মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি-৯
আজ আমরা অনুবাদ আন্দোলন বা যুগের দিকে নজর দেওয়ার চেষ্টা করবো। ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির গঠন ও বিকাশে এই অনুবাদ যুগের ব্যাপক ভূমিকা ছিল।
কীভাবে অনুবাদের ধারা ইসলামী সভ্যতার গঠনে অবদান রেখেছে তা নিশ্চয়ই একটা প্রশ্ন সাপেক্ষ ব্যাপার।
ইসলামের প্রাথমিক যুগের মুসলমানগণ ইসলামের নয়া হুকুমাতকে যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করার স্বার্থে এবং শত্রুদের ওপর বিজয় সম্প্রসারণ করার লক্ষ্যেই মনোনিবেশ করেছিল বেশি। তবে এক্ষেত্রে মুসলমানদের দৃষ্টি ছিল কোরআনের আদেশ-নির্দেশ এবং শিক্ষাগুলোর দিকে। এছাড়াও ব্যাকরণ, বিজয়ের ইতিহাস, ফিকাহ বা ইসলামী নীতিমালা এবং এ জাতীয় অপরাপর জ্ঞান-বিজ্ঞানের মতো বিষয়গুলোর প্রতি মুসলমানদের সচেতন দৃষ্টি ছিল। ধীরে ধীরে বিজয়ের ঘনঘটা স্তিমিত হয়ে এলো আর ইসলামী শাসনব্যবস্থার ভিত্তি স্থিতিশীল হলো। মুসলমানরা তাই ইসলামী শিক্ষাগুলো বিস্তারের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে ভালোই সুযোগ পেলো। আব্বাসীয় খলিফাদের কারো কারো অনুপ্রেরণামূলক নীতি এবং বায়তুল মালের অঢেল সম্পদের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে মুসলমানরা এবার আস্তে আস্তে শিল্প-কলকারখানা ও বিজ্ঞানের দিকে ঝুঁকতে থাকে, ইতোপূর্বে যা ছিল অমুসলিমদের হাতে। যাই শিল্প ও জ্ঞানের দিকে মনোনিবেশ করার ফলে মুসলমানদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটতে শুরু করে।
ইসলামের ঐশী জ্ঞান তথা কোরআনের জ্ঞানের বরকতে যারা চিন্তা-চেতনার উঁচুমার্গে পৌঁছেছেন, তারা বিভিন্ন জাতির ঐতিহ্য, সভ্যতা, কৃষ্টি-কালচার, চিন্তাধারা ইত্যাদি বিষয়ে জানার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠলেন। মুসলিম ইতিহাসবিদ ইবনে খালদুন মনে করেন মুসলমানদের এই আগ্রহের মূল উৎস হচ্ছে কোরআনের সেইসব আয়াত এবং সেইসব হাদিস যেগুলোতে মানুষকে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। তো অন্যান্য দেশ ও জাতির সভ্যতা ও জ্ঞান সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করার স্বার্থেই অনুবাদের আশ্রয় নেওয়া হয়। অনুবাদের মাধ্যমে অপরাপর জাতির জ্ঞান ও শিল্পকর্মগুলোকে অর্জন করার এই পদক্ষেপ সেই সময়ের জন্যে অসম্ভব দূরদর্শী এবং চিন্তা-চেতনাগত উৎকর্ষের পরিচায়ক ছিল। খুব অল্প সময়ের মধ্যে মুসলিম বিশ্বে জ্ঞান পিপাসু এবং জ্ঞানীগুণী মনীষীগণ এই অনুবাদকর্মে এতো বেশি উৎসাহী ও কর্মতৎপর হয়ে উঠেছিলেন যে পরবর্তীকালে ঐ সময়টাকে ইতিহাসে ‘অনুবাদের যুগ' বলে অভিহিত করা হয়েছে।
অনুবাদ যুগের উল্লেখযোগ্য শিল্পকর্মের একটি উদাহরণ হলো ফেহরেস্ত বা নির্ঘণ্ট। এটি লিখেছিলেন ইবনে নাদিম। এই গ্রন্থটি পূর্ববর্তীদের জ্ঞানচর্চার ছোট্ট একটি নমুনামাত্র। হিজরী চতুর্থ শতাব্দি পর্যন্ত সময়কালের মুসলিম বিশ্বে জ্ঞান চর্চার যে ধারা বহমান ছিল তারই ক্ষুদ্র একটি উদাহরণ লক্ষ্য করা যাবে এই গ্রন্থ-দর্পণে। সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ ও জাতির সাহিত্যের ইতিহাস সম্পর্কে খুব কম গ্রন্থই লেখা হয়েছে যে গ্রন্থে এই নির্ঘণ্টের উদ্ধৃতি দেওয়া হয়নি। ইসলামী সভ্যতার ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ আরো কয়েকটি উৎস হলো আখবারুল উলামা এবং তাবাকাতুল আতবা গ্রন্থ দু'টি। ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাস এবং এই সভ্যতা বিকাশের কারণ নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন, তারা এই গ্রন্থ দু'টি থেকে বহু উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন। উমাইয়া শাসনামলে গ্রিক এবং সুরিয়ানী ভাষার বহু মূল্যবান গ্রন্থও আরবি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল। চিকিৎসা বিষয়ক এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হচ্ছে কোন্নাশ। উমাইয়া শাসক প্রথম মারওয়ানের সময় এটি অনূদিত হয়েছিল। তবে উমাইয়া শাসনামলে অনূদিত কর্মের বেশিরভাগই ছিল প্রশাসনিক, বিচারিক, রাজনৈতিক এবং বাণিজ্যিক দলিল-দস্তাবেজ। এগুলো অনারবদের সাথে বিভিন্ন রকম যোগাযোগ বা সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রয়োজন ছিল।
আসলে অনুবাদ আন্দোলন বলতে যা বোঝায়, বিশেষ করে সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক বিভিন্ন গ্রন্থ ব্যাপক পরিমাণে অনুবাদ হবার কাজটি শুরু হয় আব্বাসীয় খলিফাদের শাসনামল থেকে। জ্ঞানের এই আন্দোলন তথা অনুবাদের এই ধারা অন্তত দুই শ' বছর অব্যাহত ছিল। আব্বাসীয় শাসকদের মধ্য থেকে দ্বিতীয় খলিফা মানসুর ভিন্ন দেশ, বিদেশী সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক বই পুস্তক অনুবাদের ক্ষেত্রে অনেক বেশি অবদান রেখেছেন। তাঁর শাসনামলে অনুবাদকর্ম ব্যাপক উৎকর্ষ লাভ করেছিল। বহু ইতিহাসবিদ মানসুরকে অনুবাদকর্ম বা অনুবাদের ধারার স্থপতি বলে মনে করেন এবং তাদের মতে এই ধারা বিকাশে খলিফা মানসুরের ভূমিকাই ছিল সবার আগে উল্লেখ করার মতো। মানসুর দাভানিকি বাগদাদকে রাজধানী হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন। তিনি জ্যাতির্বিজ্ঞানীদেরকে তাঁর দরবারে নিয়ে এসেছিলেন এবং পরবর্তীকালে অন্যান্য শাসকও তাঁর ঐ কাজকে অনুসরণ করেছিল। খলিফা মানসুর জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সাথে পরামর্শ না করে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজে সাধারণত হাত দিতেন না।
