জুলাই ২৭, ২০১৭ ২০:৪৯ Asia/Dhaka
  • মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি-১২

ইসলামী সভ্যতার ইতিহাসে শুরু থেকেই জ্ঞান-গবেষণা বিষয়ক প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক গুরুত্ব ছিল। শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে সাংস্কৃতিক যে বিশাল ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে, ইসলামী সভ্যতার বিভিন্ন যুগে সেই ঐতিহ্য ব্যাপক উজ্জ্বলতা পায় বিশেষ করে জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ইসলামী সভ্যতার যুগে এসে অনেক বেশি জাঁকজমকপূর্ণতা পায়।

এইসব প্রতিষ্ঠান ইসলামী সমাজের মৌলিক অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হতো। মসজিদ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়, বাইতুল হিকমা এবং লাইব্রেরির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত উন্নত, প্রশান্ত এবং স্থিতিশীল সমাজেই গড়ে ওঠে। ইসলামী সভ্যতার যুগে তাই উপযুক্ত পরিবেশ থাকায় বড়ো বড়ো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং লাইব্রেরি বেশি বেশি গড়ে উঠেছে। এগুলোর এতো বেশি বিকাশ ঘটেছে যে তৎকালীন সময়ের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল এইসব প্রতিষ্ঠান। মাদ্রাসার মতো জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিষ্ঠা করার পেছনে মূল লক্ষ্যটি ছিল সাধ্যমতো জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার মধ্য দিয়ে ইসলাম সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা নিয়ে মুসলমান হওয়ার পথ সুগম করা। যাই হোক ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হবার এই আসরে আমরা আজ চেষ্টা করবো মসজিদ, মাদ্রাসার মতো সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে খানিকটা আলোকপাত করার।

ইসলামী সভ্যতার অঙ্গনে ধর্মীয় কোনো সামাজিক প্রতিষ্ঠান বা কেন্দ্র হিসেবে সর্বপ্রথম যে স্থাপনাটির নাম উঠে আসবে তা হলো মসজিদ। মসজিদই মুসলমানদের জন্যে সর্বপ্রথম কোনো ধর্মীয় কেন্দ্র। রাসূলে আকরাম (সা) মানুষের কাছে তাঁর মুক্তির বাণী পৌছিয়েঁ দেওয়ার লক্ষ্যে এবং তাদেরকে সরল সঠিক পুণ্যের পথে পরিচালিত করার লক্ষ্যে দাওয়াতী কাজের কেন্দ্র হিসেবে মদিনায় সর্বপ্রথম যে মসজিদটি স্থাপনন করেছিলেন, দাওয়াতী কাজের সম্প্রসারণের সাথে সাথে মসজিদ নির্মাণের সেই ধারাও ধীরে ধীরে বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। মদিনায় প্রতিষ্ঠিত সর্বপ্রথম মসজিদটি ছিল শিক্ষা-প্রশিক্ষণ, দ্বীনী প্রচার, বিচার-আচারসহ সাংস্কৃতিক, সামরিক এবং রাজনৈতিক সকল কর্মকান্ডের মূল কেন্দ্র।

নবীজীর পর হযরত আলী (আ) ও তাঁর প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার অংশ হিসেবে নবীজীর প্রদর্শিত পন্থাই অনুসরণ করেন। সে কারণেই সেই সময়েও জ্ঞান এবং শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ডগুলো মসজিদ কেন্দ্রিক পরিচালিত হতো। জ্ঞানের বিভিন্ন রকম আসরে তিনি ইসলাম পরিচিতি বিষয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করতেন এবং জ্ঞান সংক্রান্ত বিভিন্ন সংলাপ বা বাহাসেও অংশগ্রহণ করতেন। হযরত আলী (আ)-এর শাহাদাতের পরও আহলে বাইতের মাধ্যমে ঐ ধারা অভ্যাহত থাকে। তারি ধারাবাহিকতায় ধীরে ধীরে বাগদাদসহ মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মাদ্রাসা, বাইতুল হিকমাহ এবং লাইব্রেরির মতো বিচিত্র প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা গড়ে ওঠে। ইমাম সাদেক (আ) এর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও জ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে পাঠদানের পাশাপাশি গবেষণা ও সংলাপমূলক কর্মকাণ্ডও পরিচালিত হতো। ইমাম তাঁর প্রত্যেক ছাত্রের জন্যে একেকটি বিষয় সুনির্দিষ্ট করে দিতেন যে বিষয়ের ওপর ঐ ছাত্রকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হতো এবং প্রশ্নকারীদের প্রশ্নের সমাধান দিতে হতো। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় অবন বিন তাগলাব ফিকাহ বা ইসলামী আইনশাস্ত্রে ব্যাপক প্রজ্ঞার অধিকারী ছিলেন।

ইমাম তাকে বললেন, তুমি মসজিদে গিয়ে বসো এবং ফতোয়া দাও। ফতোয়া মানে হলো জীবনের বিভিন্ন সমস্যার ইসলামী আইন ভিত্তিক সমাধান। হিশাম বিন হাকাম ছিলেন কালাম শাস্ত্রে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন। তিনি মসজিদে ইমামত, আকায়েদ নীতি সম্পর্কে বাহাস এবং সংলাপে অংশ নিতেন। ইমামের আরেক শাগরেদের নাম ছিল জাবের ইবনে হাইয়্যান। তিনি ছিলেন রসায়ন শাস্ত্রসহ আরো অনেক শাস্ত্রে বিজ্ঞ। মসজিদে তিনি সেইসব বিষয়ে পড়াতেন। স্বয়ং ইমাম সাদেক (আ) ছিলেন জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ব্যাপক পারদর্শী। কথিত আছে যে, ইমাম জাফর (আ) ছিলেন জাফরি শিয়া মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা। মদিনায় তাঁর মক্তবে হাজার হাজার মানুষ বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান আহরণের উদ্দেশ্যে আসতেন। চার হাজারেরও বেশি মানুষ ফিকাহসহ ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের জন্যে পড়ালেখায় মনোনিবেশ করেন। ইমাম সাদেক (আ) এর পাঠ দানের জলসা বা ক্লাসগুলো সাধারণত মসজিদেই অনুষ্ঠিত হতো। তাঁর ছাত্ররাও বেশিরভাগ ক্লাসই মসজিদে নিতেন, মসজিদে সবাই বৃত্ত রচনা করে বসতেন আর ইমামের ছাত্ররা সেখানে দারস দিতেন।

মসজিদ ছিল মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক কেন্দ্র হিসেবে সর্বপ্রথম স্থাপনা। মাদ্রাসার প্রচলন হয় মসজিদের পরে। অবশ্য মাদ্রাসার স্থাপত্য কার্যক্রমও অনেকটা মসজিদের মতোই ছিলো। মসজিদে যেমন জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা হতো, মাদ্রাসাগুলোতেও তা-ই হতো। তবে মাদ্রাসার ব্যাপক বিকাশ সত্ত্বেও মসজিদের সেই প্রশিক্ষণমূলক ভূমিকা কিন্তু অক্ষুন্নই ছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ইরানের সিস্তানে হিজরী প্রথম শতকে একটি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। ঐ মসজিদে বছরের পর বছর ধরে ধর্মীয় বিষয় আশয় শিক্ষা দেওয়া হতো। বোখারাতেও বেশ কয়েকটি মসজিদ দ্বীনী শিক্ষা কার্যক্রমে ব্যবহৃত হতো। খোরাসানের শিক্ষা ও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র নিশাবুরে বড়ো বড়ো বেশ কয়েকটি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। মাতারযি মসজিদ, আকিল মসজিদ এবং প্রাচীন মসজিদ এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এই মসজিদগুলোকেও শিক্ষা কার্যক্রমে ব্যবহার করা হতো।

ইসলামী শহরগুলোতে সেই শুরু থেকেই বহু মসজিদ নির্মিত হয়েছে যেগুলোতে লাইব্রেরি ছিল। এরকম কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মসজিদের নাম করা যেতে পারে, যেমনঃ আল-আকসা মসজিদ, জামে উমাইয়া দামেশ্ক, তিউনিশিয়ার জামেউল কাবির, কায়রোর আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি। ইসলামী সভ্যতার ই্তিহাসে এইসব প্রতিষ্ঠান বেশ খ্যাতিময়। এসব প্রতিষ্ঠানে বিশাল বিশাল গ্রন্থাগার ছিল। বিভিন্ন পবিত্র স্থান বা স্থাপনাতেও বড়ো বড়ো গ্রন্থাগার ছিল। যেমন মাসজিদুল হারাম বা হারামে মাক্কি, মদীনার হারামে নববী, নাজাফের হারামে ইমাম আলী, কাজেমাইনের হারামে মূসা ইবনে জাফর, মাশহাদের ইমাম রেযা (আ) এর মাযার ইত্যাদি স্থাপনায় বড়ো বড়ো গ্রন্থাগার ছিল এবং এখনো আছে। এগুলো ছাড়াও বড়ো বড়ো মাযারগুলোতে যেমন কাউনিয়ায় মাওলানা জালালুদ্দিন রুমির মাযার, তাব্রিযে গাযান খানের মাযার, তোরবাত জামে শেখ আহমাদ জামের মাযার ইত্যঅদিতেও বড়ো বড়ো লাইব্রেরি গড়ে উঠেছিল। একইভাবে সরাইখানা বা পান্থশালা, খানকাহ কিংবা এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতেও লাইব্রেরি গড়ে উঠেছিল।

ইসলামী সভ্যতা ও ঐতিহ্য সমৃদ্ধ আরো কিছু সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ইত্যঅদির নাম করা যায়। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা দেওয়ার পাশাপাশি চিকিৎসা শাস্ত্র বিষয়ক গবেষণাও করা হতো। সেজন্যে চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে গড়ে উঠতো বড়ো বড়ো বইয়ের লাইব্রেরি। এরকম কয়েকটি হাসপাতালের মধ্যে মিশরের কুসাত হাসপাতাল, কায়রোর আলকাবির মানসুরি হাসপাতাল, বাগদাদের মোক্তাদেরি হাসপাতাল এবং রেই হাসপাতালের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এগুলো ইসলামী সভ্যতা ও ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ নিদর্শনের অন্তর্ভুক্ত। ইরাক, সিরিয়া এবং মিশরসহ মুলিম বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে শত শত মাদ্রাসা গড়ে উঠেছিলো। আর লাইব্রেরি ছাড়া কোনো মাদ্রাসার অস্তিত্ব কল্পনাই করা যেত না। মাদ্রাসা এবং লাইব্রেরি পরস্পরে অঙ্গাঙ্গিভাবে সংশ্লিষ্ট ছিল। মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকাহ, পবিত্র স্থান ইত্যাদির বাইরেও স্বতন্ত্রভাবে বহু লাইব্রেরি গড়ে উঠেছিল।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/আবু সাঈদ/২৭