মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি-১১
গত আসরে আমরা অনুবাদ আন্দোলন বা অনুবাদ যুগ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আব্বাসীয় শাসনামলে বিশেষ করে খলিফা মানসুরের সময় প্রচুর শিল্পকর্ম অনুবাদের প্রতি ইঙ্গিত করেছিলাম। আসলে আব্বাসীয় শাসনামলে অনুবাদের ধারাটাকে শক্তিশালী করে তোলার লক্ষ্যে প্রতি প্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলা হয়েছিল। বাইতুল হিকমাহ স্টাডি সেন্টার তেমনি একটি প্রতিষ্ঠান।
এই প্রতিষ্ঠানে অনুবাদের পাশাপাশি ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজও রক্ষণাবেক্ষণ করা হতো। এরি ধারাবাহিকতায় আমরা আজকের আসরে কথা বলার চেষ্টা করবো।
আব্বাসীয় খলিফা মামুনের সময় জনগণকে পড়ালেখা করা তথা জ্ঞান অর্জনের জন্যে অনুপ্রাণিত করা হয়েছিল। সেজন্যে অনুবাদের এই যুগে ডুক্তিবিদ্যা, দর্শনমহ বিভিন্ন বিষয়ের বহু লেখা অনুবাদ করার প্রয়েঅজনীয়তা দেখা দেয়। এই প্রয়োজনীয়তার কারণেই ইরান, ইরাক, ভারত এবং সিরিয়া থেকে অনেক অনুবাদককে বাগদাদে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এইসব অনুবাদক বিভিন্ন ধর্ম ও মাযাহাবের এবং বিভিন্ন বর্ণের ছিলেনঃ যেমন নেস্তুরিয়ান, জরাথ্রুস্টি, ব্রাহ্মণ, রোমি ইত্যাদি। এই অনুবাদগণ বাগদাদে গ্রিক, ফার্সি, সুরিয়ানী, হিন্দি ইত্যাদি ভাষার বই অনুবাদ করেন। লেবাননের বিশিষ্ট লেখক জর্জি জিদান এই সময়ে বাগদাদে বই বিক্রয়ের দোকান, সাহিত্য ও বিজ্ঞান চর্চার প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়।
আব্বাসীয় শাসক মানসুরের সময় নিজস্ব উদ্যোগেও অনেকেই অনুবাদকর্মে হাত দিয়েছিলেন। এই শ্রেণীর মধ্যে বনি মুসা নামে পরিচিত ইরানের বনি শাকের খান্দানের নাম উল্লেখ করা যায়। মুসা বিন শাকের এবং তার সন্তান মুহাম্মাদ, আহমাদ এবং হাসান খোরাসানের অধিবাসী ছিলেন। মুসার সন্তানেরা বায়তুল হেকমায় গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যামিতি, ম্যাকানিক্স্ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে পড়ালেখা করেন এবং এসব বিষয়ের ওপর ব্যাপক জ্ঞান অর্জন করেন। এই তিন ভাই জ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে বহু বই লিখেছেন এবং অনুবাদ করেছেন। তাদের বহু বই পরবর্তীকালে ইউরোপে আরবি থেকে ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাঁর এরকম উল্লেখযোগ্য একটি বই ছিল মেকানিক বিষয়ে। বলা যায় ইসলামী যুগে মেকানিকেল বিষয়ে সর্বপ্রথম বই এটি।তৎকালীন অপরাপর অনুবাদকদের মধ্যে মুহাম্মাদ ইবনে মুসা খাওয়ারেযমির নাম উল্লেখ করার মতো। ইসলামী যুগের মহান এই মনীষী ছিলেন একদিকে গণিতবিদ অপরদিকে জ্যোতির্বিজ্ঞানী, ভূগোলবিদ এবং সে সময়কার নামকরা ইতিহাসবিদ। তাঁর পূর্বপুরুষগণ ছিলেন খাওয়ারেযমের অধিবাসী। এ কারণেই তিনি খাওয়ারেযমি হিসেবেই প্রসিদ্ধি পান। খাওয়ারেযমি তাঁর শৈশবে এবং শিক্ষাজীবন শেষে খলিফা মামুনের সময় দারুল হিকমার সদস্য হন। যেসব জ্যোতির্বিজ্ঞানীকে বাদশা মামুন গ্রন্থাগার প্রধানের দায়িত্ব দিয়েছিলেন, তাদের একজন ছিলেন খাওয়ারেযমি। তিনি তাঁর নিজস্ব লেখালেখিতে এবং জোন্দি শাপুর বিদ্যালয়ে পড়ানোর সময় বিভিন্ন দেশ ও জাতির বইগুলো বিশেষ করে ইরানী এবং ভারতীয় প্রাচীন বইগুলোকে ব্যাপকভাবে কাজে লাগিয়েছেন।
খাওয়ারেযমি ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি বীজগণিত এবং সমাধান নিয়ে বই লিখেছেন। তিনি বীজগণিতকে একটি স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে গণ্য এবং প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। ‘আল-জাবরা' নামে তাঁর বইটি এ বিষয়ক অনবদ্য গ্রন্থ হিসেবে আজো অবশিষ্ট রয়েছে। বীজগণিত ছাড়াও হিসাব বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও খাওয়ারেযমির ব্যাপক অবদান ছিল।এ্যালগোরিদম নামে হিসাব বিজ্ঞানে যে পরিভাষাটি ব্যবহৃত হয় তা খাওয়ারেযমির দেওয়া নাম। পরবর্তীকালে এই পরিভাষাটি ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায় প্রবেশ করে। খাওয়ারেযমি সম্পর্কে ইতালির বিশিষ্ট মনীষী মধ্যপ্রাচ্যবিদ আলদোমেইলি তাঁর লেখা আরবের ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেনঃ খাওয়ারেযমি ছিলেন সবচেয়ে বড়ো মুসলিম গণিতবিদ। তিনি কেবল মুসলিম বিশ্ব কিংবা প্রাচ্যেই নন বরং পশ্চিমা বিশ্বেও গণিতবিদ হিসেবে ব্যাপক খ্যাতিমান। গণিতশাস্ত্রে খাওয়ারেযমি নতুন এক যুগের সূচনা করেন। তাঁর লেখা বইগুলো হিসাব বিজ্ঞান, জ্যামিতি এবং ত্রিকোণমিতিতে নজিরবিহীন।
আব্বাসীয় খলিফা মামুনের পরবর্তী কালের শ্রেষ্ঠ অনুবাদকদের মাঝে সাবেত বিন কোর্রার নামটি উল্লেখযোগ্য। তিনি ছিলেন একজন সাবেয়ী দার্শনিক। হাররানে বসবাস করতেন, হাররান এখন তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলে পড়েছে। সাবেত চিকিৎসাবিদ্যা, দর্শন এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানে ব্যাপক পারদর্শী ছিলেন।্এসব বিষয়ে তাঁর পারদর্শিতার নিদর্শন তাঁর লেখা বইগুলোতে সুস্পষ্ট। এগুলোর বাইরেও তিনি সুরিয়ানী ভাষায় সাবেয়ী মাযহাব সম্পর্কে বই লেখেন। তিনি সুরিয়ানী ভাষায় ব্যাপক দক্ষ ছিলেন এবং এ ভাষায় বহু বই অনুবাদও করেছিলেন। গ্রিক ভাষার বহু বই বিশেষ করে গণিত এবং জ্যোতির্বিদ্যার বইগুলো অনুবাদ এবং ব্যাখ্যা করেন।
বাগদাদে অনুবাদের এই ধারা দুই শতাব্দী পর্যন্ত ব্যাপক তোড়জোড়ের সাথে চলে। এরপর ধীরে ধীরে অনুবাদের কাজে ভাটা পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় সহস্রাব্দে এসে অনুবাদের ধারার পরিসমাপ্তি ঘটে। তার মানে কিন্তু এই নয় যে অনুবাদের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে গেছে কিংবা অনুবাদ করার মতো যোগ্য লোকের অভাব ছিল। উল্টো বরং বাগদাদে আজুদি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা এবং ডাক্তার, অনুবাদক, বিজ্ঞানীদের সমাবেশ হিজরী চতুর্থ শতকের শেষদিকে আলে-বুইয়েরের সমকালে জ্ঞান ও বিজ্ঞানে কর্মতৎপরতার ক্ষেত্রে যে ব্যাপক উন্নয়ন ও বিকাশ ঘটেছে তারই পরিচয় বহন করে।
অনুবাদ আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যাবার একটা মৌলিক কারণ হলো বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নতুন কোনো অগ্রগতি না হওয়া। এর অর্থ এই নয় যে জ্ঞান-বিজ্ঞান সংক্রান্ত গ্রিসের আর কোনো বই হাতের কাছে ছিল না, বরং জ্ঞানী-গুণী মনীষীদের জন্যে বা লেখকদের কাঙ্ক্ষিত আর কোনো বই গ্রিক ভাষায় অবশিষ্ট ছিল না। যার ফলে অনুবাদের এই ধারা ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে আসে। জ্ঞানের বহু শাখাতেই অনেক আগে থেকেই মূল টেক্সটগুলো পড়া, অনুবাদ করা এবং ব্যাখ্যা করা হয়ে গেছে। যার ফলে জ্ঞানের ক্ষেত্রে আগের তুলনায় অনেক বেশি বিচরণ করার সুযোগ আসে এবং নতুন নতুন মৌলিক বই বা শিল্পকর্মও তৈরি হতে থাকে। নতুন নতুন বিষয় এবং বই রচিত হবার কারণে অনুবাদের শৌকর্য ম্লান হয়ে যায় এভং নতুন নতুন বই আর বিষয় নিয়ে গবেষণার প্রয়োজনীয়তা বেড়ে যায়। আগে যাঁরা অনুবাদের জন্যে আগ্রহী ছিলেন তারাই এখন আরবি ভাষায় নতুন নতুন বই রচনা করার আগ্রহ দেখাতে থাকেন।
আলবুইয়ের আমলে নতুন নতুন বই লেখার চর্চা অনেক বেশি বেড়ে যায়। এভাবে নতুন বই, নতুন লেখালেখি, নতুন নতুন বিষয়-আশয়ের চর্চার কারণে অনুবাদের ধারাটির একেবারেই পরিসমাপ্তি ঘটে।#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/আবু সাঈদ/২৪