সেই যুগে জ্যোতির্বিজ্ঞানে ইরানী মনীষীদের জ্ঞান এতো বেশি ছিল যে, খলিফা মানসুর একদল ইরানী জ্যোতির্বিজ্ঞানীকে তাঁর দরবারে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। অবশ্য জযেোতির্বিজ্ঞানে মুসলমানদের আগ্রহ জাগার পেছনে আগ্রহ বা প্রেরণা জুগিয়েছিল আলকোরআন। কেননা কোরআন মুসলমানদেরকে আল্লাহর সৃষ্টিজগত বিশেষ করে আকাশ, যমিন, চাঁদ, সূর্য, নক্ষত্র ইত্যাদি নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করার জন্যে উদ্বুদ্ধ করেছে। মুসলমানদের নামায আদায় করা, হজ্জ্ব করা, রোযা রাখা, ক্বেবলার দিক নির্নয় করা, হত্যা নিষিদ্ধ হারাম মাসগুলোর মর্যাদা রক্ষা করা ইত্যাদি বিচিত্র ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করার সাথে জ্যোতির্বিজ্ঞানের নিবীড় সম্পর্ক রয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রতি মুসলমানদের আগ্রহ ছিল বেশি।
অনুবাদ যুগে সবচেয়ে খ্যাতিমান জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ ছিলেন নওবাখ্তের খান্দানের। এই খান্দানটি পরবর্তীকালে মুসলমান হয়েছিল এবং আরো পরে শিয়া মাযহাবের অনুসরণ করেছিল। এই খান্দানটি দীর্ঘ সময় ধরে আব্বাসীয় শাসকদের দরবারে ছিল এবং তাদের মধ্য থেকে অনেক সরকারী কর্মকর্তা, অনেক বক্তা এবং বহু জ্যোতির্বিজ্ঞানী বেরিয়ে এসেছিল। আব্বাসীয় খলিফাদের আহ্বানে এই খান্দানের বহু বিজ্ঞ বিজ্ঞ মনীষী বিশেষ করে নওবাখ্ত এবং তার ছেলে আবু সাহ্ল গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি সম্পর্কে অনেক গ্রন্থ অনুবাদ করেন। অবশ্য তাঁরা অনুবাদ শেষে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নিজস্ব লেখায় নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিও ব্যক্ত করতেন। নওবাখত ছাড়া অপর বিখ্যাত ইরানী জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিশিষ্ট শিয়া মনীষী মুহাম্মাদ বিন ইব্রাহিম ফাযারির নামটি অনুবাদকদের নামের তালিকায় উজ্জ্বল স্থান করে নিয়েছে। তার পিতা ইব্রাহিম প্রথম মুসলমান যিনি গ্রহ-নক্ষত্রের্উচ্চতা ও গতিবিধি নির্ণায়ক যন্ত্র এস্ট্রোলেইব থৈরি করেছিলেন। তাঁর আরেকটি বিখ্যাত বইয়ের নাম হেোল ‘সেন্দ হেন্দে কাবির'। আব্বাসীয় খলিফা মামুনের শাসনকাল পর্যন্ত এই গ্রন্থটিই ছিল নক্ষত্র বিষয়ক বিদ্যার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ।
খলিফা মানসুরের বিশিষ্ট চিকিৎসক জার্জিসও গ্রিক এবং সুরিয়ানী ভাষার চিকিৎসা বিষয়ক বেশ কিছু বই অনুবাদ করেন। মানসুরের শাসনকা্েই ইরানের বিখ্যাত লেখক ইবনে মোকাফফে আরবি ভাষা থেকে সাহিত্য গ্রন্থ কালিলা ও দিমোনা অনুবাদ করেছিলেন। যুক্তিবিদ্যার অনেক বইও তিনি অনুবাদ করেছিলেন। খলিফা মানসুরের সময় থেকে বিভিন্ন ধর্মের মাঝে বাহাস বা সংলাপের সূত্রপাত হয়েছিল। সংলাপের এই ধারা মানসুরের ছেলে মাহদি আব্বাসীর সময় আরো বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করে। সংলাপের যুক্তিপূর্ণতার জন্যে এবং গ্রহণযোগ্যতার জন্যে মাহদির সময় এরিস্টটলের বইও অনুবাদ করা হয়েছিল। এভাবেই অনুবাদের মধ্য দিয়ে ইসলামী সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল।#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/আবু সাঈদ/১৩