস্ত্রের সঙ্গে বেশি পরিচিত হয়েছেন।

দামেস্ক মুসলিম খেলাফতের রাজধানী হিসেবে নির্বাচিত হবার পর গ্রিক বিজ্ঞানীদের সঙ্গে মুসলমানদের যোগাযোগ সহজ হয়। বিশিষ্ট প্রাচ্যবিদ ফুয়াদ সাজগিন এ বিষয়ে লিখেছেন, মুয়াবিয়াকে বিষ সংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শ দেয়ার জন্য তার প্রাসাদে ‘অসল' নামের একজন চিকিৎসক ছিলেন। এছাড়াও আবুল হাকাম নামের আরো একজন খ্রিষ্টান চিকিৎসকও মুয়াবিয়ার প্রাসাদে চিকিৎসা কাজে নিযুক্ত ছিলেন। বিশিষ্ট প্রাচ্যবিদ ফুয়াদ সাজগিনের গবেষণা অনুযায়ী, তৃতীয় হিজরীর প্রথমার্ধে গ্রিস থেকে মুসলিম বিশ্বে চিকিৎসা সংক্রান্ত জ্ঞান ও তথ্যের সরবরাহ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়।

ইতালীয় প্রাচ্যবিদ আলদুমিয়েলি লিখেছেন, মুসলিম সভ্যতায় ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রভাবও বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। ১৫৪ হিজরিতে কয়েকজন ভারতীয় বিজ্ঞানী আব্বাসিয় খলিফা মনসুরের কাছে আসেন। এর মধ্যে বিশিষ্ট জ্যোতিষবিদ মন্কাও ছিলেন। তিনি ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান বিশেষকরে ভারতীয় জ্যোতির্বিদ ব্রক্ষ্মগুপ্তের এস্ট্রনমিক্যাল চার্ট বিষয়ে গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। খলিফা মনসুর ওই জ্যোতিশাস্ত্রবিদকে তার দরবারের কিছু লোকজনকে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়ার আহ্বান জানায়। এরপর ব্রক্ষ্মগুপ্তের গ্রন্থটিকেও আরবি ভাষায় অনুবাদ করার নির্দেশ দেন। মংকার দেয়া শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ভিত্তিতে ভারতীয় জ্যোতিবিজ্ঞান চর্চা খলিফা মামুনের শাসনামল পর্যন্ত অব্যাহত ছিলো। সে সময় মুসলিম জ্যোতির্বিদ ইব্রাহিম ফারাযিকে ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান শেখার এবং নক্ষত্র কেন্ত্রিক বর্ষ গণনা সংক্রান্ত বই লেখার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। আবু রায়হান বিরুনি তার লেখা বইয়ে বহু বার ফারাযির বইকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করেছেন। মুসলিম চিকিৎসা বিজ্ঞানও ভারতীয় চিকিৎসা শাস্ত্র থেকে উপকৃত হয়েছে। ইবনে নাদিম তার আল-ফেহরেস্ত গ্রন্থে চিকিৎসা বিষয়ক ১২ টি ভারতীয় বইয়ের নাম উল্লেখ করেছেন। এসব বই আব্বাসিয়দের শাসনামলের প্রথম দিকে অনুদিত হয়েছে। মুসলমানরা ভেষজ, খনিজ ও প্রাণিজ ওষুধের সঙ্গে পরিচিত হতে অনেক ক্ষেত্রেই ভারতীয় চিকিৎসাবিদদের লেখা বই পড়তেন।

এবার ইরান তথা পারস্য সভ্যতা প্রসঙ্গে আসছি। ইসলামপূর্ব যুগে ইরানের খসরু আনুশিরাভানের সময় জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নতির লক্ষ্যে ব্যাপক তৎপরতা চালানো হয়। বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে এই সাফল্যের কেন্দ্রস্থল ছিল তৎকালীন ইরানের জুন্দি শাপুর শহর। এই শহররিট বর্তমান ইরানের শুশতার ও দেযফুল শহরের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত ছিল। সে সময় ওই শহরে কয়েকটি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তখন সিরিয়ো খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী বিজ্ঞানী ও অধ্যাপকদের এসব স্কুলে আমন্ত্রণ জানানো হতো। ওই সময় এক দল বিজ্ঞানীর সহযোগিতায় গ্রিক, সিরিয়ো ও সাংস্কৃত ভাষা থেকে বিজ্ঞান বিষয়ক বইগুলো পাহলভি ভাষায় অনুবাদ করা হয়। জুন্দি শাপুরের অনুবাদকরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চিকিৎসা শাস্ত্র নিয়ে কাজ করেছেন। জুন্দি শাপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি সম্ভবত চতুর্থ খ্রিষ্টাব্দের দিকে প্রতিষ্ঠা করা হয়। ওরফা থেকে বিতাড়িত হবার পর কনস্টানিনোপলের বিজ্ঞানীরা জুন্দিশাপুরে বসতি গড়েন এবং তারা গ্রিক ভাষা থেকে প্রাচীন সিরিয়ো ভাষায় অনুদিত বিভিন্ন বই সঙ্গে করে এখানে নিয়ে আসেন। এছাড়া, গ্রীসের অনেক নির্বাসিত বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বও এখানে এসে দর্শন শাস্ত্র পড়াতে থাকেন এবং এদের অনেকেই পরে এরিস্টটল ও প্লেটোর বই পাহলাভি ভাষায় অনুবাদ করেন।

এর পরের ইতিহাস হলো, ইরানিরা ইসলাম গ্রহণ করে এবং ইরান ইসলামি ভূখন্ডের অংশে পরিণত হয়। অনেক ইরানি বই ও প্রবন্ধ ফার্সি থেকে আরবিতে অনুদিত হয়। আব্বাসিয় শাসনামলের পরে পাহলাভি থেকে আরবিতে যেসব বই ও প্রবন্ধ অনুবাদ করা হয়েছিল,তার বেশির ভাগই ছিলো, সাহিত্য ও ইতিহাস সম্পর্কে। আব্বাসিয়দের আমলে পাহলাভি ভাষা থেকে আরবিতে অনুবাদের নবযুগ শুরু হয়। এসব বই আব্বাসিয় খলিফার দরবারের প্রভাবশালী ইরানিদের সহযোগিতায় অনুদিত হয়। উদাহরণ হিসেবে বারমেকি পরিবারের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এই পরিবার ইরানি মনিষীদের বাগদাদে নিয়ে যাওয়া এবং ইরানি জ্ঞান-বিজ্ঞানের বই অনুবাদের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। ওই সময় জ্যোতি শাস্ত্র বিষয়ক তথ্যাবলীই বেশি বেশি ইরান থেকে মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। বড় বড় চিকিৎসাবিদকে সে সময় ইরানের জুন্দিশাপুর থেকে বাগদাদে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। বিশিষ্ট মুসলিম গবেষক ও বই বিশারদ ইবনে নাদিম লিখেছেন, বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ নুবাখত ও তার পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন জ্ঞানগর্ভ বই পাহলাভি থেকে আরবিতে অনুবাদ করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখেন।